dwipantworer-bondini-1
Class-11

দ্বীপান্তরের বন্দিনী । সারসংক্ষেপ

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – দ্বীপান্তরের বন্দিনী (সারসংক্ষেপ)

নজরুল ইসলাম

১৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম হয় কাজী নজরুল ইসলামের। তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতা জাহেদা খাতুন। গ্রামের মক্তবে দশ বছর বয়স পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও বেশিদূর পড়া হয়নি তাঁর। শৈশবেই তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। ১৯১৩ সালে প্রথমে শিয়ারসোল হাই স্কুল এবং পরে মাথরুন স্কুলে ভর্তি হন তিনি। আর্থিক দুরবস্থার জন্য একটি রুটির দোকানে কাজ করতে হয় তাঁকে। অষ্টম শ্রেণি পাশ করে বাঙালি পল্টন হিসেবে করাচিতে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন তিনি।

১৯১৭ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত তাঁর সৈনিকের জীবন কাটে। ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রাজদ্রোহের অভিযোগে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন নজরুল। এরই পাশাপাশি ‘নবযুগ’ পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হন তিনি। এরপর নজরুলের সম্পাদনায় প্রকাশ পায় বিখ্যাত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা যেখানে রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণী লিখে দিয়েছিলেন। তিনি ‘লাঙল’ নামে আরো একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা। ইতিহাসের দিক থেকে করাচির সেনানিবাসে থাকাকালীনই তাঁর সাহিত্যচর্চার অঙ্কুরোদ্গম হয়। তাঁর লেখা প্রথম গল্প ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ প্রকাশ পায় ১৩২৫ বঙ্গাব্দের ‘সওগাত’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। তাঁর প্রথম কবিতা মুক্তি প্রকাশ পায় ১৩২৬ বঙ্গাব্দে। এছাড়া তাঁর প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশ পায় ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’ নামে ১৩২৬ বঙ্গাব্দের ‘সওগাত’ পত্রিকার কার্তিক সংখ্যায়। ‘লাঙল’, ‘ধূমকেতু’, ‘প্রবাসী’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘শনিবারের চিঠি’, ‘বিজলী’ ইত্যাদি সাময়িক পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে।

কাজী নজরুলের অন্যতম প্রধান কাব্যগ্রন্থগুলি হল – ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ফণিমনসা’, ‘চক্রবাক’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সঞ্চিতা’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘সর্বহারা’ ইত্যাদি। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশ পাওয়ার পরে বাংলা সাহিত্য জগতে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল যা আজও মানুষের স্মৃতিতে অমলিন।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

এছাড়া তিনি লিখেছেন শতাধিক গান। তাঁর লেখা শ্যামাসঙ্গীত বাংলা গানের ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে আছে। এছাড়াও তিনি লিখেছেন তিনটি উপন্যাস, কিছু নাটক আর ছোটদের জন্য ছড়া। রাজদ্রোহের অভিযোগে কারাবরণও করতে হয়েছে তাঁকে। আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর ‘বিষের বাঁশি’, ‘প্রলয়শিখা’ এবং ‘চন্দ্রকেতু’ কাব্যগ্রন্থ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ফজলুল হক দলের মুখপত্ররূপে ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকা প্রকাশ করলে নজরুল সেই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। তাঁর ১৯৭৬ সালে দুরারোগ্য পিক্‌স ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।

দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতার উৎস

১৩৩১ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯২৪ সালের মাঘ মাসে এই কবিতাটি লিখেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। প্রথমে এটি ‘বন্দিনী’ নামে ‘বিজলী’ পত্রিকার মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরে ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ‘ফণিমনসা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয় এই কবিতাটি।

দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতার সারসংক্ষেপ

কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতার মূল বিষয় কেন্দ্রীভূত হয়েছে স্বাধীনতা আন্দোলনকে ঘিরে। পরাধীন ভারতে বহু বহু কালব্যাপী ইংরেজ শাসন চলেছে। তাদের অত্যাচারের নিষ্পেষণে পিষ্ট হতে হতে ভারতবাসীর মনে জমে ওঠা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রকাশ হতে থাকে বিপ্লবী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। সেই পরাধীন ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের জন্য কবির যে তীব্র আকুতি তাই এই কবিতার মুখ্য উপজীব্য।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় ব্রিটিশরা সমস্ত অকুতোভয় বিপ্লবীদের পাঠিয়ে দিচ্ছিল আন্দামানে। এই আন্দামান কবির কাছে স্বাধীনতার স্বপ্নকে অত্যাচারে দমিয়ে রাখার প্রতীক হয়ে ওঠে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অত্যাচার নিষ্পেষণের নির্মম পেষণযন্ত্র হয়ে ওঠে আন্দামান। ক্ষমতার মত্ততায় বিদেশি শাসকেরা দেশের মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে। ভারতবাসীর স্বাধীনতা নেই, নিজের দেশের মাটিতেই তারা অবাঞ্ছিত, তারা অবহেলিত।

দুশো বছরের ইংরেজ শাসন ভারতবাসীর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। শুরু হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগঠিত বৃহত্তর আন্দোলন। কিন্তু সেই সমস্ত আন্দোলন ব্যর্থ হয়। আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশরা একের পর এক কারাগারে বন্দি করছিল। আর এই কারাগারগুলির মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ও কুখ্যাত ছিল আন্দামানের সেলুলার জেল। একের পর এক বিপ্লবীকে পাঠানো হচ্ছিল কালাপানির পারে আন্দামানে।

কিন্তু এত অত্যাচারের অন্ধকারের মধ্যেও কবি দেখতে পেয়েছিলেন আশার আলোর স্ফূরণ। কবি বিশ্বাস করেন, অসুন্দরের সমস্ত বন্ধন-প্রভাব ঘুচে গিয়ে সুন্দরের প্রতিষ্ঠা হবে, মুক্তির সূর্য উদিত হবে ভারতের আকাশে – সেই সূর্য নতুন দিনের সূর্য। কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্ন – কবির স্বপ্ন নষ্ট-ভ্রষ্ট হচ্ছিল বারবার। ব্রিটিশরা চেয়েছিল সর্বাংশে ভারতবাসীর কণ্ঠরোধ করতে। পরাধীন ভারতের মানুষদের না ছিল মত প্রকাশের স্বাধীনতা, না ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা।

তাই কবি বিশ্বাস করেন, স্বাধীনতার যজ্ঞে যে সকল বীর বিপ্লবী আত্মাহুতি দিচ্ছেন, তাদের এই আত্মবলিদানই ভারতে স্বাধীনতা আনবে একদিন। যা অন্যায়, অনুচিত তাই ছিল ভারতে আইনসিদ্ধ, ভারতবাসীকে শত অত্যাচারের পরেও প্রতিবাদহীন করে রাখার অপচেষ্টা একদিন বন্ধ হবে, এমনই কবির বিশ্বাস। যুগান্তরের বার্তা কবি শুনেছেন আর সেই বার্তাকে স্বাগত জানিয়ে সমস্ত বিপ্লবীদের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এক বিদ্রোহী চেতনায় স্বাধীনতার স্বপ্নকেই কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন কাজী নজরুল ইসলাম।

ইংরেজ শাসনের নিষ্পেষণে ও অত্যাচারে দেশমাতা দ্বীপান্তরে অন্তরীণ। ভারত-ভারতী ফিরে আসেনি। দেড়শো বছর দেশমাতৃকা দ্বীপান্তরিতা। আন্দামানের অন্ধ কারাগারে ভারতমাতা যেন হাতে শৃঙ্খল পড়ে অত্যাচারিতা হচ্ছেন, নির্যাতিতা হচ্ছেন।

স্বাধীনতার কোমল পদ্ম ব্রিটিশদের অস্ত্রের আঘাতে শতচ্ছিন্ন হয়েছে। ভারতের বীণার তন্ত্রীতে আর বাজে না স্বাধীনতার সুর। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে আন্দামানে বন্দী ভারতের বেশিরভাগ বিপ্লবী। তাঁরা ছাড়া যে স্বাধীনতার আলোকপ্রদীপ জ্বালাতে পারবে না কেউ। ঔপনিবেশিক শোষণে ও শাসনের জাঁতাকলে সত্য থাকে বন্দি হয়ে। ঠিক এই সময়েই ভারতের বুকে জেগে ওঠে জাতীয়তাবাদের পদধ্বনি। এ জাতীয়তাবাদ শৌখিন জাতীয়তা কারণ দেশমাতার পুণ্য বেদিতে তখনও কান্নার সুর শোনা যায়।

আর মিথ্যা পূজার উপচারে দেশের মানুষ কল্পিত দেবতার আরাধনায় মগ্ন। পরাধীনতা, শোষণ আর বঞ্চনার কান্না দেশের দিকে দিকে ধ্বনিত। ন্যায় লুপ্ত হয়েছে দেশে, আইনের ছলাকলায় ন্যায়কে শাসন করে দমিয়ে রাখা হয় এখানে। চরম অত্যাচার সহ্য করেও সেই অত্যাচারের কথা প্রকাশ্যে বলা যায় না আর বিচার শুধুই শাসকের পক্ষ নেয়। বিচার মানে স্বাধীনতার আন্দোলনকে রুদ্ধ করা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

দেশের অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বললেই সে আখ্যা পেতো ‘বিদ্রোহী’। বন্দিনী সীতার মতো সেখানে বিপ্লবীরা বিচাররূপ চেড়ির মার সহ্য করে। অত্যাচারী শাসক খাঁচায় ভরে রাখে সিংহকে আর বাঘকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে হত্যা করে।

দেশের কেউ ভাবতে পারেনি ‘বীণা’ গুলি খাবে একদিন, বাণীর কমলকেও কারাবন্দি হতে হবে।

যদিও এখানে প্রতীকের সাহায্যে বিপ্লবী আন্দোলনের কয়েকজন প্রতিভূকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, এই বিষয়ে বিশদে পরে আলোচনা করা হয়েছে। এভাবেই ‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী’ কবিতায় দেশমাতৃকার করুণ নিপীড়িত রূপ ফুটে উঠেছে। কিন্তু দিন বদলাবেই, এ কবির স্থির বিশ্বাস। বেতার-সেতারে কবি শুনেছেন ‘মুক্তি-বন্ধ সুর’, কবি শুনেছেন স্বাধীনতার বাণী। কবি তাই উদ্গ্রিব হয়ে অপেক্ষা করছেন কবে এই ভারতভূমি আবার পবিত্র শুভ্র-সুন্দর শান্তির স্বর্গে পরিণত হবে।

যন্ত্রী এখানে সান্ত্রী বসিয়ে বীণার তার ছিঁড়ে ফেলছে। অন্যদিকে রক্ষপুর তথা যক্ষপুরী ধ্বংস হল কিনা সে নিয়ে উদবিগ্ন কবি। সেই অন্ধকারের পাঁকে রূপকমল ফুটেছে কি? চারিদিকে যে শঙ্খধ্বনি হচ্ছে তা কি শান্তির সূচনায়? এবার হয়তো সমস্ত হত্যালীলা-রক্ত ঝরানো সংগ্রাম স্তব্ধ হল। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে বাণী ঘানি টানে দিন-রাত, সত্য সেখানে বন্দি। সেই ঘানিতে বিদ্রোহীদের জীবনের সব তেজ নিঃশেষিত হয় আর তা থেকে নির্গত আরতির তেল প্রার্থনা করেন কবি।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

তা দিয়েই প্রজ্জ্বলিত হবে স্বাধীনতার প্রদীপ। মুক্ত ভারতী ভারতে নেই এখন। কিন্তু তার আসার দিন সমাগত দ্বীপান্তরের ঘানিতে যুগান্তরের ঘূর্ণিপাক লেগেছে। সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাচার, ভারতবাসীর অসহায়তা, বিপন্নতা এ সব মিলিয়ে কবি তাঁর এই পরাধীন দেশের মুক্তির স্বপ্ন দেখে যান।

নতুন দিনের সূর্য দেখার প্রত্যাশা কবিকে ব্যাকুল করে তোলে এই ‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী’ কবিতায় কবির কলমে এভাবেই ফুটে উঠেছে দেশ-মায়ের ক্লিন্ন রূপ, পরাধীনতার শৃঙ্খলবদ্ধ দেশ-মায়ের কান্না।

কবি মনে করেছেন সুদিন সমাগত। যুগান্তরের ধর্মরাজ স্বাধীনতার পদ্মে তাঁর পা রেখেছেন। দিন বদলাবেই। তাই সেই সুদিনের মুক্ত দিনের অভ্যর্থনা জানাতে কাজী নজরুল ইসলাম দেশবাসীকে পাঞ্চজন্য শঙ্খ বাজাতে বলেছেন, অঞ্জলি জানাতে বলেছেন সমবেত হয়ে। যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে দেশ-মায়ের কান্না এভাবেই মুছে যাবে কবির বিশ্বাস।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → দ্বীপান্তরের বন্দিনী । বিশদে আলোচনা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XI-Beng-Dipantworer-Bandini-1