suyejkhale-hangor-shikar-bishode-alocona
Class-11

সুয়েজখালে : হাঙর শিকার | বিশদে আলোচনা

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – সুয়েজখালে : হাঙর শিকার (বিশদে আলোচনা)

এর আগে সুয়েজখালে : হাঙর শিকার গল্পের সারসংক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা সুয়েজখালে : হাঙর শিকার গল্পটি সম্পর্কে বিশদে আলোচনা করবো।

স্বামী বিবেকানন্দের লেখা এই ‘সুয়েজখালে : হাঙর শিকার’ প্রবন্ধটি বাংলা সাহিত্যের হাস্যরসাত্মক ধারার একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য রচনা। এই নতুন ধারার সাহিত্যটি স্বামী বিবেকানন্দ তৈরি করলেন ভ্রমণ বিবরণ এবং রম্যরচনার গুণান্বিত একটি নূতন ধরণের নিবন্ধ।

জাহাজের ডেকে হাঙর শিকারে অতি-উৎসাহী মেজর জেনারেলের বর্ণনায় স্বামীজি লিখছেন ‘কুয়োর ঘটি তোলার ঠাকুরদাদা’ অর্থাৎ যে সব কাজেই আগে আগে এগিয়ে যায়। আবার সমুদ্রের জলের মধ্যে বড়শির টোপে থাকা শুয়োরের মাংসের খণ্ডটি দেখে লেখকের মনে হয়েছে সেটি যেন ‘গোপীমণ্ডলমধ্যস্থ কৃষ্ণের ন্যায় দোল খাচ্ছে’ অর্থাৎ যেভাবে বৃন্দাবনে অভিসারের পর সঙ্কেতকুঞ্জে সহস্র গোপিনীদের মাঝে রাধা ও কৃষ্ণ একই ঝুলনায় দোল খেয়েছিলেন, ঠিক সেভাবেই মাংসখণ্ডটি দুলছে।

এ এক অসমঞ্জস্য অকল্পনীয় উপমা। দুটি হাঙরকে লেখক ‘বাঘা’ এবং ‘থ্যাবড়া’ নামে চিহ্নিত করেছেন যা হাস্যরসের উদ্রেক ঘটায়। হাঙর-শিকারের ঘটনা এবং জাহাজের লোকজন ও পরিবেশের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক যা থেকে স্পষ্টই অনুমিত হয় তাঁর পর্যবেক্ষণ শক্তি কত প্রখর! সবথেকে বড়ো বিপ্লব ঘটিয়েছেন লেখক ভাষাশৈলীর ক্ষেত্রে। স্বামী বিবেকানন্দ নিজেও মনে করতেন যে মানুষের কথ্য ভাষাতেই সাহিত্য রচিত হওয়া উচিত। তাঁর অনেক পরে প্রমথ চৌধুরী এই একই কাজ করে খ্যাত হন তাঁর ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে।

একদিকে তৎসম শব্দের ব্যবহার করেছেন তিনি, আবার অন্যদিকে কলকাতার ইংরেজি বুলিরও প্রয়োগ ঘটেছে এই নিবন্ধে। ‘ন্যাটা’, ‘আলটপকা’, ‘চিপসে’, ‘চোচা দৌড়’ ইত্যাদি বহু দেশি শব্দের প্রয়োগ এই রচনাটিকে একইসঙ্গে প্রাণবন্ত ও হাস্যচপল করে তুলেছে। যেন একটা মজলিশি ঢঙে সম্পূর্ণ নিবন্ধটি রচনা করেছেন লেখক।

হাঙর শিকারকে কেন্দ্র করে লেখা স্বামী বিবেকানন্দের অভিজ্ঞতা পরিস্ফূট হয়েছে এই নিবন্ধে। এই হাঙর শিকারের ঘটনাটা পুরোটাই ঘটেছে সুয়েজ খালে। সেই সময় সমগ্র বিশ্বজুড়ে প্লেগ রোগ মহামারী আকার নিয়েছে। ছোঁয়াচে এই রোগের প্রকোপ থেকে বাঁচতে লেখকদের জাহাজ যখন সুয়েজ বন্দরে পৌঁছালো, সেই সময় মিশরীয় কর্মীদের সঙ্গে জাহাজ বা জাহাজের খালাসিদের যাতে কোনো সংস্পর্শ না ঘটে সে ব্যাপারে সকলের মধ্যেই একটা আতঙ্ক লক্ষ্য করা গেল।

লেখক সেই ছোঁয়াছুঁয়ির ঘনঘটাকে ভারতীয় জাত-পাত, বর্ণবৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার থেকেও বেশি কিছু বলে মনে করেছেন। লেখক লক্ষ করেছেন যে সুয়েজ বন্দরে জাহাজকে প্লেগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে নানানবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কোম্পানির এজেন্টদের জাহাজে ওঠার অনুমতি পর্যন্ত ছিল না। লেখক জানতেন যে, প্লেগ রোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশ করলে দশ দিনের মধ্যেই তার লক্ষণ প্রকাশ পায়।

লেখকদের ইতিমধ্যে জাহাজে দশ দিন অতিক্রান্ত আর এই প্রসঙ্গেই তিনি লেখেন,
‘আমাদের কিন্তু দশদিন হয়ে গেছে – ফাঁড়া কেটে গেছে।’

এই জাহাজটি সুয়েজ খালে প্রায় দেড় দিন আটকে ছিল। লোহিত সাগর পার করে ১৪ জুলাই তারিখে জাহাজটি সুয়েজ বন্দরে নামে মাল নামাবার জন্য। রাত্রে সেই বন্দর ছেড়ে জাহাজ চলে যেতে পারতো অনায়াসেই। কিন্তু সমস্যা হল রাত্রে জাহাজ চলার জন্য জাহাজে বৈদ্যুতিক আলো লাগাতে হবে, প্লেগ রোগের সংক্রমণের ভয়ে সেই আলো কেউই লাগাতে চাইবে না। এমনকি মিশরীয় কোনো ব্যক্তিরই তখন জাহাজ ছোঁয়ার অনুমতি ছিল না। জাহাজের যাত্রী এবং বন্দরের লোকজন উভয়পক্ষেই ছিল ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়। প্লেগ রোগের জীবাণু যাতে কারো শরীরে ঢুকে না পড়ে সেই জন্যেই আর জাহাজে আলো লাগানো হয় না আর তাই লেখক লিখছেন –

‘কাজেই রাতেও যাওয়া হবে না, চব্বিশ ঘন্টা এইখানে পড়ে থাকো…।’

সুয়েজ বন্দর ছিল ইউরোপের প্রবেশদ্বার আর তাই প্লেগ রোগের জীবাণু থেকে লেখকদের জাহাজকে বাধ্যতামূলকভাবে গা বাঁচিয়ে তবেই ইউরোপে প্রবেশ করার অনুমোদন পাওয়া যেতো। জাহাজ জুড়ে চলছিল এক কঠোর ছুঁৎমার্গের নিয়ম-কানুন। সংক্রমণের আশঙ্কায় সুয়েজ বন্দরের লোকেদের বদলে জাহাজের কুলিদেরকেই বাধ্য হয়ে মাল ওঠানো-নামানোর কাজ করতে হচ্ছে। এই কুলিরাই মাল বয়ে নিয়ে এসে ক্রেনে করে তুলে দিচ্ছিল এবং বন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা নৌকায় আলগোছে সেই মাল ফেলে দিচ্ছিল। এ প্রসঙ্গেই লেখক বলছেন –

‘স্বর্গে ইঁদুর-বাহন প্লেগ পাছে ওঠে, তাই এত আয়োজন।’

‘স্বর্গ’ বলতে আসলে এখানে ইউরোপ মহাদেশকেই বোঝানো হয়েছে। এই শব্দ-প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি লেখকের এক লঘু বিদ্রুপের আঁচ পাওয়া যায়। এই রকম সূক্ষ্ম বুদ্ধিদীপ্ত শব্দপ্রয়োগ এই রচনার সর্বত্রই কম-বেশি ছড়িয়ে আছে যা নিবন্ধটিকে আরো উপভোগ্য করে তুলেছে। এত আশঙ্কা, এত সুরক্ষা ও সাবধানতা অবলম্বনের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয় যে যদি কোনোভাবে জাহাজের লোকেদের সঙ্গে বন্দরের লোকেরদের সংস্পর্শ ঘটে তাহলে নেপলস্‌ বা মার্সাই কোনো বন্দরেই আর যাত্রীদের নামানো হবে না।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ইতালি এবং ফ্রান্সের বিখ্যাত দুটি বন্দর যথাক্রমে নেপল্‌স এবং মার্সাই। সুয়েজ বন্দরের লোকেদের লেখক আখ্যা দিয়েছেন ‘মিসরি আদমি’ বলে যার অর্থ হল মিশরীয় মানুষ। এদের ছুঁলেই দশ দিন আটক থাকতে হবে জাহাজে – লেখকের ভাষায় ‘দশদিন কাঁরাটীন’। সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন সকলের সংস্পর্শ ত্যাগ করে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে একটি কুঠুরিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখেন যাতে অন্যেরা কেউ সংক্রামিত না হয়, সেই অবস্থাকে বলা হয় কাঁরাটীন যাকে ইংরেজিতে বলে কোয়ারেন্টাইন।

সুয়েজ বন্দরে জাহাজ আটক থাকাকালীনই দিনের আলোয় হাঙর শিকারের রোমাঞ্চকর ঘটনার সাক্ষী হন লেখক। সুয়েজ খাল আর অস্ট্রেলিয়া এই দুই জায়গাকে বলা হয় হাঙরদের স্বর্গরাজ্য। প্রচুর হাঙর ঘুরে বেড়ায় এখানকার সমুদ্রে। এরকমই একটি হাঙর জাহাজের চারপাশে ঘুরতে দেখা যায়। আর হাঙর দেখামাত্রই জাহাজের লোকদের মধ্যে উদ্দীপনা দেখা দেয়। হাঙর দেখার আনন্দে এবং হাঙর শিকারের নেশায় সকলে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ঠিক হয়, বড়শিতে টোপ বেঁধে হাঙর ধরার জন্য তা সমুদ্রে ফেলা হবে এবং হাঙর সেই টোপের শুকরের মাংসখণ্ডটা গিলে নেওয়ার পরেই দড়ি ধরে সকলে মিলে বেদম টান মারবে।

প্রথম হাঙর এই টানাটানিতে টোপ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও দ্বিতীয় হাঙর অর্থাৎ যাকে লেখক ‘থ্যাবড়া’ বলেছেন, সে সেই টোপ গিলে নেওয়ায় তার ঠোঁট এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় আর সকলের টানাটানিতে সেই হাঙর একসময় উঠে আসে জাহাজের ডেকে। এই হাঙরের সামনে, পিছনে, আশেপাশে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ছোটো ছোটো বিশেষ এক ধরনের মাছকে। লেখকের মনে হয় –

‘…বুঝি উনি হাঙরের বাচ্চা।’

এই হাঙরের বাচ্চা আসলে বনিটো মাছ যারা হাঙরের আগে আগে যায় এবং হাঙরকে পথ দেখায়। হাঙরের গায়ে মাথায় বুকে লেপ্টে থাকে এই মাছগুলি। এদের একপ্রকার বিশেষ ধরনের চোষক-যন্ত্র থাকে। এই বনিটো মাছ শুঁটকি হিসেবে মালদ্বীপ থেকে রপ্তানি করা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানেন যে এই মাছ গাঢ় লাল রঙের মাংস সমৃদ্ধ এবং খুবই সুস্বাদু।

এই বনিটো মাছের পাশাপশি আরেক প্রকার মাছ দেখতে পান তিনি যাকে বলা হয় আড়কাটী মাছ অর্থাৎ পাইলট ফিশ। এই ধরনের মাছগুলি আসলে হাঙরকে প্রকৃত খাদ্যের সন্ধান দেয় এবং তার বিনিময়ে সেই খাদ্যের অংশ বিশেষ খেতে পায় হাঙরের বদান্যতায়। এই আড়কাটী মাছের প্রসঙ্গে লেখক এক অভূতপূর্ব পৌরাণিক উপমার ব্যবহার করেছেন –

‘আগে যান ভগীরথ শঙ্খ বাজাইয়ে, পাছু পাছু যান গঙ্গা…’

ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন বৃত্তান্ত আমরা কমবেশি সকলেই পুরাণের কাহিনিতে পড়েছি। ইক্ষ্বাকু বংশের সগর রাজার পঞ্চম বংশধর ছিলেন রাজা ভগীরথ। কপিলমুনির অভিশাপে যখন সগর রাজার ষাট হাজার সন্তান ভস্মীভূত হয়ে যান, তখন সেই সন্তানদের উদ্ধারের জন্য ভগীরথ কঠোর তপস্যা করে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেন। এর ফলে ভগীরথের প্রার্থনায় মহাদেবকে গঙ্গাকে নিজ মস্তকে ধারণ করেন এবং সেখান থেকে সাতটি ধারায় গঙ্গা মর্ত্যে নেমে আসেন। এর মধ্যে একটি ধারাকে ভগীরথ পথ দেখিয়ে নিয়ে আসেন।

গঙ্গার স্পর্শে অভিশপ্ত সগর রাজার সন্তানেরা মুক্তি পায়। এই কারণে গঙ্গার একটি শাখা নদীর নাম ভাগীরথী। এই পৌরাণিক ঘটনার সঙ্গে লেখক মিশিয়ে দিয়েছেন আড়কাটী মাছের হাঙরকে পথ দেখিয়ে আনার প্রসঙ্গকে। লেখকের মননে গঙ্গার আগে আগে চলা ভগীরথের মতোই আড়কাটী মাছগুলিও যেন হাঙরের আগে আগে থেকে তাকে শিকার দেখিয়ে দিতে সাহায্য করে। আর এই সমগ্র কাণ্ড-কারখানায় লেখকের বয়ানে আমরা জানতে পারি-

‘সেকেণ্ড কেলাসের লোকগুলির বড়োই উৎসাহ।’

এই দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীদের হুজুগ আর উৎসাহ একটু বেশিই ছিল আর এদের মধ্যেই একজন দুঃসাহসী, অকুতোভয় ফৌজি ছিলেন। এই ফৌজি সবেতেই একটু বেশিই অগ্রণী। তিনিই কোথা থেকে একটা বড়শি সংগ্রহ করেছিলেন, আবার হাঙরকে টেনে ডেকে ওঠানো হলে সেটির মাথায় কড়িকাঠের বাড়ি মেরে নিশ্চিতভাবে মেরে ফেলেছিলেন।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল

হাঙর শিকারের সময় ফৌজির এই কাজের মধ্যে নিষ্ঠুরতা থাকলেও জাহাজের সকলের অতি উৎসাহে এই নিষ্ঠুরতা চাপা পড়ে যায়। হাঙর শিকার তখন একটা উৎসবের চেহারা নিয়েছিল জাহাজে। তবে প্রথম হাঙরটি অর্থাৎ ‘বাঘা’র ক্ষেত্রে এমনটা করা যায়নি। অনেক অনেক অপেক্ষার পরে প্রথম টোপ গিলেছিল এই বাঘা। তার আসার আগে যাত্রীদের অপেক্ষমান অবস্থার বর্ণনা দিতে স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীতে লেখেন –

‘সচকিত নয়নং পশ্যতি তব পন্থানং’

অর্থাৎ তোমার আসার পথ চেয়ে সচকিত হয়ে বসে আছি। এই তোমার আসলে সকলের আকাঙ্ক্ষিত হাঙর। আর যখন এই হাঙরের জন্য প্রথমবার বড়শিতে টোপ গেঁথে ফেলা হয়, তখন তা আরেকটু দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে সুয়েজ খালে থাকা মালবাহী নৌকার মাঝিকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে জাহাজের যাত্রীরা। আর তখন –

‘হাঁকাহাঁকির চোটে আরব মিঞা চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালেন।’

এই আরব মিঞা হলেন নৌকোয় থাকা জল-পুলিশের এক চৌকিদার। জাহাজের যাত্রীদের সঙ্গে যাতে সুয়েজ বন্দরের লোকেদের কোনো ছোঁয়াছুঁয়ি না হয় এই চৌকিদার সেটাই লক্ষ্য রাখছিলেন। যাত্রীদের হাঁকাহাঁকিতে ঘুম ভেঙে গেলে তিনি নিবিষ্টচিত্তে একটা গাছের ডাল দিয়ে সেই ফাতনাটাকে জলে খানিক দূরে সরিয়ে দেন। আর এরপরেই কালো ডোরাকাটা ‘বাঘা’র টোপ গেলা এবং অবশেষে পালিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গের এক রম্য বর্ণা দিয়েছেন লেখক।

টোপ লক্ষ্য করে ‘বাঘা’ এগিয়ে আসে জাহাজের দিকে এবং দুই-তিনবার ঘুরে চলে গেলেও শেষবার সে টোপ গেলে আর ঠিক সেই মুহূর্তেই জাহাজের যাত্রীরা দড়ি ধরে টানাটানি শুরু করায় বাঘা টোপটা ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। হাঙর যখন পালিয়েই গেল তখন লেখক আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন –

‘গতস্য শোচনা নাস্তি।’

অর্থাৎ যা চলে গেছে বা যা হয়ে গেছে তা নিয়ে শোক কোরো না। এ এক প্রাচীন প্রবাদ। কিন্তু কী অবলীলায়, কী অনবদ্য মুন্সিয়ানায় লেখক এই বাক্যবন্ধ ব্যবহার করলেন এই প্রসঙ্গে। আড়কাটী মাছ হাঙরকে পথ দেখিয়ে শিকারের কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু বাঘাকে শিকারের নয়, বরং শিকারীর কাছে নিয়ে আসার জন্য লেখকের কল্পনায় নিশ্চিতভাবে বাঘা সেই পাইলট ফিশদের উচিত শিক্ষা দিয়েছে। বাঘা আর থ্যাবড়া এই দুই হাঙরকে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ এই নিবন্ধে এক অসাধারণ কাল্পনিক কথোপকথনের অবতারণা করেছেন যা সমাজের বাঙালির চরিত্রকেই ব্যঞ্জিত করে তোলে পরোক্ষে।

বাঘা নামের হাঙরটি যখন টোপ গিলেও পালিয়ে যাচ্ছিল, তখনই তার গা ঘেঁষেই এগিয়ে আসে আরেকটি হাঙর – ‘থ্যাবড়া’। লেখক এই সময় কৌতুকমিশ্রিত স্বরে বলেন যে হাঙরদের যদি ভাষা থাকতো এবং সেই ভাষায় যদি জলের মধ্যেও কথা বলা সম্ভব হতো তাহলে নির্ঘাত থ্যাবড়াকে বাঘা সেই শিকারীদের কথাটা আগে থেকে জানিয়ে সতর্ক করে দিতো। বাঘা এই সময় হয়তো থ্যাবড়াকে সুপ্রাচীন অভিজ্ঞতা থেকে বলতো যে জাহাজের কাছে নতুন প্রাণীটার মাংসটা সুস্বাদু হলেও হাড় খুবই শক্ত।

এতদিন ধরে সে এতরকম প্রাণী খেয়েছে, এমনকি ইঁট-পাথরও খেয়ে হজম করেছে, কিন্তু এই প্রাণীটির হাড় তার পক্ষে চিবোনো খুবই দুষ্কর। আসলে সেই হাড় আর কিছুই নয়, বড়শিতে বাঁধা ফাতনা সদৃশ কাঠের টুকরো। এই কথা শুনে লেখকের কল্পনায় থ্যাবড়া হয়তো বা বাঘাকে এই শক্ত হাড় চিবোনোর ব্যথা কমাতে চ্যাং মাছের পিত্ত, কুঁজো ভেটকি মাছের প্লিহা কিংবা ঝিনুকের ঠাণ্ডা সুরুয়া ইত্যাদি খেতে পরামর্শ দিতো। পারস্পরিক এই কাল্পনিক কথোপকথনের প্রয়োগে লেখকের সাহিত্যিক চিন্তা এবং ভাষাতাত্ত্বিক দক্ষতাই ফুটে ওঠে। এখন এইরকম ঘটনা যখন ঘটেনি, তখন লেখকের দুই রকম ধারণা হল। প্রথমত হতে পারে, হাঙরদের ভাষা নেই আর দ্বিতীয়ত লেখকের মনে হল হয়তো বা বাঘা মানুষদের সঙ্গে থেকে থেকে মানুষের মতো স্বভাব অর্জন করেছে। সে ভেবেছে আমি ঠকেছি বলে, থ্যাবড়াও ঠকুক। তাকে আলাদা করে তাই কিছুই বলেনি বাঘা। এই বিবরণের মধ্য দিয়ে স্পষ্টই বোঝা যায় মানবচরিত্রের খলস্বভাবকে স্বামী বিবেকানন্দ তীব্র-তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্রুপ করেছেন।

আর এই প্রসঙ্গে লেখক এই নিবন্ধে লেখেন –
‘অথবা ‘বাঘা’ মানুষ-ঘেঁষা হয়ে মানুষের ধাত পেয়েছে,…’
হাঙর শিকারের বর্ণনা শেষ হলে লেখক এই নিবন্ধের অন্তিম লগ্নে এসে ভারতের মাহাত্ম্য বর্ণনার দিকে মনোনিবেশ করেন। ‘পরিব্রাজক’ গ্রন্থের অন্যান্য রচনার মতোই এই নিবন্ধেও ভারতের প্রসঙ্গ এসেছে অনিবার্যভাবে। ইউরোপ সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ঐশ্বর্যের মূলে রয়েছে ভারতের অবদান তা সোচ্চারে ঘোষণা করেন লেখক। বহু বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষ প্রাকৃতিক সম্পদ ও শিল্প-সম্পদে পরিপূর্ণ ছিল এবং পৃথিবীর বহু দেশই সে সময় ভারতের সম্পদ লুঠ করেছে।

ভারত ছিল সেরা মশলা উৎপাদনকারী দেশ যেখান থেকে বিদেশি বণিকরা মশলা রপ্তানি করতো তাদের নিজেদের দেশে। <>সমগ্র বিশ্বে সেরা সুতির কাপড় একসময় ভারতেই পাওয়া যেতো। ইংল্যাণ্ডে শিল্পবিপ্লব হওয়ায় এবং সেই বিপ্লবের ফলে নতুন যন্ত্রচালিত তাঁতের কাপড়কে ভারতের বাজারে বিক্রয়যোগ্য করার জন্য ব্রিটিশদের ঘৃণ্য অত্যাচার, বাংলার তাঁত শিল্পের ধ্বংস সবই আমরা ইতিহাসে জেনেছি। কিন্তু সবথেকে বড়ো সমস্যা হল –

‘এ কথা ইউরোপীয়েরা স্বীকার করতে চায় না।’

একসময় ভারতের সমৃদ্ধির উপরেই যে আজকের দিনের উন্নত দেশগুলির সমৃদ্ধি নির্ভরশীল ছিল তা ইউরোপীয়েরা বিশ্বাস করতে চায় না। প্রাচীনকালে ইরান, গ্রিস, ব্যাবিলন, রোম, পারস্য ইত্যাদি দেশের মতো বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশগুলিও ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য ভারতে আসার নতুন নতুন জলপথ আবিষ্কারের চেষ্টায় মেতে থাকতো।

ওলন্দাজ, দিনেমার, ফরাসি, ইংরেজরা একে একে ভারতে এসেছে আর যথেচ্ছভাবে ভারতের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে গেছে। আর আজ ইউরোপীয়রাই বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তুলো, পাট, রেশম, নীল, বিভিন্ন রত্ন, হীরে, মশলা ইত্যাদির জন্যেও আজ ইউরোপীয়রা ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন না। কারণ ভারতের মতো নেটিভ দেশের কাছে ঋণ স্বীকার করলে যদি তাদের দেশীয় সম্পদের দীনতা ধরা পড়ে যায়, তাই অতিরিক্ত অহমিকা বা ভ্রান্ত গর্বের কারণে ইউরোপীয়রা এ কথা স্বীকার করতে চায় না।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

সবশেষে স্বামী বিবেকানন্দের ‘শূদ্র জাগরণ’ লেখাটির মতো ভারতের শ্রমজীবী সম্প্রদায়ের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। চিরকাল যারা কাজ করে মাঠে মাঠে বন্দরে, তাদের পরিশ্রমের ফল অন্যরা ভোগ করে আর তারা থাকে অন্ধকারে। তাই আজ সেইসব ভারতীয় শ্রমজীবীদের উত্থানের দিন এসেছে। চিরপদদলিত, মনুষ্যসমাজের ভারবাহী এই শ্রমজীবী সম্প্রদায়কে লেখক এই নিবন্ধে আন্তরিক প্রণাম জানিয়েছেন। ভারতের যুগ বদলের ধারক, নতুন দিনের নেতা আসবে এই শ্রমজীবীদের মধ্য থেকেই এমনটাই লেখকের বিশ্বাস।

পরবর্তী পর্ব → নুন কবিতার আলোচনা

এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XI-Beng-Suyejkhale-Hangor-Shikar-2