Onubader-sahityer-dhara
Class-11

অনুবাদ সাহিত্য ধারা | মধ্যযুগের বাংলার সমাজ সাহিত্য

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)


এর আগে মধ্যযুগের বাংলার সমাজ সাহিত্য (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন) সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা অনুবাদ সাহিত্য ধারা সম্পর্কে আলোচনা করবো।

বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসে তুর্কি আক্রমণ এক যুগান্তকারী ঘটনা। তুর্কি আক্রমণ কিরূপ প্রভাব ফেলেছিল বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে তা তোমরা আগের ক্লাসে পড়েছো। আজকে আমরা যে আলোচনা করবো। অনুবাদ সাহিত্যের ধারাটি কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে ওই তুর্কি আক্রমণের প্রভাবেই।

শুনে অবাক হচ্ছো তো!

কিন্তু সত্যিই তাই। তুর্কি আক্রমণ বাংলার জাত-পাতের বিভেদে মোড়া হিন্দু সমাজকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। হিন্দু সমাজ তাই এক পুনর্জাগরণের পথ খুঁজছিল তার সাহিত্যে যে উপায়ে আবার সকল বাঙালি হিন্দুকে এক সূত্রে গ্রথিত করা যায় – ভাবের ঐক্য, মানসিক ঐক্য গড়ে তোলা যায়। কারণ বাঙালি সেদিন বুঝেছিল নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতি না থাকলে এমন বিদেশি শক্তির আক্রমণে বারবার বিধ্বস্ত হতে পারে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি। বর্ণাশ্রমের হিন্দু সমাজে যেখানে ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কারো বেদপাঠ কিংবা সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার অধিকার ছিল না, সেখানে সংস্কৃত কাব্য, মহাকাব্যগুলিকে বাংলায় অনুবাদ করে তা সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলার চেষ্টা করা হলো সেই প্রথম।

হিন্দু বাঙালির কাছে পুরাণ, ভাগবত ইত্যাদির সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ছিল আর বাঙালি কবিরা এর আশ্রয়েই জটিল সংস্কৃত ভাষার বদলে বাংলায় সৃষ্টি করলেন অনুবাদ কাব্য।

তবে অনুবাদ বলতে আমরা যেমন অক্ষর ধরে ধরে অনুবাদ বা ‘ট্রান্সলেশন’কে বুঝি, এই অনুবাদগুলি কিন্তু তেমন ছিল না। ইংরেজি পরিভাষা ধার করলে বলা যায় মধ্যযুগের এই সাহিত্যকর্মগুলো ‘ট্রান্সলেশন’ নয়, বরং খানিকটা ‘অ্যাডাপ্টেশন’-এর উদাহরণ। অর্থাৎ এই পুরাণাশ্রিত সাহিত্যগুলি পুরোপুরি অনুবাদ নয়, অনেকাংশেই অনুসরণের উদাহরণ।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

ষোড়শ শতকের বাংলায় ভক্তিরসকে কেন্দ্র করে পরপর এই ধরনের সাহিত্য রচিত হলো। প্রশ্ন হল এই, অনুবাদ সাহিত্য যে বলা হচ্ছে তা কিসের অনুবাদ হয়েছিল? অনুবাদ হয়েছিল মূলত তিনটি বৃহৎ সাহিত্যিক নিদর্শনের – রামায়ণ, মহাভারত এবং ভাগবত। সংস্কৃতে লেখা এই তিনটি সাহিত্যই হিন্দুসমাজের আধ্যাত্মিক স্তম্ভ বলা চলে।

রামায়ণ, মহাভারত হিন্দুদের মহাকাব্য হিসেবে স্বীকৃত,এই দুটি ভারতের আদি মহাকাব্য।

বৈষ্ণবধর্ম ও সাহিত্যে ভাগবতের এক বিরাট অবদান আছে। রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনি তো তোমরা সেই ছোটোবেলা থেকেই শুনে আসছো। তাও যেন শেষ হয় না। ভাগবতের পরিচিতি তুলনায় একটু কম। এই ভাগবত কিন্তু শ্রীমদ্‌ভাগবত গীতা নয়, ভাগবতের কাহিনি গড়ে উঠেছে শ্রীকৃষ্ণকে ঘিরে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

এখন তোমরা প্রশ্ন করতেই পারো, এত এত সংস্কৃত সাহিত্য থাকতে শুধুমাত্র এই তিনটিকেই বেছে নেওয়া হল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে বন্ধুরা তোমাদের একটু ইতিহাসটা জেনে নিতে হবে। পাল রাজবংশের সময়ে বাংলায় বৌদ্ধদের এক বিশাল প্রভাব গড়ে উঠেছিল, হিন্দুদের আধিপত্য কমে আসছিল। কিন্তু আবার সেন রাজবংশের শাসনকালে হিন্দু প্রভাব বাড়তে শুরু করে। রাজারা নিজেও সেই সময়ে কুলীন হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিলেন। তুর্কি আক্রমণের পরে বৌদ্ধদের প্রভাব, প্রতিপত্তি রুখতে হিন্দুসমাজ তৎপর হয়ে উঠেছিল।

অন্যদিকে আবার বাংলার ইসলামি শাসকেরা, সুলতানেরা হিন্দু কবিদের কাছ থেকে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের কাহিনি শুনতে আগ্রহী হয়ে পড়েন। সেই সুলতানি শাসনের অনুপ্রেরণাতেই হিন্দু বাঙালি কবিরা এইসব সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ করতে শুরু করেন। এই অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের এক অসাম্প্রদায়িক রূপ ভেসে ওঠে। আসলে রামায়ণ, মহাভারত কিংবা ভাগবত যাই হোক না কেন প্রতিটি সাহিত্যেই ভারতীয় সমাজের তথা হিন্দু সমাজের এক বৃহত্তর রূপ ফুটে ওঠে। তাই এইসব সংস্কৃত সাহিত্যগুলি চিরকালীন।

তোমরা শুনে অবাক হবে চট্টগ্রামের শাসনকর্তার পরাগল খাঁ এবং তার পুত্র ছুটি খাঁ তাদের হিন্দু সভাকবিদের দিয়ে মহাভারত অনুবাদ করিয়েছিলেন। আবার বিখ্যাত কবি মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য লেখার জন্য ‘গুণরাজ খান’ উপাধি পেয়েছিলেন।

তাহলে তোমরা আশা করি বুঝতে পারছো, মধ্যযুগের সাহিত্যের মধ্যে এই অনুবাদ সাহিত্যধারার গুরুত্ব ও প্রভাব ঠিক কতটা! দেখো আগেই বলেছি

মূলত রামায়ণ, মহাভারত আর ভাগবতের অনুবাদ হয়েছিল এই সময়।

এখন একজন-দুজন তো আর অনুবাদ করেননি। বহু কবি নানা সময়ে নানাভাবে এই সাহিত্যগুলির অনুবাদ করেছেন। সবার অনুবাদ সম্পর্কে তো আর জানা সম্ভব নয়, বলা ভালো এই পরিসরে জানাটাও অপ্রয়োজনীয়। তাই কৌশল করে আমরা শুধু প্রত্যেক ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ কবির সম্পর্কে বিশদে জানবো, তার পাশাপাশি অন্যান্য অনুবাদ কর্মগুলির ব্যাপারে শুধু তথ্যের উল্লেখ করবো। পরীক্ষায় তো আবার তোমাদের mcq পড়তে হবে তোমাদের, তাই সেই জন্য এই তথ্যগুলি শুধু মনে রাখলেই চলবে।

আমরা মূলত যা জানবো তা হল –
· রামায়ণের শ্রেষ্ঠ অনুবাদ – কৃত্তিবাস ওঝার ‘শ্রীরাম পাঁচালী’
· মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদ – কাশীরাম দাসের ‘ভারত পাঁচালী’
· ভাগবতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদ – মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

একে একে আমরা এই অনুবাদ ও অনুবাদকদের সম্পর্কে পরবর্তী পর্ব গুলিতে জেনে নেবো। তবে তার আগে তোমাদের একটা কাঠামো অবশ্যই অনুসরণ করার কথা বলবো এই অনুবাদ সাহিত্য পড়ার ক্ষেত্রে। এখানে গল্পের মতো বোঝার জায়গা কম, তাই পয়েন্ট ধরে ধরে পুরো আলোচনাটাকে আমরা ভাগ করে নেবো। যেমন, প্রতিটি অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রধানত তিনটি পয়েন্ট আলোচনায় থাকবে –

১) অনুবাদকের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও কবি প্রতিভা
২) অনুবাদকর্মটির সংক্ষিপ্ত পরিচয়
৩) সেই অনুবাদের জনপ্রিয়তার কারণ
পরবর্তী পর্বগুলিতে এই ভাবে আলোচনা চলতে থাকবে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → রামায়ণের অনুবাদ 

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_3