srikrishnakirtan
Class-11

মধ্যযুগের বাংলার সমাজ সাহিত্য (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)


এর আগে মধ্যযুগের বাংলার সমাজ সাহিত্য – প্রথম পর্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা মধ্যযুগের বাংলার সমাজ সাহিত্য – দ্বিতীয় পর্ব সম্পর্কে আলোচনা করবো।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

কেমন আছো বন্ধুরা? বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সেই অপছন্দের ক্লাস আজকে আবার। সত্যিই কি অপছন্দের? সাহিত্যের যে এত এত পুরনো গল্প বললাম তোমাদের, একটুও কি ভালো লাগেনি? বাঙালি হয়ে বাংলা সাহিত্য, বাংলার সংস্কৃতির কথা জানবো না তা কি হয়! তাই তো সহজ করে গল্পের ছলে সেই সব ঐতিহ্যের কথা তোমাদের বলতে আসা। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, সে ভাষায় সবকিছুই আমাদের সম্পদ। সেই যে রামপ্রসাদের একটা গান রয়েছে –

মনরে, কৃষি কাজ জানো না,
এমন মানব জমিন রইল পতিত,
আবাদ করলে ফলতো সোনা।

সত্যিই আমাদের এই বাংলার মাটিতে সোনা ফলে। তবে এই সোনা গয়নার সোনা নয় বন্ধুরা, বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, তার সাহিত্য, তার গান, কাব্য-নাটক সবই এই সোনা। বাঙালি মনীষীরাও আমাদের কাছে সোনার মতোই মূল্যবান সম্পদ। তাই এই সাহিত্যের ইতিহাস জানাটা আমাদের এক গুরুদায়িত্ব। তথ্য আর তত্ত্ব তো থাকবেই প্রচুর, তবু তার মধ্যে থেকেই সুন্দর গল্পটা জানানোর জন্যই এই ক্লাস। শুধুমাত্র ‘পরীক্ষা’ নামক ‘অগাধ পানি’ পেরোনোর জন্য নৌকা তৈরি করে দেওয়াই এই ক্লাসের কাজ নয়, এই ক্লাসের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে যদি তোমরা এতটুকুও ভালোবেসে ফেলো তাহলেই এই ক্লাসের সার্থকতা।

যাই হোক, আজকে আমরা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো। এর আগের ক্লাসে মধ্যযুগের বিপুল বিস্তৃত সাহিত্যের একটা ধারাক্রম বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আশা করি, ওই ধারাক্রমটি মাথায় রেখে এর পরের আলোচনাগুলো বুঝতে তোমাদের সুবিধাই হবে। মধ্যযুগের সাহিত্যের আলোচনায় প্রথমেই আসে যে নিদর্শনের কথা তা হল – ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। এই প্রথম শুরু হল বাংলা সাহিত্যে দৈবী প্রাধান্য। দেব-দেবীকে কেন্দ্র করে সাহিত্যিকরা সাহিত্য রচনা করতে লাগলেন। নাম দেখেই বুঝতে পারছো, এই রচনার মূল বিষয় আবর্তিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরে।

সেটা তো বুঝলে, কিন্তু প্রশ্ন হল এই ‘কীর্তন’ ব্যাপারটা আবার কি?

খুব সহজ করে বললে, লোকায়ত ভক্তিগীতির এক বিশেষ রূপ এই কীর্তন। ‘কীর্তন’ কথার আক্ষরিক অর্থ হল কোনো ব্যক্তির কীর্তির কথা গানের মাধ্যমে প্রচার করা। মূলত দেব-দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যেই এই কীর্তন গাওয়া হয়ে থাকে। ফলে কীর্তনের মধ্যে যে গানের একটা ধর্ম আছে তা আশা করি বোঝা গেল।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এই নাম থেকে এক ঝলকে যা বোঝা যায় বা বুঝে নিতে হবে আমাদের তা হল – শ্রীকৃষ্ণের জীবনের কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত কীর্তন গান।

কিন্তু একে গান বলা হয় না, বলা হয় কাব্য। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, প্রাচীনকালের বাংলা ভাষায় কোনো গদ্যরূপ ছিল না। সাহিত্যিকরা লিখতেন ছন্দবদ্ধ কাব্যের রীতিতে, তাই সেই সময়কার সব ধরনের রচনাকেই কাব্য বলা হতো। বর্তমানে যদিও কাব্য বলতে আমরা দীর্ঘকবিতার ধাঁচে লেখা কোনো রচনাকে বুঝি। এখন এই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি কে লিখেছেন তা তো আগে জানতে হবে। কবির নাম জানা যায় বড়ু চন্ডীদাস।

এ নিয়েও গল্প রয়েছে!

এই চণ্ডীদাস আসলে যে কে সেটা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় সাহিত্যের ইতিহাসকারদের মধ্যে এবং সমালোচকদের মধ্যে। বৈষ্ণব পদাবলীর আলোচনা যখন আমরা করবো, তখন সেখানেও দেখতে পাবে একজন চণ্ডীদাস রয়েছেন। তাহলে কি এই চণ্ডীদাস এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা চণ্ডীদাস একই ব্যক্তি?


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

সাহিত্যের ইতিহাস পড়লে জানা যায় বড়ু চণ্ডীদাস এবং পদাবলীর চণ্ডীদাস ছাড়াও দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস, অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস ইত্যাদি নামে আরো অনেক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়।

কিন্তু এত নাম সত্ত্বেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর রচয়িতা হিসেবে বিচার করেছেন বড়ু চণ্ডীদাসের নাম।

এত জটিলতার মধ্যে না গিয়ে তোমরা শুধু এটুকুই মনে রাখো যে, এই বড়ু চণ্ডীদাস এবং পদাবলীর চণ্ডীদাস দুজনে পৃথক ব্যক্তি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের নাম নিয়েও সমালোচকদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়েছিল।

এই বিতর্ক থেকে কাব্যের আসল নাম সম্পর্কে তিনটি বিকল্প উঠে এসেছিল – ১) শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ২) কৃষ্ণকীর্তন এবং ৩) শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ।

এ নিয়েও গল্পের শেষ নেই!

প্রাচীনকালের পুথি আবিষ্কার এবং তা ব্যাখ্যা করা সত্যিই দুঃসাধ্য। কারণ তখন তো আর আজকের দিনের মতো জেরক্সের ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না স্মার্টফোনে টুক করে ছবি তুলে নেওয়া কিংবা স্ক্যানারে স্ক্যান করে চিরকালের জন্য ক্লাউড মেমোরিতে সঞ্চিত রাখার সুবিধা। তখন লিপিকরেরা নিজে হাতে দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন পুথি-পত্র নকল করতেন। এখন এই নকল করতে গিয়েই নানাবিধ প্রমাদ ঘটতো। লিপিকর নিজের উৎসাহে হয়তো বা কবির লেখা পালটে দিতেন, কখনো এমনও দেখা গেছে যে লিপিকর কোনো কাব্যের মধ্যে নতুন কোনো অংশ জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু পুথি দেখে চট করে তা বোঝার উপায় থাকে না, তাই একই কাব্যের দু-চারটে পুথি পাওয়া গেলে গবেষকরা অনেক বিচার-বিবেচনা করে মূলপাঠ কোনটা তা স্থির করেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সঙ্গে। হ্যাঁ, বন্ধুরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথি তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন।

চর্যাপদের পুথি যেমন পাওয়া গিয়েছিল নেপালের রাজদরবারে, তেমনি ১৯০৯ সালে বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের অধিবাসী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘর থেকে বাংলা ভাষায় লেখা এই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের পুথিটি আবিষ্কার করেছিলেন বসন্তরঞ্জন।

বসন্তরঞ্জন রায় একে রাধা-কৃষ্ণ লীলা বিষয়ক আখ্যানকাব্য বলে চিহ্নিত করেছিলেন। আখ্যানকাব্য বলতে সাধারণভাবে কোনো বিশেষ কাহিনী অবলম্বনে রচিত কাব্যকে বোঝায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুথিটি বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনায় ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশ পায়। গবেষকরা মনে করেছেন মোটামুটিভাবে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ দিকে বা পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এই কাব্য রচিত হয়েছিল। ভাষাতাত্ত্বিকরা এই কাব্যের ভাষার প্রকৃতি বিচার-বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, এই কাব্যের ভাষা আদি মধ্যযুগের বাংলা ভাষার নিদর্শন। তোমরাও খেয়াল করে দেখবে চর্যাপদের বাংলা ভাষার সঙ্গে এই কাব্যের বাংলা ভাষার অমিল আছে। চর্যাপদের বাংলা ভাষার দুর্বোধ্যতা এই কাব্যে প্রায় নেই বললেই চলে এবং এর শব্দগুলি অনেকটাই আজকের বাংলা ভাষার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল চরিত্র তিনটি – শ্রীকৃষ্ণ, রাধা এবং বড়াই। এছাড়াও আছেন রাধার স্বামী নপুংসক আইহন। সমগ্র কাব্যটিতে বড়ু চণ্ডীদাস মোট ১৩টি খণ্ডে শ্রীকৃষ্ণ, রাধা আর বড়াইকে ঘিরে তার কাহিনিকে বিন্যস্ত করেছেন। বন্ধুরা তোমাদেরকে একটু কষ্ট করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের তেরোটি খণ্ডের নাম মনে রাখতে হবে। চলো চট করে দেখে নিই –

জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, যমুনাখণ্ড বা কালীয়দমনখণ্ড, বস্ত্রহরণখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড এবং রাধাবিরহ।

আগেই দীর্ঘশ্বাস পড়ে গেল হয়তো তোমাদের। তবে চিন্তা নেই, সমস্যা যখন সামনে সমাধানও সামনে হাজির। কীভাবে মনে রাখবে খণ্ডগুলির নাম সে চিন্তা থেকেই নিচে তোমাদের জন্য এই ছড়াটি দেওয়া হল –

জন্মের পরে পান, তারপরে দান, নৌকা ডেকে ভার গায় বৃন্দাবন গান,
যমুনার কালীয় শেষে বস্ত্রহরণ, আগে হার, পরে বাণ, বংশী হরণ,
সবার শেষেতে আছে রাধাবিরহ,
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য নয় দুরূহ।

ছড়াটি ছন্দে ছন্দে একবার মনে রাখতে পারলেই কেল্লা ফতে। একেবারে পর পর তেরোটি খণ্ডের নাম তোমরা বলে দিতে পারবে। আর কোনো সমস্যাই হবে না। ছড়ার মধ্যে বিভিন্ন রঙে খণ্ডগুলির নাম চিহ্নিত আছে দেখেছো নিশ্চয়ই। শুধুমাত্র পান বলে লেখা যে খণ্ডটি তা আসলে তাম্বুলখণ্ডকে বোঝাচ্ছে। খণ্ডের নাম জানা হল, এবার খুব সংক্ষেপে আমরা সমগ্র কাব্যটির কাহিনিটি একটু জেনে নিই চলো।

১। জন্মখণ্ড

জন্মখণ্ডে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম সম্পর্কিত পৌরাণিক ঘটনা রয়েছে। রোহিণী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে দেবকীর গর্ভে তার অষ্টম সন্তানরূপে কৃষ্ণের জন্ম হয় এবং রাতের গভীরে মায়াবলে বসুদেব তাকে রেখে আসেন নন্দালয়ে। দেবতাদের নির্দেশেই লক্ষ্মী মর্ত্যে আসেন রাধা রূপে। এই খণ্ডেই কৃষ্ণের পূতনা বধের কাহিনি রয়েছে মহারাজ কংসের কৃষ্ণ হত্যার পরিকল্পনাও দেখা যায় এই খণ্ডে।

২। তাম্বুলখণ্ড

এরপরে তাম্বুলখণ্ডে দেখা যায়, মথুরার হাটে দই-দুধ ইত্যাদি বিক্রি করতে এসে রাধা তার বড়াইকে হারিয়ে ফেলে। বনের মধ্যে কানাইয়ের সঙ্গে বড়াইয়ের দেখা হয় এবং তাঁকে রাধার রূপ-লাবণ্যের বর্ণনা দিয়ে রাধাকে দেখেছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করে। কৃষ্ণ রাধার সেই বর্ণনা শুনে কামাসক্ত হয়ে তাকে পাবার আশায় বড়াইয়ের হাত দিয়ে ফুলের মালা ও কর্পূর মেশানো তাম্বুল (পান) পাঠিয়ে দেয়। রাধা ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করে, বড়াইকে অপমানও করে। একথা শুনে রাধাকে পাওয়ার জন্য কৃষ্ণ পরিকল্পনা করতে থাকে।

৩। দানখণ্ড

দানখণ্ডে দেখা যায় যমুনার ঘাটে কৃষ্ণ দানী সেজে রাধার কাছ থেকে পণ্যদ্রব্য সহ তার শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য দান চেয়ে বসে। রাধার কোনো অনুনয়-বিনয় সে শোনে না, সম্পর্কে যে তারা মামী-ভাগ্নে তা বোঝালেও কৃষ্ণ রাধাকে আলিঙ্গন করার প্রস্তাব দেয়। বড়াইয়ের পরামর্শে অবশেষে রাধা কৃষ্ণের প্রস্তাবে সম্মত হয় এবং বনের মধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে তার মিলন ঘটে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

এরপর থেকেই রাধা আর আসে না মথুরার ঘাটে, তাকে না দেখতে পেয়ে কৃষ্ণ ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বড়াইকে কৃষ্ণ তার ব্যাকুলতার কথা জানায় এবং অবশেষে বড়াইয়ের পরামর্শে ষোলোশো গোপিনীর সঙ্গে রাধা আসে যমুনার ঘাটে। ঘাটে নৌকার মাঝি সেজে কৃষ্ণ এক এক করে সব গোপিনীকে পার করে দেয়, কিন্তু রাধা নৌকায় উঠলেই ছলে-বলে রাধাকে তার সমস্ত পোশাক, সমস্ত দধির হাঁড়ি জলে ফেলে দিতে বাধ্য করে কৃষ্ণ। এই নৌকাতেই কৃষ্ণ পুনরায় রাধার সঙ্গে মিলিত হয়।

৪। নৌকাখণ্ড

তাই এই খণ্ডের নাম নৌকাখণ্ড।

৫। ভারখণ্ড

এরপরে ভারখণ্ডে আমরা দেখি মথুরার হাটে প্রখর রোদে দই-দুধ বেচতে যাওয়ার সময় রাধার সামনে কৃষ্ণ আসে ভারী সেজে। রাধার দধি-দুগ্ধের পসরা কৃষ্ণ নিজের কাঁধে তুলে নেয়।

৬।ছত্রখণ্ড

ছত্রখণ্ডে রাধা আর বড়াইয়ের ছলনায় বাধ্য হয়ে কৃষ্ণ উভয়ের মাথার উপর ছাতা ধরে।

৭। বৃন্দাবনখণ্ড

এর পরে আসে বৃন্দাবনখণ্ড। বহুদিন পরে রাধা তার গোপিনীদের সঙ্গে নিয়ে মথুরার হাটে আসে, বৃন্দাবনে সেদিন বসন্ত উৎসব। এইসময় রাধার সঙ্গে দেখা করার আগেই তার ষোলোশো গোপিনীকে বিলাসে তুষ্ট করে কৃষ্ণ অবশেষে মিষ্টি মিষ্টি কথায় রাধার মানভঞ্জন করে এবং তার সঙ্গে মিলিত হয়।

৮। কালীয়দমনখণ্ড

কালীয়দমনখণ্ডের কাহিনি খুবই পরিচিত – কালীয়নাগ হত্যার পৌরাণিক কাহিনি মাত্র।

৯। বস্ত্রহরণখণ্ড

বস্ত্রহরণখন্ডে যমুনায় স্নান করতে আসা গোপিনী এবং রাধার বস্ত্র চুরি করে কৃষ্ণের সেই সব কাপড় লুকিয়ে রাখার কথা বলে।

১০। হারখণ্ড

শেষে রাধার বস্ত্র কৃষ্ণ ফিরিয়ে দিলেও বুকের হারখানা লুকিয়ে রেখেছিল, সেই হারটি পাওয়ার জন্য যশোদার কাছে কৃষ্ণের নামে অভিযোগ জানায় রাধা। যশোদাও কৃষ্ণকে তীব্র তিরস্কার করেন। এই সংক্ষিপ্ত কাহিনি হারখণ্ডের অন্তর্গত।

১১। বাণখণ্ড

বাণখণ্ডে দেখা যায় রাধাকে রুষ্ট কৃষ্ণ পুষ্পবাণ মারে এবং রাধা তাতে অজ্ঞান হয়ে যায়। পরে কৃষ্ণের স্পর্শে তার জ্ঞান ফিরে আসে। বড়াইয়ের দৌত্যে বৃন্দাবনে রাধা-কৃষ্ণের মিলন ঘটে।

কাব্যের অন্তিম দুটি খণ্ড – বংশীখণ্ড এবং রাধাবিরহ।

বংশীখণ্ডের মূল বিষয় কৃষ্ণের মোহন বাঁশির সুরে রাধার ব্যাকুল হয়ে ওঠা। বারবার সেই বাঁশি বাজিয়ে রাধাকে উচাটন করে তুলেছিল কৃষ্ণ। পরে সুযোগ বুঝে মন্ত্র বলে কৃষ্ণকে ঘুম পাড়িয়ে সেই মোহন বাঁশি রাধা চুরি করে নেয়। রাধার কাছে ক্ষমা স্বীকার এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে রাধা কৃষ্ণের বাঁশি আবার ফিরিয়ে দেয়।

‘রাধাবিরহ’ খণ্ডে চৈত্র মাসের বসন্তদিনে রাধা কৃষ্ণের অনুপস্থিতিতে বিরহী হয়ে ওঠে। বড়াই তাকে সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু বিরহ যাতনায় থাকতে না পেরে রাধা বড়াইকে নিয়ে বৃন্দাবনে এসে কৃষ্ণকে গরু চরাতে দেখে। বহুদিনের সাক্ষাতের পর কৃষ্ণকে রাধা অনেক অনুনয় করে, কিন্তু কৃষ্ণ তা সবই প্রত্যাখ্যান করে। রাধা এই সময় বারবার কৃষ্ণের সঙ্গলাভের চেষ্টা করলেও কৃষ্ণ বড়াইকে জানিয়ে দেয় যে সে আর রাধার মুখ দেখতে চায় না। কৃষ্ণ আর রাধার কাছে ফিরে আসে না। এভাবেই বিরহী রাধার হৃদয় ব্যাকুলতার মধ্য দিয়ে রাধাবিরহ খণ্ডের তথা সমগ্র ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের সমাপ্তি ঘটে।

এত বড়ো কাহিনির মধ্যে রাধা, কৃষ্ণ এবং বড়াই-এর চরিত্রগুলি লক্ষণীয়। বড়ু চণ্ডীদাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাহিনি বর্ণনার সময় নাটকের মতো সংলাপ ব্যবহার করেছেন। উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক রীতির জন্য এই কাব্য নাট্যগুণেও সমৃদ্ধ হয়েছে। তাছাড়া সাহিত্য-সমালোচকেরা মনে করেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কাহিনির মধ্যে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের খানিক প্রভাব রয়েছে। যদিও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ লেখা হয়েছে বাংলায়, আর জয়দেব তাঁর কাব্য লিখেছেন সংস্কৃতে। কাব্যের মধ্যে স্থানে স্থানে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ থেকে মূল সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন বড়ু চণ্ডীদাস।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

কাব্যের প্রতিটি খণ্ডেই দেখা যায় পদের শুরুতে বড়ু চণ্ডীদাস গানের বিশেষ বিশেষ রাগের উল্লেখ করেছেন যা থেকে অনুমান করা যায় এই কাব্য একসময় গান গাওয়া হতো সুর করে। ভাষাগত দিক বিচার করলে উপমা, প্রবাদ-প্রবচন, গীতিধর্মিতা ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে। সবথেকে বড় ব্যাপার হলো কাব্যের চরিত্র কৃষ্ণ এবং রাধা হিন্দুধর্মের দৈবী চরিত্র হলেও জন্মখণ্ডেই কেবল তাদের দৈবী পৌরাণিক কাহিনিটি বলা আছে। সমগ্র কাব্য জুড়ে তাদের যে রূপ দেখা যায়, তাতে তারা প্রকৃত রক্ত-মাংসের মানুষ হয়ে উঠেছে। কৃষ্ণ, রাধা কেউই এই কাব্যে দেব-দেবী রূপে প্রতিভাত হননি। মধ্যযুগের শুরুর দিকের রচনা বলেই হয়তো তা সম্ভব হয়েছে।

এক সময় এই কাব্য অশ্লীলতার কারণে নিষিদ্ধ হয়েছিল সমাজে। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ অশ্লীল কিনা তা বিচার করা আমাদের কাজ নয়। তাই সাহিত্যের ইতিহাস পাঠের সূত্র ধরে আমরা শুধু এটুকুই মনে রাখতে পারি, রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে এমন মানবীয় ভঙ্গিতে বড়ু চণ্ডীদাস পরবর্তীকালে বহু বৈষ্ণব পদাবলীকারদের প্রভাবিত করেছেন। পরীক্ষা পাশ করার জন্য বন্ধুরা এটাই তোমাদের কাছে যথেষ্ট। কাব্যের কিছু বৈশিষ্ট্য, আবিষ্কার ও প্রকাশকাল, আবিষ্কারকের নাম এসব অবশ্যই তোমাদের মনে রাখতে হবে আর তার সঙ্গে যদি কাহিনিটি সংক্ষেপে মনে রাখতে পারো তাহলে আরো উত্তম!

আজকের মতো এখানেই ছুটি। আপাতত পরের ক্লাসের জন্য অপেক্ষায় থাকো। দেখা হবে খুব শীঘ্রই।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → অনুবাদ সাহিত্য ধারা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_2