ami-dekhi
Class-12

আমি দেখি কবিতার সারসংক্ষেপ

বাংলাদ্বাদশ শ্রেণি – আমি দেখি (সারসংক্ষেপ)

শক্তি চট্টোপাধ্যায় | আমি দেখি কবিতার কবি পরিচিতি

জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের একজন অগ্রজপ্রতিম কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার থেকেও বড়ো বেশি চর্চিত তাঁর অতিরিক্ত মদ্যপান, খামখেয়ালি মনোভাব ইত্যাদি। ১৯৩৩ সালের ২৫ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগণার অন্তর্গত বহড়ুতে তাঁর চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয়। জন্মপত্রিকায় তাঁর নাম লেখা ছিল চন্দ্রশেখর আর তাঁর ডাকনাম ছিল হাবুল।
তাঁর বাবার নাম বামানাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম কমলা দেবী।শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পৈতৃক নিবাস ছিল হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার কৃষ্ণনগর গ্রামে। তাঁর বাবা পেশায় ছিলেন একজন টোলের পণ্ডিত।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সে গ্রামের হারু পণ্ডিতের পাঠশালায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তালপাতায় ধারাপাত, অক্ষর ইত্যাদি শেখেন তিনি। দাদুর কাছে শৈশবে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প শুনতেন তিনি। 1943 সালে বহড়ুর হাই ইংলিশ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। বাবার মৃত্যুর পরে সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার শেষে তিনি কলকাতায় চলে আসেন।

মহারাজা কাশিমবাজার পলিটেকনিক স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। সেই সময় ভাই ও মায়ের সঙ্গে কলকাতায় তাঁর মামা ভবানী গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতেই ৬০ নং গোপীমোহন দত্ত লেনে তিনি থাকতেন। স্কুলে পড়াকালীনই ভূগোলের শিক্ষক হরিপদ কুশারীর অনুপ্রেরণায় রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং শোভাবাজার লোকাল কমিটিতে কমিউনিস্ট হিসেবে সদস্যপদ লাভ করেন তিনি। 1949 সালে নিজের বাড়িতে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে ‘নবোদয়’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।

এই পত্রিকাতেই জানা যায় তাঁর প্রথম ছদ্মনাম ছিল স্ফূলিঙ্গ সমাদ্দার।

ধীরে ধীরে পার্টির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বন্ধ হল তাঁর। 1951 সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক উত্তীর্ণ হয়ে মির্জাপুর সিটি কলেজে ভর্তি হন তিনি। মামার অনুরোধেই তিনি বাণিজ্য পড়া শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাতেও প্রথম বিভাগে তিনি প্রথম হন। কিন্তু এরপরে প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলায় সাম্মানিক সহ ভর্তি হন স্নাতক স্তরে।

অনিয়মিত জীবন-যাপনের কারণে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন তিনি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসুর পরামর্শে তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে শুরু করলেও সেই পড়াও সম্পূর্ণ করতে পারেননি তিনি। এই সময় ‘শঙ্খ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেখানে প্রথম তাঁর ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসের খসড়া প্রকাশ পেয়েছিল।

ধীরে ধীরে কবিতা চর্চাই তাঁর জীবনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। কর্মজীবনে কোথাও বেশিদিন স্থায়ীভাবে কাজ করেননি তিনি। প্রথমে 1959 সালে স্যাক্সবি ফার্মে কাজ পান তিনি। পরে 1961 সালে হিন্দুস্তান মোটরসে যোগ দেন ভালো পদে ভালো বেতনে, কিন্তু সেই কাজে বেশিদিন থিতু হতে তিনি পারেননি। দুইবার চাকরি ছাড়ার পরে জীবিকার তাগিদে টিউটোরিয়াল হোম খুলে ইংরাজি পড়াতে শুরু করেন তিনি। ক্ল্যারিয়ান বিজ্ঞাপন সংস্থায় এই সময় ফ্রিল্যান্সে কপিরাইটারের কাজও করতেন তিনি।


দ্বাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

এই সময়ই মীনাক্ষী দেবীকে বিবাহ করেন তিনি আর বিবাহের পরেই 1970 সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় পাকাপাকিভাবে একটা চাকরি জুটে যায় তাঁর। এই সংস্থাতেই 1994 সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। শেষ জীবনে বিশ্বভারতী বিদ্যালয় তাঁকে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এবং সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে তিনি কিছুদিন বিশ্বভারতীতেও পড়িয়েছিলেন। তাঁর লেখা সনেটধর্মী একটি কবিতা ‘যম’ প্রথম বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল।

এই ‘কবিতা’ পত্রিকাতেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মোট ১৫টি কবিতা প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ নামে ১৯৬১ সালে ‘গ্রন্থজগৎ’ প্রকাশনার প্রকাশক দেবকুমার বসুর হাত ধরে। আনন্দবাজারের অধীনে ছোটোদের জন্য ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বও একসময় পেয়েছিলেন তিনি। আনন্দবাজারের কর্মজীবনেই তিনি সবথেকে বেশি লিখেছেন। তিনি নিয়মিতভাবে কবিতা, ছড়া, ভ্রমণকাহিনি, গদ্য এবং উপন্যাস লিখেছেন। ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে ‘কবিতা সাপ্তাহিকী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে থাকেন।

তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো’ (১৯৬৫), ‘সোনার মাছি খুব করেছি’ (১৯৬৭), ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’ (১৯৬৯), ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’ (১৯৭২), ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ (১৯৭০), ‘অঙ্গুরী তোর হিরণ্যজল’ (১৯৮০), ‘জ্বলন্ত রুমাল’ (১৯৭৫), ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে’ (১৯৭৮) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

মৌলিক কবিতা রচনার পাশাপাশি প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের ‘ওমরখৈয়াম’, কালিদাসের ‘মেঘদূত’, ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া মির্জা গালিব, পাবলো নেরুদা, হাইনরিখ হাইনে, মায়াকোভস্কি, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা প্রমুখের বহু কবিতাও তাঁরই অনুবাদে প্রকাশ পেয়েছে।

কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল – ‘কুয়োতলা’ (১৯৬১), ‘কিন্নর কিন্নরী’ (১৯৭৭), ‘অবনী বাড়ি আছো’ (১৯৭৩), ‘দাঁড়াবার জায়গা’ (১৯৮৬) ইত্যাদি। ছোটোদের জন্য ছড়াও লিখেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যার মধ্যে উল্লেখ্য ‘পুণ্যিপুকুর পুষ্করিণী’ (১৯৮২), ‘মিষ্টি কথায়, বিষ্টিতে নয়’ (১৯৮৫), ‘বড়োর ছড়া’ (১৯৯৪) ইত্যাদি। তাঁর লেখা ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ্য ‘উইক এণ্ড ট্যুরিস্ট গাইড’ (১৯৭২), ‘চলো বেড়িয়ে আসি’, ১ম পর্ব (১৯৭৭), ‘চলো বেড়িয়ে আসি’, ২য় পর্ব (১৯৮০) এবং ‘খৈরী, আমার খৈরী’ (১৯৭৬)।

১৯৭২ সালে ত্রিবৃত্ত পুরস্কারে এবং ১৯৭৫ সালে সুরেশচন্দ্র মজুমদার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। তাঁর লেখা ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো’ কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৮৩ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন তিনি আর এই কবিতাটিই তাঁর সবথেকে বেশি জনপ্রিয় হয়। জীবৎকালেই তাঁর এই কবিতার বইয়ের ৩৫ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। ১৯৯৫ সালে সম্বলপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গঙ্গাধর মেহের পুরস্কার এবং মরণোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। ১৯৯৫ সালের ২১ মার্চ (মতান্তরে ২৩ মার্চ) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।

আমি দেখি কবিতার উৎস

আলোচ্য ‘আমি দেখি’ কবিতাটি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘অঙ্গুরী তোর হিরণ্যজল’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। ১৩৮৭ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে এই কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়।

আমি দেখি কবিতার সারসংক্ষেপ

শক্তি চট্টোপাধ্যায় আদ্যন্ত একজন প্রকৃতি-প্রেমিক কবি। তাঁর কবিতায় বারবারই নানাভাবে প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ ধরা পড়ে। আলোচ্য ‘আমি দেখি’ কবিতায় মূলত ফুটে উঠেছে প্রকৃতির প্রতি কবির আত্মিক ভালোবাসার ছবি। কবির কাছে এই প্রকৃতির গাছেরা বড়ো তাৎপর্যবাহী। বাগানে গাছ নিয়ে এসে বসাতে বলেছেন তিনি। কারণ তাঁর মতে এই গাছ তাঁর আরোগ্যের জন্য ভীষণ জরুরি। গাছের সবুজই তাঁর শরীরে আরোগ্য এনে দেবে। কবি তাই শুধুই গাছ দেখতে চেয়েছেন।

কবি জানান বহুদিন জঙ্গলে যাননি তিনি আর তাই তাঁর মন এখন বিষণ্ন। নাগরিক কোলাহল তাঁকে ব্যথিত করে। নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা হয় যার দরুন এই শহরেই কবিকে একঘেঁয়ে জীবন কাটাতে হচ্ছে। শহরের আকাশে বাতাসে অসুখের বীজাণু ঘোরে আর সেই অসুখ শহরের সবুজকে গিলে খায়। নগরায়ণের দাবিতে যেভাবে পৃথিবী থেকে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে তার জন্য কবি আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন এই কবিতায়।

কবি তাই বলেন সবুজের অনটন ঘটে।

আর তাই তিনি বাগানে গাছ বসাতে বলেছেন বারবার। মানুষের চোখ সবুজই চায়, সবুজের মধ্যেই আছে দৃষ্টির শান্তি। কবির মনও আকুলভাবে চায় বাগানে গাছেদের সমারোহ। এই কবিতা তাই এক সবুজের প্রার্থনা হয়ে ওঠে।

আমি দেখি কবিতার মূল বক্তব্য

নাগরিক সভ্যতা কবিকে যন্ত্রণা দেয়, কবি পালিয়ে যেতে চান এই শহর থেকে দূরে। অরণ্যের আদিম নির্জনতায় কবি শান্তি পান। নগরজীবন কেবলই গিলে খায় সবুজ গাছের দেশ। অথচ এই গাছ মানুষের আরোগ্যের জন্য ভীষণ জরুরি। কবি তার বাগানে এনে বসাতে চান সবুজ গাছ, গাছ দেখলেই কবি রোগমুক্ত হতে পারেন। বহুদিন শহরে থাকার ফলে কবির প্রাণ ওষ্ঠাগত, জঙ্গলে না যাওয়ার আক্ষেপ ঝরে পড়ে তাঁর কন্ঠে। শহরের অসুখ কবিকে ক্লান্ত করে। তাই তিনি গাছ দেখতে চান, শুধুই গাছ দেখে যাওয়ার আর্তি নিয়েই কবিতার সমাপ্তি ঘটে।

সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → আমি দেখি বিশদে আলোচনা

লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XII_Beng_Ami_Dekhi_1