ke-bacay-ke-bace-1
Class-12

কে বাঁচায়, কে বাঁচে গল্পের সারসংক্ষেপ

বাংলাদ্বাদশ শ্রেণি – কে বাঁচায়, কে বাঁচে

কে বাঁচায়, কে বাঁচে-এর লেখক পরিচিতি

১৯০৮ সালের ২৯ মে তৎকালীন বিহারের দুমকায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। তাঁর আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বাবার নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম নীরজাসুন্দরী দেবী। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে বাংলা ও বিহারের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁর বাল্য ও কৈশোরের দিনগুলি কেটেছে। ১৯২৬ সালে মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি।

তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে সাম্মানিক সহ তিনি ভর্তি হন বিএসসি পড়তে। কিন্তু স্নাতক স্তরে পড়তে পড়তেই সাহিত্য-সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়া শেষ করতে পারেননি মানিক। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়েই বন্ধুদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে একজন অনামি লেখক হয়েও নামকরা পত্রিকায় লেখা ছাপানোর বাজি লড়েন মানিক। মানিক তাঁর বন্ধুদের বলেছিলেন তিন মাসের মধ্যেই এই কথা তিনি প্রমাণ করে দেখাবেন।

সেই সময়েই ‘অতসী মামী’ নামের একটি গল্প লিখে ফেলেন মানিক আর তা সেকালের অতি বিখ্যাত বিচিত্রা পত্রিকায় ছাপাও হয়ে যায়। এই গল্প প্রকাশের পর থেকেই বহু পত্র-পত্রিকা থেকে তাঁর কাছে লেখার আহ্বান আসতে থাকে। এরপরে ১৯৩৭ সালে ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে বেশ কিছুদিন কাজ করলেও সেই চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। সারা জীবন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়েই তাঁর জীবন কেটেছে।

তাঁর লেখা অন্যতম বিখ্যাত উপন্যাসগুলি হল – ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, ‘জননী’, ‘দিবারাত্রির কাব্য’, ‘চতুষ্কোণ’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘স্বাধীনতার স্বাদ’ ইত্যাদি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গল্পগুলির মধ্যে ‘প্রাগৈতিহাসিক’, ‘সরীসৃপ’, ‘ছোটো বকুলপুরের যাত্রী’, ‘হারানের নাতজামাই’, ‘আজ, কাল, পরশুর গল্প’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তাঁর গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে মূলত মার্কসীয় চেতনা এবং ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মাত্র ৪৮ বছর বয়সে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।

কে বাঁচায়, কে বাঁচে-এর উৎস

সারদাকুমার দাসের সম্পাদনায় প্রকাশিত ভৈরব পত্রিকার প্রথম বর্ষ শারদ সংখ্যা ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এই গল্পটি। পরে পরিমল গোস্বামীর সম্পাদনায় ‘মহামন্বন্তর’ গল্পগ্রন্থে এই গল্পটি স্থান পায়।


আডিও মাধ্যমে কে বাঁচায়, কে বাঁচে গদ্যের বিস্তারিত আলোচনা↓


কে বাঁচায়, কে বাঁচে-এর সারসংক্ষেপ

পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় লেখা কে বাঁচায়, কে বাঁচে গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক বিকৃতিই এই গল্পের মুখ্য উপজীব্য। সে একটি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ট্রামে চড়ে অফিস যাওয়ার পথে বাড়ির কাছেই মৃত্যুঞ্জয় একটি লোককে অনাহারে মারা যেতে দেখে। সেই মৃত্যু দেখেই তাঁর মনে এক বিরাট আঘাত লাগে, সে শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করতে থাকে।

অফিসের বাথরুমে গিয়ে সে বমিও করে দেয়। তাঁর অফিসের সহকর্মী তথা বন্ধু নিখিল তাঁকে নানাভাবে বোঝায়, সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু কিছুতেই মৃত্যুঞ্জয়ের মন থেকে এই অনাহারে মৃত্যুর ঘটনা মুছে যায় না। বরং সে এই অনাহারী মানুষদের কষ্ট, নিরন্নদের দুর্দশার কারণ অনুসন্ধান করার বদলে তাঁদের সাহায্যের জন্য নিজের বেতনের সবটুকুই দান করে দেয়। প্রথমে খাওয়া-দাওয়া কমাতে থাকে, শেষদিকে অফিস যাওয়াও বন্ধ করে দেয় সে।

সংসারে তাঁর স্ত্রী-সন্তানাদি রয়েছে। তাদের কথা না ভেবে মৃত্যুঞ্জয় কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী মানুষদের দলে ঘুরতে থাকে। ঘরে তাঁর ছেলে-মেয়েরা খিদের জ্বালায় চিৎকার করে কাঁদে। নিখিল সবসময় তাঁর পরিবারের খবরাখবর নেয়, মৃত্যুঞ্জয় কোথায় আছে সে খবরও টুনুর মাকে জানায়। ধীরে ধীরে সেও তাদেরই একজন হয়ে যায়। তার পরনের পোশাক ক্রমে লুপ্ত হয়।

মানসিক বিকৃতি তাঁকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে বাস্তববোধ সমস্তই লুপ্ত হয়ে যায় তাঁর। বাড়িতে তাঁর স্ত্রী না খেতে পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। মৃত্যুঞ্জয় কেবলই ভাবতে থাকে এই দুর্ভিক্ষের দিনেও সে সুবিধাভোগীর মত দিনে চারবেলা করে পেটপুরে খেয়েছে। এই ভাবনাই তাঁকে বিচলিত করে তোলে। এই অনাহারী মানুষদের দুর্দশার জন্য সে নিজেকেই দোষী বলে মনে করতে থাকে।

ফলে একদিন মৃত্যুঞ্জয় নিজেই গিয়ে দাঁড়ায় লঙ্গরখানার অন্নপ্রার্থী হয়ে। গল্পের শেষে দেখা যায় ছেঁড়া ন্যাকড়া পরে হাতে একটা মগ নিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় মৃত্যুঞ্জয় ভিক্ষা চেয়ে বেড়ায় আর বলে – ‘গাঁ থেকে এইচি। খেতে পাইনি বাবা। আমাকে খেতে দাও।’


দ্বাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

কে বাঁচায়, কে বাঁচে-এর মূল বক্তব্য

লেখকের বক্তব্য এটাই যে, প্রতিকারের আসল পথ রিলিফের মধ্যে নেই। নিজে লঙ্গরখানায় গিয়ে দাঁড়ালেও মুক্তি নেই। কেন দুর্ভিক্ষ আসে বারবার, কেন মানুষকে শহরের ফুটপাথে শুয়ে মরে যেতে হয় – সেই কারণ অনুসন্ধানই প্রথম দায়িত্ব মানুষের। অন্যকে বাঁচানোর ইচ্ছেয় নিজে মরে গেলে বাঁচার পথটিই যাবে হারিয়ে। সভ্যতার পথ যুক্তির পথ।

নিজে বাঁচবো এবং অপরকেও বাঁচাবো। এটাই সঠিক পথ।

এতেই মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ে, তার প্রতিবাদী কণ্ঠ জোরদার হয়। এই অনুভবটিকেই লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ গল্পে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। এই নামকরণের মধ্য দিয়ে আসলে লেখক মানুষের বেঁচে থাকা, এই আদ্যোপান্ত জীবনের উপর মানুষের নিজের নিয়ন্ত্রণের অভাবকে তুলে ধরতে চেয়েছেন।

যে মানুষ আসলে অন্যকে বাঁচাতে যায়, সে কী আসলে নিজে বাঁচতে পারে? নাকি মৃত্যুঞ্জয়ের মতই সকলে হারিয়ে যায় আরও এক অনাহারী, নিরন্ন মানুষের রূপে? এই ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে গল্পে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → কে বাঁচায়, কে বাঁচে গল্পের বিশদে আলোচনা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XII_Beng_Ke_bachay_ke_bache_1