rupnaraner-kule-2
Class-12

রূপনারানের কূলে বিস্তারিত আলোচনা

বাংলাদ্বাদশ শ্রেণি – রূপনারানের কূলে (বিস্তারিত আলোচনা)

আগের পর্বে আমরা ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতার উৎস এবং সারসংক্ষেপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। আগের পর্ব পড়া না থাকলে, এই পর্ব থেকে তা পড়ে নিতে পারো → রূপনারানের কূলে কবিতার সারসংক্ষেপ

রূপনারানের কূলে বিস্তারিত আলোচনা

‘রূপনারানের কূলে’ রবীন্দ্রনাথের জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে লেখা কবিতা। রবীন্দ্র-কাব্যের পর্ব বিভাগ করতে গেলে ‘নবজাতক’, প্রান্তিক, রোগশয্যায় সেজুঁতি ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলিকে গোধূলি-লগ্নের কাব্য বা অন্ত্য পর্বের কাব্য বলা হয়ে থাকে। এই সময় কবি বুঝতে পারছিলেন মৃত্যুর দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। এই ইহজগতের যা কিছু সঞ্চয় সব ফেলে এক অদৃশ্যলোকে তাঁকে পাড়ি দিতে হবে। ফলে এই শেষ পর্বের কবিতাগুলির মধ্যে ধরা পড়ে রবীন্দ্রনাথের ইহলৌকিক বোধ, মৃত্যুচেতনা,আধ্যাত্মিকতা যা সর্বতোভাবে উপনিষদ দ্বারা প্রভাবিত।

‘শেষ লেখা’ রবীন্দ্রনাথের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ।

মৃত্যুর মাত্র ৫ দিন আগে রাত্রি চতুর্থ প্রহরে তিনি ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতাটি লিখেছিলেন। এই কাব্যগ্রন্থটি যদিও কবির মৃত্যুর পরেই প্রকাশিত হয় যার সকল কবিতার মধ্যেই রবীন্দ্র-মননের এক পূর্ণ দার্শনিক রূপ ফুটে উঠেছে। জীবনের মধ্যে থেকেই জীবনকে উপলব্ধি করা এবং জীবনের সারসত্য হিসেবে মৃত্যুকে স্বীকার করার কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ এই কবিতায়।

‘রূপনারানের কূলে
জেগে উঠিলাম,
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।’


এই ‘রূপনারান’ বাস্তবিক কোনো নদীর নাম হলেও কবিতায় তা কোনো ইহলৌকিক উপাদান নয়। রূপনারান বলতে রবীন্দ্রনাথ এই রূপময় বিশ্বকেই বুঝিয়েছেন। যে বিশ্বজগৎকে আমরা রোজ দেখি, উপভোগ করি – যে জগতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের বেঁচে থাকা তা কোনো কল্পরাজ্য নয়।

সেই জগৎ কোনো স্বপ্ন নয়।

এ যেন কবির জীবনের অন্তিমে এসে এক সত্য উপলব্ধি। এত দীর্ঘ জীবনকালে কবি নানাবিধ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন, অভিজ্ঞতার ভার তাঁকে আরো প্রাজ্ঞ করে তুলেছে। রূপনারানের কূলে এই জেগে ওঠা জীবনের অন্তিমে এসে জীবনের সত্যকে জানা। এতদিন তাঁর জীবন ছিল ‘দুঃখ সুখের দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা’। ইহজগতের অসীম মায়াডোরে বাঁধা ছিল সে জীবন। সেখানে বারেবারে মৃত্যু এসে কবিকে বিদ্ধ করেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তখন ভাবতেন –

‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’

মৃত্যুশোক কাটিয়ে উঠে তিনি আবার মিশে গিয়েছেন জীবনের মূল স্রোতে।

কিন্তু মৃত্যু তো বিশ্বের চরমতম সত্য – অমোঘ, অপরিবর্তনীয়।

ধীরে ধীরে কবির মননেও যেন মৃত্যুকে স্বীকৃতি দেওয়ার ভাবনা জাগরত হয়েছে। কবি দেখেছেন, আঘাত ও বেদনার মধ্য দিয়েই জীবন বয়ে চলে। সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক অজস্র সংঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের সত্যকে উপলব্ধি করেছেন কবি।

‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –
‘… জীবন দুঃখময়, কিন্তু তার মধ্য দিয়েই মানুষের চৈতন্যের বিকাশ ঘটে। সে জীবনের ধর্মকে অনুভব করতে পারে। তাই স্বপ্নবিলাসিতায় নয়, দুঃখের তরঙ্গমুখরতাতেই জীবন সত্যকে খুঁজে পাওয়া যায়।’

কী এই জীবনসত্য?

কোন সত্যে উপনীত হয়েছিলেন কবি? রবীন্দ্র-সাহিত্যে বারবার যে সত্য-শিব-সুন্দরের ধারণা এসেছে, সেখানে সত্যকেই কবি সুন্দর বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ‘রূপনারানের কূলে’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকেই পরম সত্য হিসেবে দেখেছেন, মৃত্যু সত্য আর তাই মৃত্যু সুন্দর।

মৃত্যুর মধ্য দিয়েই জীবনের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। রবীন্দ্রনাথ লেখেন –
‘রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ,
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;’


দ্বাদশ শ্রেণি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

এই জগৎ কবির কাছে আঘাত-সংঘাতময়। স্বপ্ন-কল্পনাময় এই ইউটোপিয়ান জগতকে কবি বিশ্বাস করেন, কিন্তু একেই জীবনের চিরসত্য বলে মানেন না। রূপনারানের কূলে জেগে ওঠা বলতে কবি জীবনের উপান্তে এসে জীবনের এই সত্যকেই উপলব্ধি করার কথা বলেন। এ যেন কবির পরম আত্মোপলব্ধি। এই জেগে ওঠা আসলে কবির মগ্ন চৈতন্যের জেগে ওঠা। জীবনের মোহ-মায়া এতদিন কবিকে আচ্ছন্ন, নিদ্রামগ্ন করে রেখেছিল।

সেই নিদ্রা ভেঙে গেলে কবির মনে হয় –
‘আমৃত্যু দুঃখের তপস্যা এ জীবন’।

ভারতীয় দর্শন তথা প্রাচ্য দর্শনে এই দুঃখবাদের একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। বেশিরভাগ ভারতীয় দার্শনিকেরা এই জগৎকে দুঃখময় বলে মনে করেন। সাংখ্যদর্শনে দুঃখের বিশেষ প্রাধান্য রয়েছে। বৌদ্ধ দর্শনেও দুঃখের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয়েছে। ভারতীয় দর্শন তবু দুঃখকে অতিক্রম করে এক মোক্ষের কথা বলে। অন্যদিকে শোপেনহাওয়ারের মত পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা মনে করেন, এ জগতে দুঃখের মূল উৎস হল জন্ম। জন্ম না হলে দুঃখের অনুভবই হত না। এই দুঃখের নিবৃত্তি কেবলমাত্র মৃত্যুতেই সম্ভব।


রবীন্দ্রনাথও মৃত্যুকেই এই জীবনের সব দুঃখের সমাধান বলেই মনে করেন। জীবন এক দুঃখের তপস্যা। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সেই তপস্যার মোক্ষলাভ হয় এবং জীবন পূর্ণতা পায়। ‘শেষ লেখা’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই যেন রবীন্দ্রনাথের আত্মোপলব্ধির নিখাদ রূপ, তা যতটা না কবিতা তার থেকেও বেশি উপলব্ধি।

এই কাব্যেরই আরেকটি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –
‘দুঃখের আঁধার রাত্রি বারেবারে
এসেছে আমার দ্বারে;’

প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথের জীবনে এই দুঃখবোধ, এই মৃত্যুচেতনার সৃষ্টি হল কীভাবে? কীভাবে কবি ‘শেষ লেখা’র এই সত্য-উপলব্ধিতে এসে উপনীত হলেন?
চোদ্দো বছর বয়স হওয়ার আগেই জীবনে প্রথম মৃত্যু দেখেন রবীন্দ্রনাথ – তাঁর মা সারদা দেবীর মৃত্যু (১০ মার্চ ১৮৭৫)।

‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থের ‘মৃত্যুশোক’ অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন যে মায়ের মৃতদেহ যখন বাড়ির সামনে রাখা হয়, তখন মায়ের মুখ দেখে মৃত্যুর কোনোরূপ বেদনার ছাপ লক্ষ্য করেননি রবীন্দ্রনাথ, বরং তাঁর মায়ের মুখ দেখে তাঁর মনে হয়েছিল মৃত্যু হয়তো বড় সুখকর।

কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর বড় দিদি সৌদামিনীর স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয় (ডিসেম্বর ১৮৮৩)। এর পরের বছরই তাঁর নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। তাঁর মায়ের মৃত্যু এবং কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা কবিকে সবথেকে বেশি বিচলিত করেছিল। এক বিশাল শূন্যতা গ্রাস করেছিল রবীন্দ্রনাথকে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পরে। অনেক পরে ১৯০২ সালের নভেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মারা যান।

তদুপরি পিতা হয়ে একের পর এক সন্তানের মৃত্যুশোকও সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকা মারা যান ১৯০৩ সালে এবং তার বছর তিনেকের মধ্যেই তাঁর ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ কলেরায় মারা যান। তারপর একে একে বড় মেয়ে মাধুরীলতা, ছোট মেয়ে মীরাদেবীর ছেলে নীতীন্দ্রনাথ মারা যান। পরপর এতগুলি মৃত্যু কবির চেতনাকে বিদ্ধ করেছিল নিশ্চিত।

রবীন্দ্র-জীবনী ঘাঁটলে দেখা যায় পুত্র শমীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার দিন রবীন্দ্রনাথ শ্মশানে পর্যন্ত যাননি। ঘরে বসেছিলেন একা, রাতে ঘুম আসেনি তাঁর আর ঠিক সেই রাতেই তিনি লিখেছিলেন বিখ্যাত সেই গান ‘আজি জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে / বসন্তের এই মাতাল সমীরণে’।

মৃত্যুশোক বারবার আঘাত করেছে তাঁকে। তাঁর সংবেদনশীল মন যত আঘাত পেয়েছে, ততই তাঁর প্রজ্ঞা তাঁকে মৃত্যুর রহস্য ভেদ করার চিন্তায় আকৃষ্ট করেছে। এই মৃত্যু যে জীবনের প্রাণধারার এক নিবিড় ছন্দের অঙ্গীভূত তা ক্রমে স্বীকার করে নেন রবীন্দ্রনাথ। তাই হয়তো তিনি লিখতে পারেন

‘নাচে জন্ম, নাচে মৃত্যু তালে তালে’

কবি বুঝতে পারেন এই বিশ্ব, এই রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শময় বস্তুজগৎ মায়াময়, ছলনাময়, প্রবঞ্চনাময়। দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের মধ্যেই মানুষের তথা এই বিশ্বের প্রকৃত সত্য লুকিয়ে আছে। এই সত্য কঠিন, তবু সেই কঠিনকেই ভালোবাসতে চান কবি। কারণ সত্য কঠিন হলেও তা কখনো কাউকে বঞ্চনা করে না।

রানি চন্দকে একবার একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন –
‘সত্য কঠিন – অনেক দুঃখ, দাবি নিয়ে আসে। স্বপ্নে তা তো থাকে না; কিন্তু তবুও আমরা সেই কঠিনকেই ভালোবাসি। ভালোবাসি সেই কঠিনের জন্য সবকিছু দুঃসহ কাজ করতে।’

রবীন্দ্রনাথের এই মৃত্যুভাবনা অনেকাংশেই উপনিষদ দ্বারা প্রভাবিত। উপনিষদে মৃত্যুকে কখনো সমাপ্তি হিসেবে দেখা হয়নি, বরং তাকে আরেক প্রারম্ভের সূচক হিসেবেই দেখা হয়েছে। (Add. উপনিষদে মৃত্যুভাবনা) কবির কাছে আমাদের জীবন আসলেই মরণের পথে যাত্রা। জীবনের বহতাধারায় মানুষের সার্থকতা যাচাই হয় আঘাতের পরীক্ষায়। আগুনের তাপে লোহা গলে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আবার যেমন দৃঢ় হয়ে ওঠে, তেমনি অনন্ত যন্ত্রণাভারেও কবির মন হয়ে উঠেছিল স্থিতধী।

তিনি জীবনকে জেনেছিলেন, অন্ধকারের পারে সেই জ্যোতির্ময় মহান পুরুষকে জেনেছিলেন। শোক ও হতাশার অন্ধকার ফুঁড়ে আলোয় উত্তীর্ণ হয়েছেন কবি। প্রিয়জনের মৃত্যুশোক তাঁর Resillience-কে দৃঢ় করেছিল। ব্যক্তিগত শোক বেদনাবাহিত হয়ে পরিণত হয়েছিল বিশ্বশোকে।

বহু মৃত্যুর অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি লিখেছিলেন –
‘মরণকে মোর দোসর করে
রেখে গেছ আমার ঘরে,
আমি তারে বরণ করে
রাখব পরাণময়।’

এই জীবন যেমন সত্য, প্রাণের স্পন্দন যেমন সত্য, তেমনি স্পন্দন না থাকাটাও বা স্পন্দন থেমে যাওয়াটাও সত্য। জীবন সুন্দর কারণ এর সমাপ্তি আছে। আর এই সমাপ্তির সূচক হল মৃত্যু। মৃত্যু সত্য, সে কেবল তরী থেকে তীরে নিয়ে যায় মাত্র। সেই সত্যকে ভালোবেসে জীবনসম্পৃক্ত করে তুলতে হয়, সত্যকে ভালোবাসতে পারাই জীবনের সার্থকতা।


রূপনারানের কূলে কবিতার বিস্তারিত আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে↓



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XII_Beng_Rupnaraner_Kule_2