WB-Class-8

জীবদেহের গঠনের ধারণা

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: বিজ্ঞান । অধ্যায় – দেহের গঠন (প্রথম পর্ব)


আজ আমরা দেহের গঠন অধ্যায় নিয়ে আলোচনা শুরু করবো, আজ প্রথম পর্বে জীবদেহের গঠনের ধারণা সম্পর্কে জেনে নেব।

যার মধ্যে জীবন আছে তাকে সজীব আর যার মধ্যে জীবন নেই তাকে জড় বলা হয়। জীবদেহের মধ্যে বৃদ্ধি, জনন, পরিপাক, শ্বসন, বর্জ্য পদার্থ পরিত্যাগ প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া দেখা যায়, যা জড় পদার্থের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

জীবদেহে বর্তমান বিভিন্ন অঙ্গের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ সম্পাদিত হয়। যেমন- ফুসফুস শ্বাস গ্রহণের কার্য সম্পাদন করে, দেহে গৃহীত খাদ্য পরিপাক হয় ক্ষুদ্রান্ত ও পাকস্থলীর দ্বারা, বহির্জগত থেকে উদ্দীপনা গ্রহণ ও বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক প্রভৃতি।

কোষ

জীবদেহের সকল অঙ্গ বিভিন্ন প্রকার অতি ক্ষুদ্র কোষ দ্বারা গঠিত কোষ হল জীবদেহের সবচেয়ে ছোট গঠনগত ও কার্যগত একক। কোষ আকারে খুবই ছোট এবং প্রায় সকল কোষ আণুবীক্ষণিক, খালি চোখের এদের দেখা যায় না।

ছবি সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ কর্তিক স্বীকৃত বিজ্ঞান বই পরিবেশ ও বিজ্ঞান

কোষের বাইরের ও ভিতরের গঠন পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন প্রকার অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা Microscope ব্যবহার করা হয়।

1665 খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী রবার্ট হুক তাঁর তৈরি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে কর্কের পাতলা ছেদের গঠন পর্যবেক্ষণ করেন, এবং তিনিই প্রথম কোষ বা Cell শব্দটি ব্যবহার করেন।

অণুবীক্ষণের মাধ্যমে কোন বস্তু কতটা বড় ও সুস্পষ্টভাবে দেখা যাবে তা অণুবীক্ষণের দুটি বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। এই বৈশিষ্ট্য দুটি হল— বিবর্ধন বা Magnification এবং সুস্পষ্টভাবে দেখার ক্ষমতা বা Resolving power।

অণুবীক্ষণ যন্ত্র বিভিন্ন প্রকার হয়। তাদের গঠন বিভিন্ন এবং বিবর্ধন ক্ষমতা ও পৃথক হয়।

  • Simple light microscope বা সরল আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র কোন বস্তুকে 15-20 গুণ বিবর্ধন করতে সক্ষম।
  • Compound light microscope বা যৌগিক আলোক অণুবীক্ষণ যন্ত্র কোন বস্তুকে 2000-4000 গুণ বিবর্ধিত আকারে দেখতে সক্ষম।

প্রাণী ও উদ্ভিদের বিভিন্ন দেহাংশ ও কোষের অন্তর্গঠন ও বহির্গঠন পর্যবেক্ষণ করতে এই অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য আণুবীক্ষণিক জীবকে নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য Electron Microscope ব্যবহার করা হয়, যা কোন বস্তুকে তাঁর আকারের তুলনায় 50000 থেকে 300000 গুণ বিবর্ধন করে দেখাতে পারে।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান

সকল জীবদেহ কোষ দ্বারা গঠিত। এই কোষ হল জীবদেহের সকল গঠন, বিপাকীয় ও বংশগতি মূলক একক। জীবদেহের সকল গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ক্রিয়া কোষের মধ্যে সম্পাদিত হয়। সকল জীবদেহে কোষের সংখ্যা সমান নয়। জীবদেহ এককোষী বা বহুকোষী হতে পারে। জীবদেহ আকারে যত বড় হয়, দেহে উপস্থিত কোষের সংখ্যা তত বেশি হয়।

অ্যামিবা (Amoeba), ইস্ট (Yeast), প্যারামেসিয়াম (Paramecium) প্রভৃতি এককোষী অর্থাৎ জীবের উদাহরণ। অর্থাৎ Uni–cellular এদের দেহ একটি মাত্র কোষ দ্বারা গঠিত। মানুষ, বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ, পশুপাখি প্রভৃতি Multi–cellular বা বহুকোষী জীবের উদাহরণ।

সকল কোষের আকার ও আকৃতি একরকম হয় না। সাধারণভাবে কোষ আকারে খুবই ছোট ও আণুবীক্ষণিক পদার্থ, যাকে খালি চোখে দেখা যায় না। সাধারণত কোষের আকার পরিমাপ করতে মাইক্রন বা মাইক্রোমিটার একক ব্যবহার করা হয়।

কোষের আকৃতি

সাধারণভাবে প্রাণীদেহের কোষের আকার হয় 10 থেকে 30 মাইক্রোমিটার, আর উদ্ভিদ কোষের আকার সাধারণভাবে 10 থেকে 100 মাইক্রনের মধ্যে হয়।

সবচেয়ে বড় কোষ হল ডিম, যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই। উটপাখি বা Ostrich–এর ডিম হল বিশ্বের বৃহত্তম একক কোষ যার ওজন হয় 1.5 kg এবং ব্যাস বা Diameter প্রায় 6 ইঞ্চি।

সবচেয়ে দীর্ঘ প্রাণী কোষ হল স্নায়ুকোষ!

সব কোষের আকৃতি একরকম নয়। আবার কোন এক নির্দিষ্ট প্রকার কোষের আকৃতি সব সময় একইরকম নাও থাকতে পারে। উদাহরণ হিসাবে আমরা এককোষী প্রাণী অ্যামিবার কথা ধরতে পারি।

এক কোষী জীব অ্যামিবার দেহের বিভিন্ন অঙ্গাণু

অ্যামিবার আকৃতি বার বার পরিবর্তিত হয়, অর্থাৎ এর কোন নির্দিষ্ট আকার নেই। অ্যামিবার শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে সাময়িকভাবে বিভিন্ন অংশ নির্গত হয়, যাকে ক্ষণপদ বলে। অ্যামিবা এই সকল ক্ষণপদের সাহায্যে চলাফেরা করতে পারে।

শুধু এককোষী প্রাণী অ্যামিবা নয়। বহুকোষী জীবদেহের বিভিন্ন কোষের পৃথক আকার দেখা যায়। আমাদের শরীরে বর্তমান শ্বেত রক্তকণিকা অ্যামিবার মত নিজেদের আকার পরিবর্তন করতে পারে।

এই শ্বেত কণিকাকে দেহের প্রহরী বলা হয়। কারণ এরা শরীরে কোন জীবাণু প্রবেশ করলে সেই জীবাণুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং জীবাণু ধ্বংস করে শরীরকে রক্ষা করে।

নিউরোন বা স্নায়ুকোষ

কার্যপ্রণালির উপর নির্ভর করে কোষের আকার বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। যেমন- নিউরোন বা স্নায়ুকোশ শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে মস্তিষ্কে উদ্দীপনা পরিবহণ করে এবং মস্তিষ্ক থেকে শরীরের অন্য অংশে বার্তা বহন করে।

প্রাণী দেহের দীর্ঘতম কোষ নিউরোন

এই কাজের জন্য এই কোষগুলি খুব দীর্ঘ ও সরু হয়। এদের মূল কোষদেহ তারকা আকার হয়। কিন্তু অন্যান্য বিভিন্ন স্নায়ুকোষের সাথে সংযোগ স্থাপনের প্রয়োজনে এদের থেকে বহু শাখা প্রশাখা নির্গত হয়।

শ্বেত রক্তকণিকা (WBC) ও লোহিত রক্তকণিকা (RBC)

শরীরে ক্ষতিকর জীবাণু প্রবেশ করলে তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই করে শ্বেত রক্তকণিকা। শ্বেত কণিকা জীবাণুকে ঘিরে ধরে তাকে ধ্বংস করে, এই কাজের জন্য শ্বেত কণিকা নিজের আকার পরিবর্তন করতে পারে।

শরীরের রক্তে বর্তমান লোহিত কণিকার কাজ হল দেহের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করা। এর জন্য লোহিত কণিকা শরীরের রক্তনালী মাধ্যমে বাহিত হয়। রক্তনালীর মধ্য দিয়ে চলাচলের সুবিধার কারণে এগুলি চ্যাপ্টা গোলাকার আকৃতি হয়ে থাকে।

লোহিত রক্ত কণিকা

মানব চক্ষু (Human eye)

আমাদের চোখে দুই প্রকার আলোকসংবেদী বা Photoreceptor কোষ থাকে, যার সাহায্যে আমরা দেখতে পাই। আমাদের চোখের রেটিনায় শঙ্কু আকৃতিবিশিষ্ট কোণ (Cone) কোষ থাকে, যা বর্ণ সংবেদনশীল এবং উজ্জ্বল আলোক শোষণে সক্ষম। এছাড়াও মৃদু আলো শোষণের জন্য চোখের রেটিনায় রড (Rod) কোষ থাকে যা দণ্ড আকৃতির হয়।

আমাদের শরীরের চামড়ার নীচে চর্বিকোষ থাকে, যা ফ্যাট সঞ্চয় করে রাখতে সক্ষম। অতিরিক্ত ফ্যাট জমা থাকার কারণে এই কোষগুলি আংটির ন্যায় আকার ধারণ করে।

শরীরের পেশীকোষগুলি বার বার সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। প্রাণীর স্থান পরিবর্তন, চলন, খাদ্য গ্রহণ, শ্বাস প্রশ্বাস প্রভৃতি সকল কিছুর জন্য পেশী তন্তুগুলির সংকোচন ও প্রসারণ বার বার ঘটে। এই কারণে পেশী তন্তুগুলির মধ্যভাগ চওড়া ও দুই প্রান্ত সরু হয়।

শুধু প্রাণীদেহে নয়, উদ্ভিদ দেহেও বিভিন্ন আকারের কোষ দেখা যায়। উদ্ভিদ তার শিকড়ের মাধ্যমে মাটি থেকে জল শোষণ করে, যা কাণ্ডের মাধ্যমে পাতায় পৌঁছায়। এই ঊর্ধ্বমুখী সংবহনের সাথে যুক্ত কোষগুলি নলাকার বা পাইপের মতন হয়। অন্যদিকে মূল বা শাখার অগ্রভাগে অবস্থিত যে কোষগুলি বার বার বিভাজিত হয়ে মূল বা শাখার দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি করে, সেই কোষগুলি বহুভূজাকার হয়।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ ও কোষীয় বিশেষত্ব


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতিঃ

বিজ্ঞান স্নাতক এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষিতা নন্দিতা বসুর পেশা শিক্ষকতা।তিনি বই পড়তে বড় ভালোবাসেন। কাজের ফাঁকে, অবসরে, বাসে ট্রামে তো বটেই, শোনা যায় তিনি নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বই পড়তে পারেন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করতে ভুলো না।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –