nun_bishoy_songkhep
Class-11

নুন কবিতার বিষয়সংক্ষেপ

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – নুন


কবি পরিচিতি

বিংশ শতাব্দীর আধুনিক কবিদের মধ্যে অন্যতম কবি জয় গোস্বামী। জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতায় তাঁর হাত ধরেই এক সুস্পষ্ট বাঁকবদল ঘটে। ১৯৫৪ সালের ১০ নভেম্বর কলকাতায় জন্ম হলেও ছোটোবেলাতেই তাঁর পরিবার নদীয়া জেলার রাণাঘাটে চলে আসে। তাঁর বাবা মধু গোস্বামী প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। তাঁর মা স্কুলে শিক্ষকতা করে সংসারের দায়িত্ব নেন। ১৩-১৪ বছর বয়সে প্রথম বাড়ির একটি পাখাকে নিয়ে কবিতা লেখেন জয়, ‘সিলিংফ্যান’ নামের সেই কবিতাটি ‘সীমান্ত সাহিত্য’, ‘পদক্ষেপ’ এবং ‘হোমশিখা’ নামক লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

ছোটোবেলা থেকে গান শোনার অভ্যাস তাঁকে কবিতার মোহে আবিষ্ট করেছিল। জয় গোস্বামী একাদশ শ্রেণি পর্যন্তই প্রথাগত পড়াশোনা করেন, তারপর আর তাঁর পড়া হয়নি। নিয়মিত কবিতা লেখা শুরু হয় তাঁর। ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হওয়ার পরে ধীরে ধীরে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’ প্রকাশ পায় ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে। মূলত সত্তরের দশক থেকে তাঁর কবিতার বইগুলি পরপর প্রকাশ পেতে থাকে এবং সাধারণ পাঠক-বোদ্ধামহলে শক্তিমান কবি হিসেবে জয় গোস্বামী পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর ‘ঘুমিয়েছ ঝাউপাতা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি ১৯৮৯ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ১৯৯৭ সালে ‘বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি খাতা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি বাংলা আকাদেমি পুরস্কার পান। ২০০০ সালে পুনরায় তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’র জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। এছাড়াও ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ কাব্যগ্রন্থ এবং ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ কাব্যোপন্যাসের জন্য তিনি দুবার আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
পরবর্তীকালে দেশ পত্রিকার দপ্তরেই তিনি সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন।

তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – ‘প্রত্নজীব’ (১৯৭৮), ‘আলেয়া হ্রদ’ (১৯৮১), ‘উন্মাদের পাঠক্রম’ (১৯৮৬), ‘ভুতুমভগবান’ (১৯৮৮), ‘ঘুমিয়েছো ঝাউপাতা?’ (১৯৮৯), ‘বজ্রবিদ্যুৎ ভর্তি খাতা’ (১৯৯৫), ‘সূর্যপোড়া ছাই’ (১৯৯৯), ‘মা নিষাদ’ (১৯৯৯), ‘পাতার পোশাক’ (১৯৯৭) ইত্যাদি।

কবিতা ছাড়াও লিখেছেন বহু উপন্যাস, কাব্যোপন্যাস ইত্যাদি। তাঁর লেখা ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ (১৯৯৮) আজও বাঙালির মুখে মুখে ফেরে। ‘হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ’, ‘সেইসব শেয়ালেরা’, ‘সাঁঝবাতির রূপকথারা’, ‘সব অন্ধকার ফুলগাছ’ ইত্যাদি তাঁর অন্যতম গদ্যরচনা। বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং কবিমনের কল্পনাবিলাসে মাখা তাঁর সব কবিতা। অদ্ভুত এক প্রেম ও নিঃসঙ্গতার মায়াজাল ছড়িয়ে থাকে জয় গোস্বামীর কবিতায়। উচ্চকিত সুরের বদলে, নিহিত কোমল খাদের স্বরে জয় গোস্বামী তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

জীবনানন্দের পরে বাংলা কাব্য জগতে এক স্পষ্ট বাঁকবদলের কাব্যভাষা নির্মাণ করে গিয়েছেন তিনি এবং এখনও করে চলেছেন। একদিকে ছন্দের বৈচিত্র্য এবং অন্যদিকে প্রতীকের ব্যবহারে অনন্য মাত্রা পায় তাঁর কবিতাগুলি। এখনও অশীতিপর কবি জয় গোস্বামী কবিতাচর্চায় নিমগ্ন।

‘নুন’ কবিতার উৎস

জয় গোস্বামীর অন্যতম কাব্যগ্রন্থ ‘ভুতুমভগবান’ থেকে আমাদের আলোচ্য ‘নুন’ কবিতাটি নেওয়া হয়েছে।

‘নুন’ কবিতার বিষয় সংক্ষেপ

‘নুন’ কবিতাটি এক নিম্নবিত্ত হতদরিদ্র পরিবারের সাধারণ ও নিত্য-নৈমিত্তিক দিনযাপনের কাহিনি। সচ্ছলতা বলতে যেখানে স্বপ্ন বোঝায় আর বাস্তব বলতে অভাব, সেই জগতের মানুষদের রোজনামচা ফুটে উঠেছে এই কবিতায়। শুধুমাত্র দুটো ভাত আর কাপড়ের সংস্থান করতে করতেই যাদের সারাটা জীবন কেটে যায় অনাদরে আর অবহেলায়, সামান্য অসুখ হলে ধারদেনা লেগে থাকে যে সংসারে এই কবিতা তাদেরই আখ্যান। কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে যাওয়ার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেয় সেই মানুষগুলো। অন্ধকারের মধ্যে আলো খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টাই তাঁদের বাঁচিয়ে রাখে। তারা জানে যে, এ জীবনে দুঃখ করে কোনো লাভ নেই। কারণ সেই দুঃখই তাঁদের জীবনে আমৃত্যু চিরসত্য হয়ে থাকবে।

সেই সত্য বা বাস্তব পাল্টাবার নয়।

আর এই অমোঘ বাস্তব থেকে পালিয়ে বাঁচতে, কঠোর সত্য থেকে নিস্তার পেতে তাঁরা খুঁজে নেয় নেশার আশ্রয়। মাদকতায় ভরা দুনিয়ায় কোনো কষ্টই আর থাকে না তাঁদের। সামাজিক সম্পর্কের প্রথাগত ধারণাকে পালটে দিয়ে বাবা-ছেলে দুজনে তখন গঞ্জিকার নেশায় দুই ভাইয়ের মতো আচরণ করে। এত অভাবের জীবনে রোজ রোজ খাওয়া জোটে না, বাজার করাও হয় না রোজ। কিন্তু যেদিন হাতে টাকা থাকে, সেদিন সেই টাকা উরিয়ে ভরে ভরে বাজার আসে ঘরে। সঙ্গে আসে গোলাপচারাও নতুন স্বপ্নের, শৌখিন স্বপ্নের পসরা নিয়ে।

বেহিসেবি জীবন আর অবিবেচনার জীবনই এই মানুষগুলির নিয়তি!

কিন্তু তবু এত অভাবের মধ্যেও তাঁদের মনে মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে যায় গোপন সৌন্দর্যবিলাস। হাতে দুটো টাকা এলে তারা গোলাপচারা কিনে বাড়ি ফেরে মধ্য রাত্রে। ঠিক থাকে না পর দিন সেই চারাটি বাঁচবে কিনা, তাতে ফুল ধরবে কিনা। এমনকি সেই চারা কোথায় লাগানো হবে তাও ঠিক থাকে না। নতুন সৃষ্টির নেশায় তাঁরা তখন উন্মাদ হয়ে ওঠে। বাড়িতে মানুষেরই থাকার জায়গা হয় না, গোলাপচারার স্থান সংকুলান কীভাবে সম্ভব সে চিন্তা করে না তাঁরা। জীবনের জটিলতা, সমাধান না হুয়া সমস্যা থেকে ক্রমশ পালাতে থাকেন তাঁরা এবং এই পলায়নের একমাত্র উপায় নেশা। সস্তার মাদকে বাস্তব জগৎ থেকে অনেক দূরে চলে যান তাঁরা। শরীর ক্রমে ভেঙে পড়তে থাকে, ধীরে ধীরে অক্ষম হয়ে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়েন তাঁরা। এই জীবনই যেন কাঙ্ক্ষিত তাঁদের কাছে।

অল্পে খুশি থাকার মধ্যে দিয়েই তাঁরা জীবনের সার্থকতা খুঁজে পায়।

ঠিকঠাক এভাবেই চলে যায় দিন, কিন্তু মাঝে মাঝে সমস্যা নেমে আসে। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে তাঁদের মুখের সামনে যখন গরম ভাতে নুনটুকুও থাকে না, তখনই ক্রোধ চেপে যায় তাঁদের মাথায়। বাবা-ছেলে দুজনে মিলেই একে অন্যের উপর রাগ বর্ষণ করতে থাকে। জীবনের সব হারানো কষ্টের মধ্যে সামান্য অবলম্বন নুনটাও না পাওয়ায় মানিয়ে নেওয়া জীবনের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে তাঁরা তখন প্রতিবাদে চিৎকার করে। এই অপ্রাপ্তির জীবন থেকে বেরিয়ে সোচ্চার দাবিতে তাঁরা জানায় ঠাণ্ডা ভাতে অন্তত নুনটুকু তাঁদের চাই। শুকনো ভারতের পাশে একটু নুন চাওয়ার এই আকাঙ্ক্ষাই ফুটে উঠেছে কবিতায়। এই কবিতা যেন সেই মানুষদের ঘোষিত ইস্তাহার।

‘নুন’ কবিতার মূল বক্তব্য

জয় গোস্বামীর ‘নুন’ কবিতাটি খেতে না পাওয়ার জীবনদর্শনের পর্দাটা উঠিয়ে আজকের ভারতের চিত্রটা আমাদের কাছে তুলে ধরে। প্রাথমিক ও আবিশ্যিক চাহিদা বলে আমরা যে ধারণাটা মাথায় বয়ে নিয়ে বেড়াই আরেকটু ভালো থাকার আশায়, তার ভ্রান্তি ও ক্লান্তির দিকগুলি এই কবিতার উপজীব্য। মাথার উপর ছাদ, পরনের কাপড় আর তিনবেলা নিশ্চিন্ত আহারের চিন্তায় আমাদের জীবন কাটে। কিন্তু এই সমাজেরই আরেক পিঠে এই সব চাহিদা কেবলই বিয়োগের রাস্তায় চলে। নিশ্চিন্ত ছাদ নেই, স্বচ্ছল জীবনযাপন নেই, অর্থের নিশ্চয়তা নেই, এমনকি ঠাণ্ডা ভাতে নুনেরও নিশ্চয়তা নেই – সব মিলিয়ে যারা আদ্যন্ত এক নেই রাজ্যের বাসিন্দা এই কবিতা তাদেরই কথা বলে। কথায় বলে, পেটে খেলে, তবে পিঠে সয়।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

পেটে আসমুদ্র ক্ষুধা নিয়ে রাজার মার সহ্য করা যায় না। তখন সব পূর্ণিমার চাঁদকেই ঝলসানো রুটি মনে হয়, মনে হয় আর সেই রুটির খোঁজেই জীবন চলে যায় মৃত্যুর পারে। এ এমন এক জীবন যেখানে জীবনই নেই, শুধু কিছু টিকে থাকার মুহূর্ত আছে। জয় গোস্বামী খুব রূঢ়ভাবে আমাদের সামনে সেই মানুষদের ছবি তুলে ধরেছেন। শিক্ষা, চাকরি ইত্যাদির বদলে যে মানুষদের দাবি শুধুমাত্র ঠাণ্ডা ভাতে নুনের নিশ্চয়তা, তারাও এই সমাজ-রাষ্ট্রেরই অঙ্গ। জীবনসংগ্রামের সহজাত খেলায় যারা বাদ পড়তে পড়তে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর মতোই হয়তো বা একদিন মিলিয়ে যাবে, কিন্তু মিসিং লিঙ্ক হয়ে থেকে যাবে তাঁদের পেটের ‘ভুখ্‌’ আর মরমের দুখ।
পর্ব সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_Nun_1