mongolkabyo
Class-11

মঙ্গলকাব্য|মধ্যযুগে বাংলার সমাজ সাহিত্য

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)

এর আগে ভাগবতের অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে আলোচনা করবো।

আবার তোমাদের সামনে পেয়ে খুবই ভালো লাগছে বন্ধুরা। আশা করি সকলে সুস্থ আছো, পড়াশোনা আর খেলাধূলা নিয়ে খুবই সুন্দর দিন কাটছে তোমাদের। ইতিহাসে তোমরা আগের সময়কার মানুষের জীবন-যাপনের কথা কিছুটা জেনেছো। তখন মানুষের না ছিল ব্যস্ততা, না ছিল সবার আগে বেরিয়ে যাওয়ার অহেতুক ইঁদুর-দৌড়। খেতে কাজ করে এসে খাওয়া-দাওয়া করে একটু জিরিয়ে নিয়ে সান্ধ্য-আসরে পাড়ার বা গ্রামের সকলে একত্রিত হত স্থানীয় কোনো চণ্ডীমণ্ডপে বা বড়ো বাড়ির দাওয়ায়। হ্যাজাকের আলোয় তখনকার সমাবেশে নানাবিধ আলোচনা চলতো, আর সেই আসরেই বিনোদন হিসেবে কখনো হত সুর করে রামায়ণ-মহাভারত পাঠ কিংবা পালাগান।

এই পালাগানই আসলে সাহিত্যের ইতিহাসের দৃষ্টিতে মঙ্গলকাব্যের একটা প্রাথমিক পরিচয়।

তোমরা যারা গ্রামের দিকে থাকো, একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে এখনো শুনতে পাবে মনসা, চাঁদ সদাগর, লখিন্দরকে নিয়ে কখনো যাত্রা, কখনো বোলান গান, কখনো পালাগান অভিনীত হচ্ছে। বাংলার বুকে বহু বহু যুগ ধরে বাংলার সংস্কৃতির শিকড় তৈরি করেছে এই মনসা, চাঁদ সদাগরের কাহিনী। এটি কিন্তু অন্যতম একটি মঙ্গলকাব্যের কাহিনী। আহা! একটা ভুল হয়ে গেল যে। তোমাদের মনসা আর চাঁদ সদাগরের কাহিনীর কথা বললাম, মঙ্গলকাব্যের কথা বললাম, কিন্তু সেটা যে আসলে কী বস্তু তাই তো বলা হয়নি বিস্তারে।

এক কথায় বললে বলতে হয় যে দেব-দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারকে কেন্দ্র করে রচিত একপ্রকার কাব্য যা কিনা বাংলা ভাষাতেই লেখা হয়েছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি গানের আকারে উক্তি-প্রত্যুক্তির সহায়তায় অভিনীত হত।

সেইসব প্রাচীন দিনের মানুষদের কাছে এই মঙ্গল-গান কিংবা মঙ্গলযাত্রাই ছিল অবসর-বিনোদনের এক বিরাট উপকরণ।

মঙ্গল-গান কিংবা মঙ্গল-কাব্য নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো না যে একই জিনিসকে মঙ্গলকাব্যও বলছি আবার মঙ্গলগানও বলছি কেন? আসলে কারণ একটাই, এই টেক্সটগুলো কোনো একজন কবির নিজের লেখা, পরে তা অনেকেই পালাগানের মতো করে উপস্থাপন করতো, বলে এর নাম হয়ে গিয়েছে মঙ্গল-গান। তবে সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গিয়ে আমরা এই ব্যাপারটিকে মঙ্গলকাব্যই বলবো। এখন কথা হল কী এই মঙ্গলকাব্য? এর নামে ‘মঙ্গল’ই বা আছে কেন? দেখো বন্ধুরা, ‘মঙ্গল’ কথার মানে হল শুভ। মনে করা হয়, সেকালে এক মঙ্গলবার থেকে শুরু করে পরের মঙ্গলবার পর্যন্ত গানের আকারে গাওয়া হত এই কাব্যগুলি। তাই হয়তো এর নাম হয়েছে মঙ্গলকাব্য।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

আবার অনেকে মনে করেন, দেব-দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের মধ্য দিয়ে এই কাব্য পাঠের মধ্য দিয়ে শুভ বা কল্যাণ হতো সমাজের, ব্যক্তির তথা পরিবারের, তাই একে মঙ্গলকাব্য বলা হয়ে থাকে। এ নিয়ে এখনও বহু মতভেদ রয়েছে। প্রাচীন বাংলায় একদিকে যেমন শাক্ত ধর্মের প্রভাব ছিল, তেমনি বৈষ্ণব আধিপত্যও কম কিছু ছিল না। তাছাড়া তুর্কী আক্রমণের প্রভাবে আঞ্চলিক স্তরে অনেক অখ্যাত লোক-দেবতা কিংবা লোকদেবীর আবির্ভাব ঘটেছিল।

একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তুর্কী আক্রমণ বাংলার সমাজ-সংস্কৃতিতে কিন্তু অনেকটাই প্রভাব ফেলেছিল, এর ফলেই বাংলার সমাজে বর্গসম্মিলন দেখা যায়। অর্থাৎ সমাজের উঁচু জাত আর নীচু জাতের ভেদাভেদ অনেকটাই দূর হয়, উভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে মিলমিশ ঘটে আর তার ফলেই উভয়ের দেব-দেবীও মিলেমিশে এক নতুন দেব-দেবীর জন্ম হয়। মনসা, চণ্ডী, অন্নদা, ধর্মঠাকুর এরা কেউই কিন্তু মূলধারার দেব-দেবী ছিলেন না। বলা ভালো, এরা অধিকাংশই নিম্নবর্ণের প্রান্তিক মানুষের সমাজে পূজিত হতেন, ক্রমে উচ্চবর্গীয় হিন্দু সমাজেও এঁদের আধিপত্য বাড়তে থাকে। মজার কথা হল পুরাণে শিবকে যে উচ্চতায় বসানো হয়েছে, শিবের কন্যা মনসাকে কিন্তু সেই স্থান দেওয়া হয়নি।

তোমরা খেয়াল করে দেখবে মনসা থাকেন পাতালে, সূর্যালোক সেখানে পৌঁছায় না আর তাঁর পূজা-আচ্চা সেভাবে সমাজে প্রচলিতও নয়। কিন্তু অন্যদিকে শিব থাকেন স্বর্গে, সুরম্য কৈলাস পর্বতে, জগতে সকলের পূজার ঘরে তাঁর অবারিত দ্বার। এই কারণেই মনসাকে পূজা প্রচার করতে হয়, নিজের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে মর্ত্যধামে পূজা ছড়াতে হয়, চণ্ডীকেও তাই। অন্নদা দেবী আর ধর্মঠাকুরের ব্যাপারটা একটু আলাদা, তা যখন বিশদে আলোচনা করা হবে তখনই বলবো না হয়।

তুর্কী আক্রমণ মানুষের বলা ভালো বাঙালির মনোবল ভেঙে দিয়েছিল, মানসিক দিক থেকে তাঁরা কোনো একটা অবলম্বন খুঁজছিল। আর তাই সেই সময় থেকেই বাঙালি সমাজে দেব-দেবীদের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। তার ফলে সাহিত্যেও দৈবী প্রাধান্য চোখে পড়ে। মধ্যযুগের সাহিত্যের অনেকাংশেই দৈবী প্রভাব রয়েছে। এই মঙ্গলকাব্যও তার ব্যতিক্রম নয়।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, যে কবিরা মঙ্গলকাব্য লিখেছেন, তার কিন্তু সেই কাব্যের মধ্য দিয়ে আদপে মানুষের কথা বলতে চেয়েছেন, দেবতার বা দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার একটা আড়াল মাত্র। সেই যুগ ব্যক্তি স্বাধীনতার যুগ ছিল না। সাহিত্যের ইতিহাস যদি খেয়াল করো ধারাক্রমিকভাবে, বন্ধুরা দেখলে আশ্চর্য হবে যে মধুসূদন দত্তের আগে সেভাবে বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতা আসেনি, সমাজও তত আধুনিক ছিল না।

ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল না, আর তাই মধুসূদনই প্রথম গীতিকাব্য লিখেছেন। সেই গীতিকাব্য ব্যক্তির নিজের অন্তরের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু তার আগে একটা বিরাট সময় পর্যন্ত কবিরা সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপে নিজের কথা বলতেই পারতেন না তাঁদের সাহিত্যে। তাহলে উপায়? বন্ধুরা, সেই সব কবিদের মেধার ছিল অতুলনীয়।

তাঁরা রাজসভায় যাতে সেই কাব্য সমাদর পায়, সমাজের লোক যাতে সেই কাব্যকে গ্রহণ করে সাদরে, তাই কাব্যে দৈবী চরিত্র উপস্থাপন করলেন, উল্লেখ করলেন যে দৈবী স্বপ্নাদেশেই সেই কাব্য তাঁরা রচনা করেছেন আর তার আড়ালে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা, সমাজের মানুষদের চরিত্র, সমাজ-রাজনৈতিক পরিবেশকে ফুটিয়ে তুললেন তাঁদের কাব্যে।

তাই সেই সব কাব্যগুলি বাংলা সাহিত্যের একেকটি উজ্জ্বল সম্পদ। এই সাহিত্যগুলির মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য এই মঙ্গলকাব্যগুলি। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়েছে বন্ধুরা। তাই ক্রমে ক্রমে আমরা সেই আলোচনায় প্রবেশ করবো। এখন মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা আমাদের গড়ে তোলা দরকার। পরীক্ষার উত্তর করতে গেলে অনেক সময়ই তোমরা দেখতে পাবে মঙ্গলকাব্য কী, এর বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী তা নিয়ে প্রশ্ন আসে। এটা অবশ্যই তোমাদের জেনে রাখা দরকার।

মোটামুটিভাবে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই কিন্তু এই মঙ্গলকাব্যগুলি লেখা শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়।

মূলত কোনো দেব-দেবীর পূজাকে কেন্দ্র করে পরপর কয়েকদিন ধরে সুর-তাল-ছন্দ সহযোগে এই কাব্যগুলি গানের আকারে গীত হত। মানুষের বিশ্বাস ছিল যে এই গান উপস্থাপিত হলে, এই গান শুনলে মঙ্গল হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লৌকিক দেব-দেবী বা পৌরাণিক দেব-দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হতো এই মঙ্গল গানের মধ্য দিয়ে। এই মাহাত্ম্য বর্ণনার মূলে একটি কাহিনীর প্রেক্ষাপট গড়ে তুলতেন কবিরা। প্রতিটি মঙ্গলকাব্যেই দেখা যায় এই কাহিনীর ঘটনা বা চরিত্র আলাদা হলেও কাহিনীর সংগঠনটা একই।

মঙ্গলকাব্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলতে গেলেই এই কাহিনীর সংগঠনের কথা আসে।

প্রতিটি মঙ্গলকাব্যেই যেমন দেখা যায় কাব্যের নায়ক আসলে কোনো স্বর্গভ্রষ্ট দেবতা বা দেবী, তারা মর্ত্যে জন্মেছে কোনো এক অখ্যাত দেব-দেবীর পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যে। সেই দেব-দেবীর তাই মানবজন্ম হয়েছে। মঙ্গলকাব্যের শুরুতে গণেশ ইত্যাদি দেবতাদের বন্দনার পরে একটি বিশেষ অংশ থাকত যার নাম ছিল ‘গ্রন্থোৎপত্তির কারণ’। এই অংশে কবি নিজের জীবনের কাহিনী বলতেন, তার পাশাপাশি উল্লেখ করতেন যে কোন দেবতা বা দেবীর স্বপ্নাদেশে এই কাব্য রচনায় তিনি প্রবৃত্ত হয়েছেন।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

শিব ও পার্বতীর কথা প্রায় প্রতিটি মঙ্গলকাব্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া গঠনগত দিক থেকে প্রতিটি কাব্যেই দেখা যায়, নায়িকার বারমাস্যা তথা বারো মাসের দুঃখের কাহিনী, নারীদের পতিনিন্দা, চৌতিশা বা চৌত্রিশটি অক্ষরে গ্রথিত দেবতার স্তব, রান্নার উপকরণ ও পদের নানাবিধ নামের উল্লেখ, সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা ইত্যাদি বিষয়গুলি। মধ্যযুগের কবিদের যেহেতু নিজের কথা বলার অবকাশ ছিল না কাব্যে, তাই সেই দৈবী প্রাধান্যের যুগে দাঁড়িয়ে কাব্য রচয়িতা হিসেবে কবিরা বিশেষ রীতিতে নিজের নাম কাব্যের পদের মধ্যে লিখে দিতেন যাকে ‘ভণিতা’ বা ‘গৌরচন্দ্রিকা’ বলা হয়।

তাছাড়া একমাত্র কাব্যের ‘গ্রন্থোৎপত্তির কারণ’ অংশ থেকেই কবির সম্পর্কে, তাঁর নাম ও বংশ পরিচয় সম্পর্কে বিশদে তথ্য জানতে পারা যায়। তাহলেই ভাবো বন্ধুরা, এই অংশটি যদি নাই পাওয়া যেতো, তাহলে কোন কাব্য কে লিখেছেন তা খুঁজে বের করা এক প্রকার দুঃসাধ্য হয়ে উঠতো। যাক সে কথা, এখন তোমাদের বলি মোটামুটিভাবে মঙ্গলকাব্য বলতে চার ধরনের কাব্যকে বোঝানো হয়ে থাকে –

· মনসামঙ্গল কাব্য
· চণ্ডীমঙ্গল কাব্য
· অন্নদামঙ্গল কাব্য
· ধর্মমঙ্গল কাব্য

তবে এছাড়াও পঞ্চদশ শতাব্দীতে কিংবা তার কিছু পরেও কৃষ্ণমঙ্গল কাব্য বলে একটি বিশেষ সাহিত্য-ধারার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আর রয়েছে শিবায়ন কাব্য। এই শিবায়নকে মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, কিন্তু দৈবী মাহাত্ম্য প্রচারমূলক সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই কাব্যের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এই কাব্যের নামের মধ্যেও ‘মঙ্গল’ কথাটি নেই।

মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য

কিন্তু কাব্যের বিষয়ের মধ্যে মঙ্গলকাব্যের গঠনের ছাপ স্পষ্ট। এখন এক ঝলকে মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি দেখে নাও বন্ধুরা –
১) ভণিতা ব্যবহার

মঙ্গলকাব্যের কবিরা নিজেদের নাম ও পরিচয় সরাসরি কাব্যের মধ্যে উল্লেখ করতেন না, বরং কোনও কোনও বর্ণনার শেষে উল্লেখ করে দিতেন। এই নাম উল্লেখের বিশেষ শৈলীকেই ভণিতা বলা হয়।

২) পাঁচালির রীতি

সমাজে এই কাব্যগুলি ব্রতকথার মতো পড়া হতো। তাই এগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাঁচালির ছন্দে লেখা হয়েছিল। তবে এই ছন্দকে আসলে পয়ার ছন্দ বলা হয়।


৩) বারমাস্যা

এই অংশে আসলে কাব্যের নায়িকার বারো মাসের দুঃখের কাহিনী বর্ণিত হয় নায়িকার নিজের বয়ানে।

৪) নারীগণের পতিনিন্দা

প্রতিটি মঙ্গলকাব্যেই দেখা যায় বিবাহ সভায় উপস্থিত নারীরা কাব্যের নায়কের রূপে মোহিত হয়ে নিজেদের পতিদের অক্ষমতার কথা স্মরণ করে একযোগে পতিনিন্দা করছে। এই অংশে নারী-পুরুষের গার্হস্থ্য জীবনের নানাবিধ সমস্যার কথা জানা যায়।

৫) রন্ধনপ্রণালী

নায়ক ও নায়িকার জীবনের নিত্যদিনের রন্ধনকার্যের বর্ণনার মধ্য দিয়ে একটি বিশেষ সমাজের একটি সময়ে প্রচলিত খাদ্যাভ্যাসের ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই অংশে।

৬) চৌতিশা

চৌত্রিশটি অক্ষরের স্তবকে বলা হয় চৌতিশা। বাংলা বর্ণমালার ক থেকে হ পর্যন্ত বর্ণ দিয়ে এই স্তবটি লিখিত, বিশেষ কবিতার পংক্তিতে সজ্জিত। কাব্যে যখন নায়কের বিপদ আসন্ন কিংবা বিপদ্‌গ্রস্ত অবস্থাতে নায়ক উদ্ধার পাওয়ার জন্য ঈশ্বরের কাছে এই চৌতিশা স্তব করে থাকেন।

৭) অলৌকিক ঘটনার উপস্থাপনা

প্রতিটি মঙ্গলকাব্যেই দেখা যায় যে, কাহিনীর মধ্যে অনেকরকমের অলৌকিক
প্রসঙ্গের উপস্থাপনা করেন কবিরা।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় বলে আজকের আলোচনা শেষ করবো বন্ধুরা।

প্রতিটি মঙ্গলকাব্যেই দেখবে তোমরা স্পষ্টত চারটি কাহিনীর অংশ দেখা যায় – দেব-বন্দনা, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ, দেবখণ্ড ও নরখণ্ড।

খুব সংক্ষেপে এ সম্পর্কে একটা ধারণা দিই। দেখো বন্ধুরা, আগেই বলেছি মঙ্গলকাব্যের কবিরা তাঁদের রচনার মধ্যে সমাজের চাপে নিজের কথা বলতেই পারতেন না, দৈবী প্রভাব তাই অবশ্যম্ভাবী ছিল। এখন এই দৈবী প্রভাব মূলত পাওয়া যায় কাব্যের এই দেব-বন্দনা অংশে। এখানে বহু দেব-দেবীর স্তুতি করেন কবি এবং সবশেষে তাঁদের সকলকে প্রণাম জানিয়ে কাব্য শুরু করেন। দেব-দেবীদের মধ্যে থাকেন গণেশ, সরস্বতী, শিব, চণ্ডী, দুর্গা প্রমুখ।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

গ্রন্থোৎপত্তির কারণ অংশটি সম্পর্কে আগেও বলেছি, তাই আর পুনরুক্তি করলাম না। দেবখণ্ড আর নরখণ্ডের ব্যাপারটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। এই মঙ্গলকাব্যগুলি তো আসলে কোনো একজন বিশেষ দেবী বা দেবতার পূজা প্রচারের কথা বলে, এখন সেই দেব-দেবীর পূজা প্রচারের জন্য প্রায়ই কাব্যের কাহিনিতে দেখা যায় স্বর্গের কোনো এক দেবতা ও কোনো এক দেবী শাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যে মানবরূপে আবির্ভূত হন এবং তাঁদের মাধ্যমেই উদ্দিষ্ট দেব-দেবীর পূজা মর্ত্যধামে প্রচারিত হয়। এই ধরনের কাহিনিকে কাব্যের দেবখণ্ড বলে আর নরখণ্ডে একই রকম পূজা প্রচারের কাহিনি থাকে, কিন্তু সেখানে কোনো দেব-দেবী নয় বরং মানুষের কথা বলা হয়। এই খণ্ডের চরিত্ররা সকলেই রক্ত-মাংসের মানুষ। এভাবেই মঙ্গলকাব্যের নৌকা বয়ে চলে।
তবে আমাদের এবার নোঙর ফেলার পালা। আপাতত থামি। আজকে এখানেই ছুটি।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – মনসামঙ্গল কাব্য


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।

JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –