ramayaner-onubad
Class-11

রামায়ণের অনুবাদ | মধ্যযুগে বাংলার সমাজ সাহিত্য

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)


এর আগে অনুবাদ সাহিত্য ধারা সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা রামায়ণের অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

আমরা প্রথমেই চলে আসি রামায়ণের অনুবাদের আলোচনায়।

বাংলা ভাষায় প্রথম রামায়ণের অনুবাদ করেন কবি কৃত্তিবাস ওঝা।

কৃত্তিবাস ওঝার জীবনী সেভাবে পাওয়া যায় না। তার জীবন সম্পর্কে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায় তা কেবলই কৃত্তিবাস ওঝার লেখা ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ কাব্যের আত্মবিবরণী অংশ থেকে। এই অংশে জানা যায় কবির পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা ছিলেন ত্রয়োদশ শতকের রাজা দনুজমর্দন দেবের সভাসদ। নরসিংহ পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামে এসে থাকতে শুরু করেন এবং তাঁর পুত্র গর্ভেশ্বর এবং গর্ভেশ্বরের পুত্র মুরারি। মুরারি ওঝার সাত পুত্রের মধ্যে একজনের নাম ছিল বনমালী।

এই বনমালী ওঝার পুত্রই হলেন কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাসের মায়ের নাম জানা যায় মালিনী। তাদের বংশের আসল পদবি ছিল ‘মুখুটি’ বা মুখোপাধ্যায়, কিন্তু তারা ‘ওঝা’ পদবিতেই পরিচিত হলেন।

মনে করা হয়, কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষদের পেশা ছিল শিক্ষকতা বা অধ্যাপনা। অধ্যাপকদের সেই সময় উপাধ্যায় বলা হতো। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, এই ‘উপাধ্যায়’ শব্দের অপভ্রংশ হল ‘ওঝা’। সমালোচকদের মতে, কৃত্তিবাসের জন্ম হয়েছিল ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে এবং তিনি ১২ বছর বয়সেই উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বড়গঙ্গা বা পদ্মানদী পেরিয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে রওনা হন।

পরবর্তীকালে তার অধ্যয়ন শেষ করার পর গৌড়েশ্বরের সভায় কৃত্তিবাস গিয়ে পৌঁছান। এই রাজসভার হিন্দু রীতি থেকে মনে হয়, এই গৌড়েশ্বর আসলে ছিলেন পঞ্চদশ শতকের হিন্দু রাজা গণেশ। মনে করা হয়, এই রাজার পৃষ্ঠপোষকতাতেই কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ রচনা করেছিলেন। এবারে কবির পরিচয় জানা শেষ, আমরা সোজা চলে যাবো তাঁর কাব্যের আলোচনায়।

বাল্মীকির লেখা সংস্কৃত রামায়ণের অনুবাদ করলেও, বলা ভালো সংস্কৃত রামায়ণের অনুসরণে ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ কাব্যটি লিখলেও মূল রামায়ণের সঙ্গে কৃত্তিবাসের কাব্যের বহুল পার্থক্য চোখে পড়ে। কৃত্তিবাসের কাব্যের কাহিনি, চরিত্র, পরিবেশ বর্ণনা সবেতেই প্রকৃত বাঙালি সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। সেকালের বাঙালিদের খাদ্যাভ্যাস, বেশভূষা, আচার-অনুষ্ঠান, রীতি-নীতি ইত্যাদি ধরা পড়েছে তাঁর এই কাব্যে। কৃত্তিবাসের এই কাব্যের কাহিনিতে আমরা দেখি গুহকের কুটিরে ভরতকে দুধ, দই, নারকেল, আম, কলা ইত্যাদি দিয়ে আপ্যায়ন করার রীতি। তাছাড়া বিভিন্ন অংশে গুড়ের পিঠে, নারকেল পুলি, তালের বড়া, ছানার বড়া ইত্যাদি মিষ্টান্নের উল্লেখও পাওয়া যায় যা কিনা বাঙালিদের একান্তই নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

এছাড়া বাঙালি গৃহস্থের মতোই সন্তান জন্মের পরে পঞ্চম দিনে পাঁচুটি, ষষ্ঠ দিনে ষষ্ঠীপূজা, অষ্টম দিনে অষ্টকলাই কিংবা ছয় মাস অতিক্রান্ত হলে অন্নপ্রাশন ইত্যাদি অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিয়েছেন কবি কৃত্তিবাস। এই সব অনুষ্ঠানের রীতি আজও বাঙালির ঘরে ঘরে পালিত হয়।

বাল্মীকির রাম যেন বীর, ক্ষত্রিয় কুলের প্রতিনিধি, কৃত্তিবাসের রামচন্দ্র কিন্তু এর বিপরীতে নিতান্তই বাঙালি সন্তান, বলা ভালো বাঙালি পরিবারের সনাতন জ্যেষ্ঠ পুত্রের সমতুল। একইরকমভাবে ভারত, লক্ষ্মণ, শত্রুঘ্নদের পরিচয়ও এই কাব্যে গড়ে উঠেছে বাঙালির ভ্রাতৃপ্রেমের আদলে। সীতা তো এখানে যেন এক অভাগিনী বাঙালি গৃহবধূ। সীতার পতিপরায়ণতা, সেবাপরায়ণতা এবং রামের পিতৃভক্তির বর্ণনার মধ্যে বাঙালির মানসিকতা তথা বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই দেখা যায়।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

একইসঙ্গে বাঙালিদের মতোই এখানে বেশ কিছু চরিত্রে আলস্য, কলহপ্রিয়তাও ফুটে উঠেছে কৃত্তিবাসের নিপুণ লেখনীতে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত করুণ রসের ধারায় সিক্ত এই কাব্য আদ্যন্ত বাঙালিয়ানায় ভরপুর বলা চলে। বাল্মীকির রামায়ণের অনুসারী হয়েও কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ যেন একান্তই বাঙালির রামায়ণ হয়ে উঠেছে। তোমরা শুনলে অবাক হবে, ছোটোবেলায় তোমরা যে ছবিতে রামায়ণ, ছোটোদের রামায়ণ ইত্যাদি বই পড়তে আগ্রহ সহকারে, সে সবই কিন্তু কৃত্তিবাসের রামায়ণের কাহিনিরই অংশবিশেষ। কৃত্তিবাস তাঁর নিজের কাব্যে উল্লেখ করেছেন যে বাল্মীকি রামায়ণ ছাড়াও ‘জৈমিনি ভারত’, ‘অদ্ভুত রামায়ণ’-এর দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হতেই পারে বাঙালিদের মধ্যে কৃত্তিবাসের এই রামায়ণ এত জনপ্রিয় হয়ে উঠলো কেন?

এর পিছনে অনেকগুলি কারণ আছে, এক এক করে জেনে নিই চলো –

· প্রথমত, বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনিকে হুবহু অনুসরণ করেননি কৃত্তিবাস, বাঙালি মানসিকতায় সিক্ত কৃত্তিবাস মূল রামায়ণের কাহিনির সঙ্গে যুক্ত করেছেন আরো অনেক কাহিনি।
· দ্বিতীয়ত, কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’র সীতা যেন এক সহনশীলা বাঙালি গৃহবধূ আর রামচন্দ্র ক্ষত্রিয় বীরের থেকেও ভক্তের ভগবানের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছেন। ভরত আর লক্ষ্মণ যেন চিরন্তন বাঙালি পরিবারের এক অনুগত ভাইয়ের প্রতিরূপ। তাছাড়া মহাবলী হনুমান এখানে রবীন্দ্রনাথের সেই ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার ভৃত্যের মতো রামের পদতলে সর্বদা নিবেদিত প্রাণ।
· তৃতীয়ত বলা যায় পরিবেশ রচনাতেও কৃত্তিবাস বাংলার নদী-মাঠ-ভাঁটফুলের শোভা বর্ণনা করেছেন তাঁর কাব্যে। নারকেল গাছ, কাদাখোঁচা পাখি, সারস ইত্যাদি পল্লিবাংলার নিজস্ব উপাদান এবং বাঙালি সমাজজীবনের এক অন্তরঙ্গ ছবি যা ধরা পড়েছে তাঁর কাব্যে।
· করুণরস আর ভক্তিরসের প্রাবল্যে বাঙালি মনকে মাতিয়ে তুলতে পেরেছিলেন কৃত্তিবাস।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

· সবশেষে বলতে হয়, সংস্কৃত ভাষা যেমন সকলের পক্ষে বোঝা দুষ্কর ছিল, তেমনি সেই ভাষার বাঁধুনিও ছিল বেশ জটিল। গড়পড়তা বাঙালির পক্ষে তা বোঝা এবং উপলব্ধি করা ছিল সত্যি দুষ্কর। তাই কৃত্তিবাসের সহজ, সরল পাঁচালির ঢঙে লেখা ছন্দবদ্ধ এই রামায়ণের কাহিনি বাঙালির কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠলো। বাঙালি যেন কৃত্তিবাসের কাব্যের মধ্যেই মূল রামায়ণের স্বাদ খুঁজে পেয়েছিলেন।
একটা কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া ‘এপিক’ (Epic)-এর স্বাদ এভাবে বাংলা ভাষায় তুলে ধরার মুন্সিয়ানাই কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’কে জনপ্রিয় করে তুলেছে নিঃসন্দেহে।

অন্যান্য অনুবাদ

বাংলা ভাষায় রামায়ণ অনুবাদকদের মধ্যে কৃত্তিবাস প্রতিনিধিস্থানীয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু তিনি ছাড়াও আরো কয়েকজন কবির রামায়ণ অনুবাদ উল্লেখযোগ্য। যেমন –

ষোড়শ শতাব্দীতে শঙ্কর দেব রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের অনুবাদ করেন এই একই নামে। সপ্তদশ শতাব্দীতে দুটি উল্লেখযোগ্য রামায়ণের অনুবাদ হয় – নিত্যানন্দ আচার্যের লেখা ‘অদ্ভুত আচার্যের রামায়ণ’ এবং চন্দ্রাবতীর রামায়ণ। তাছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবিচন্দ্র শঙ্কর চক্রবর্তীর ‘অধ্যাত্ম রামায়ণ’ও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → মহাভারতের অনুবাদ

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_4