বাংলা – দ্বাদশ শ্রেণি – রূপনারানের কূলে (সারসংক্ষেপ)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পাঠ্যাংশের ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম। ১৮৬১ সালের ৭ মে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদা দেবী। তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেল উনিশ শতকের এক বিখ্যাত প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্দশতম সন্তান রবীন্দ্রনাথ বড়ো হয়েছেন ঠাকুরবাড়ির এক অত্যন্ত অভিজাত সংস্কৃতিমনস্ক পরিমণ্ডলে। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল প্রভৃতি বিদ্যালয়ে বাল্যকালের শিক্ষালাভ ঘটলেও প্রথাগত পড়াশোনায় তাঁর মন বসেনি কখনোই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর অসমাপ্তই থেকে যায়। তবে বাড়িতে পারিবারিক উদ্যোগে দিনের প্রায় বারো ঘন্টা গৃহশিক্ষকদের কাছে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যালাভ করেন। তা সে কুস্তি শেখা কিংবা সঙ্গীতচর্চা থেকে শুরু করে প্রকৃতিবিজ্ঞান বা অস্থি সংগঠনের নানা বিষয় তিনি শিখেছিলেন বাড়িতে থেকেই।
আরো পড়ো → কে বাঁচায়, কে বাঁচে গল্পের বিষয়বস্তু
খুব ছোটোবেলা থেকেই নীল রঙের ডায়েরিতে তাঁর কবিতাচর্চার শুরু। শুনলে আশ্চর্য হতে হয় মাত্র তেরো বছর বয়সে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর সমালোচনা লিখেছিলেন ‘ভারতী’ পত্রিকায়। ‘হিন্দুমেলায় উপহার’ তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত ‘সন্ধ্যাসংগীত’ কাব্যগ্রন্থ থেকেই তাঁর নিজস্ব কাব্যচর্চার সূত্রপাত ঘটে। যদিও প্রথম দিকের রচনাগুলিতে অগ্রজ কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। ১৮৭৮ সালে আঠারো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার বিলেতযাত্রা করেন ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য। পরে এই প্রথম বিলেতযাত্রার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’। তাঁর সাহিত্যকর্ম নিরন্তর গতিতে চলতে থাকে। ‘প্রভাতসংগীত’, ‘মানসী’, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘কল্পনা’, ‘ক্ষণিকা’, ‘খেয়া’, ‘নৈবেদ্য’, ‘বলাকা’, ‘পুনশ্চ’, ‘পত্রপুট’, ‘আকাশপ্রদীপ’, ‘নবজাতক’, ‘শেষ লেখা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলি পরপর প্রকাশিত হতে থাকে। তাঁর প্রথম উপন্যাস – ‘করুণা’। এছাড়াও ‘গোরা’, ‘চোখের বালি’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘যোগাযোগ’, ‘শেষের কবিতা’, ‘চার অধ্যায়’ ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস তাঁরই লেখা।
বলা হয় বাংলা আধুনিক ছোটোগল্পের যোগ্য রূপটিও রবীন্দ্রনাথের হাতেই গড়ে উঠেছিল। ‘পোস্টমাস্টার’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘নষ্টনীড়’, ‘দেনা পাওনা’, ‘নিশীথে’ ইত্যাদি বিখ্যাত কীর্তির মতো শতাধিক গল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। শুধুই গল্প-উপন্যাস-কবিতা নয়, তাঁর লেখা ‘সিরিয়াস’ প্রবন্ধগুলি বাঙালি চিন্তকদের কাছে অমূল্য সম্পদ। ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘চণ্ডালিকা’র মতো গীতিনাট্য, ‘রাজা’, ‘মুক্তধারা’, ‘রক্তকরবী’, ‘ডাকঘর’-এর মতো রূপক-সাংকেতিক নাটক রচনা করে বাংলা নাট্যসাহিত্য ও থিয়েটারের ইতিহাসে মোড় বদল করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বের বহু দেশে ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ আর সেই সব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি লেখেন ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’ কিংবা ‘জাপানযাত্রী’। পিতা দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে সাজাদপুর, শিলাইদহ ইত্যাদি অঞ্চলের জমিদারির দেখভালও করেছেন তিনি। শিলাইদহে বেশিরভাগ সময়ই পদ্মা নদীর উপর বোটে সময় কাটতো তাঁর।
তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরাজি অনুবাদ ‘The Song Offerings’-এর জন্য তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। শুধুই সাহিত্যচর্চা নয়, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের একেবারে সামনের সারিতে থেকে ব্রিটিশ বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই অনুষঙ্গে ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটিও লেখেন তিনি। ১৯০১ সালে প্রাচীন ভারতের তপোবনের আদর্শে শান্তিনিকেতনে তিনি গড়ে তোলেন ‘ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়’। এটিই পরবর্তীকালে ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’ হিসেবে গড়ে ওঠে। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইংরেজদের দেওয়া ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ। এই দানবীয় প্রতিভাবান বাঙালি সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ-সমালোচক এবং চিন্তকের মৃত্যু হয় ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট।
শুধু তাঁর রচনার নাম উল্লেখ করার জন্যেই বিস্তৃত পরিসর দরকার, তার অভাবে ক্ষুদ্র পরিসরে আমরা শুধু নীরস এই তথ্যগুলি মাথায় রেখে পাঠ্যাংশে প্রবেশ করবো।
রূপনারানের কূলের উৎস
১৯৪১ সালের ১৩ মে, রাত্রি ৩টে ১৫ মিনিটে এই কবিতাটি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরে এটি তাঁর ‘শেষ লেখা’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। আশ্চর্যের বিষয় এই কাব্যগ্রন্থটি কবির মৃত্যুর পরে ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘শেষ লেখা’ কাব্যগ্রন্থের ১১ সংখ্যক কবিতা ‘রূপনারানের কূলে’।
রূপনারানের কূলে কবিতার বিস্তারিত আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে↓
রূপনারানের কূলে সারসংক্ষেপ
রূপনারানের কূল আসলে বাস্তবের রূপময় জগৎ। বহু বহু বছরের অজ্ঞানতার পর এই বাহ্য প্রকৃতিতে কবির চৈতন্য হয়েছে, কবি জেগে উঠেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন যে এই জগৎ আসলে কোনও স্বপ্ন নয়। রণ-রক্ত-সফলতাময় এই জগতের আঘাতে-সংঘাতে, রক্তের অক্ষরে ও বেদনায় নিজেকে আবিষ্কার করেছেন কবি।
আরো পড়ো → The Eyes have it Question Answer
এর মধ্য দিয়ে স্থির বিশ্বাসে উপনীত হয়েছেন কবি যে, দুঃখের মধ্য দিয়েই এই জীবন আমাদের কাছে ধরা দেয়। এই জীবন কেবলই দুঃখের তপস্যামাত্র। জগতের যা কিছু রূঢ় সত্য তার সম্মুখীন হন কবি। এই সত্য কঠিন, কিন্তু এই সত্যকেই প্রাণভরে ভালোবেসেছেন কবি। বেদনা ও রক্তক্ষরণের মধ্য দিয়েই সেই সত্য উপলব্ধি করা যায়।
সত্য কখনও কাউকে বঞ্চনা করে না।
জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে সত্যের মূল্য উপলব্ধি করতে চান কবি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। মৃত্যুই এই পৃথিবীতে এক অমোঘ সত্য। এর মধ্য দিয়েই জীবনের সব দেনা শোধ হয়ে যায়।
দ্বাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
কবি বলছেন মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এ জীবন কেবলই এক ‘দুঃখের তপস্যা’। কবির পরিণত বয়সের জীবন-দর্শন ফুটে উঠেছে এখানে। সত্যের প্রতি ভালোবাসায় মাটি ও মানুষের টানে কবি বারবার ফিরে এসেছেন স্বপ্নজগৎ থেকে। এই বস্তুজগত বেদনাময় হলেও কবির কাছে এটাই সত্য আর সত্য মানেই তা সুন্দর ও শান্তির প্রতিরূপ।
বেদনা-দুঃখ-মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই এ জীবন সুন্দর, এ জীবন সত্য।
সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → রূপনারানের কূলে বিস্তারিত আলোচনা
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখক পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XII_Beng_Rupnaraner_Kule_1