jojyota-rasayonik-bondhon
WB-Class-8

যোজ্যতা ও রাসায়নিক বন্ধন

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: বিজ্ঞান । অধ্যায় – পদার্থের গঠন (চতুর্থ পর্ব)


আমরা আগের পর্বে পদার্থের প্লাজমা ও গ্যাসীয় অবস্থা সম্পর্কে জেনেছি। ভুলে গিয়ে থাকলে এই লিঙ্ক থেকে আরো একবার পড়ে নিতে পারো পদার্থের প্লাজমা ও গ্যাসীয় অবস্থা

এই পর্বে বুঝে নেব যোজ্যতা ও রাসায়নিক বন্ধন সম্পর্কে।

রাসায়নিক বন্ধন কাকে বলে?

পরমাণু আয়ন বা অণুর মধ্যে থাকা যে স্থায়ী আকর্ষণ যা রাসায়নিক যৌগ গঠন করে তাকে রাসায়নিক বন্ধন বলা হয়।

পরমাণুগুলির ইলেকট্রন গ্রহণ, বর্জন বা ইলেকট্রন sharing এর মাধ্যমে রাসায়নিক বন্ধন বা chemical bond তৈরি হয়।

রাসায়নিক বন্ধনের প্রকারভেদ

বন্ধনের শক্তি ও ধর্মের উপর নির্ভর করে রাসায়নিক বন্ধন প্রধানত চার প্রকার হয়ঃ

  • আয়নীয় বন্ধন বা Ionic bond
  • সমযোজী বন্ধন বা Covalent bond
  • হাইড্রোজেন বন্ধন বা Hydrozen bond
  • পোলার বন্ধন বা Polar bond বা ধ্রুবীয় বন্ধন

আয়নীয় বন্ধন সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের সর্বপ্রথম বুঝতে হবে আয়নীয় যৌগ সম্পর্কে।

আয়নীয় যৌগ কাকে বলে?

ইলেকট্রন গ্রহণ ও বর্জন করে বিপরীত চার্জযুক্ত আয়ন সৃষ্টির মাধ্যমে দুটি পরমাণুর মধ্যে স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণের প্রভাবে সৃষ্ট বন্ধনের মাধ্যমে যে যৌগ সৃষ্টি হয় তাকে আয়নীয় যৌগ বা Ionic compound বলা হয়।

বিপরীত আধান যুক্ত আয়ন সমূহের মধ্যে স্থির তড়িৎ আকর্ষণ বলের প্রভাবে সৃষ্ট রাসায়নিক বন্ধনকে তড়িৎযোজী বন্ধন বা আয়নীয় বন্ধন (Ionic bond) বলা হয়।

অন্যভাবে বলা যায়, পূর্ণ যোজ্যতার কক্ষ লাভের জন্য ধাতু থেকে অধাতু পরমাণুর দিকে ইলেকট্রনের সরণই হল আয়নীয় বন্ধন। এটি আয়নীয় যৌগে ক্রিয়াশীল একটি প্রাথমিক বল।

তড়িৎযোজী বা আয়নীয় যৌগের উদাহরণ

সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl), ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড (MgO), সিলভার ক্লোরাইড (AgCl), সোডিয়াম হাইড্রেট (NaOH) প্রভৃতি হল তড়িৎযোজী বা আয়নী যৌগের উদাহরণ।

তড়িৎযোজী বা আয়নীয় যৌগের বৈশিষ্ট্য

তড়িৎযোজী বা আয়নী যৌগগুলির ক্ষেত্রে নীচের বৈশিষ্ট্যগুলি দেখতে পাওয়া যায়-

a) সকল আয়নীয় যৌগ কঠিন অবস্থায় কেলাস ও স্ফটিক আকারে থাকে। যেমন- খাদ্য লবণ বা সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) কেলাস বা crystal আকারে দেখতে পাই।

b) বিভিন্ন আয়নীয় যৌগগুলির ইলেকট্রন গঠন অভিন্ন হলে কঠিন অবস্থায় এদের কেলাসের গঠনও এক রকম হয়।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান | ভূগোল

c) আয়নীয় যৌগ অনুদ্বায়ী হয় এবং এদের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক খুব বেশি হয়।
যেমন- সোডিয়াম ক্লোরাইড এর গলনাঙ্ক বা Melting point হল 801˚C এবং স্ফুটনাঙ্ক বা Boiling point হল 1413˚C।

d) আয়নীয় যৌগগুলি সাধারণত পোলার দ্রাবক যেমন জলে দ্রবীভূত হয়, এবং অপোলার দ্রাবক যেমন- বেঞ্জিনে অদ্রবণীয় থাকে।

e) আয়নীয় যৌগের কেলাস ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়।

f) আয়নীয় যৌগগুলি কঠিন অবস্থায় তড়িৎ অপরিবাহী। কিন্তু গলিত বা দ্রবণ অবস্থায় এরা বিদ্যুৎ পরিবহণে সক্ষম।

g) আয়নীয় যৌগগুলির মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া অতি দ্রুত গতিতে হয়।

NaCl বা সোডিয়াম ক্লোরাইড হল সবচেয়ে পরিচিত আয়নীয় যৌগ। এটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত সোডিয়াম আয়ন (Na+) এবং ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ক্লোরিন আয়ন (Cl) এর সমন্বয়ে গঠিত।

কিছু যৌগ অবস্থায় একটি নিস্তড়িৎ অবস্থায় থাকে। গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় আয়নগুলি বিশ্লিষ্ট হয়, এবং তখন তা তড়িৎ পরিবহণ করতে পারে।

NaCl এর ক্ষেত্রে আয়নীয় বন্ধন তৈরির জন্য সোডিয়াম পরমাণু 1 টি ইলেকট্রন ত্যাগ করে Na+ আয়নে পরিণত হয় আর ক্লোরিন পরমাণু এই ইলেকট্রন গ্রহণ করে Cl আয়নে পরিণত হয়।

তড়িৎ যোজ্যতা কাকে বলে?

নিকটতম নিষ্ক্রিয় মৌলের পরমাণু বিন্যাস লাভের চেষ্টায় একটি মৌলের পরমাণুর সর্ববহিস্থ কক্ষ থেকে এক বা একাধিক ইলেকট্রন বর্জন করে ধনাত্মক আয়তন বা ক্যাটায়নে পরিণত হওয়া, এবং ওই বর্জিত ইলেকট্রন অন্য একটি মৌলের পরমাণু দ্বারা গৃহীত হয়ে ঋণাত্মক আয়ন বা অ্যানায়নে পরিণত হওয়া, এবং পরস্পরের স্থির তড়িৎ আকর্ষণ বল দ্বারা যুক্ত হয়ে যৌগ গঠন করাকে তড়িৎ যোজ্যতা বলে।

বিপরীত আধানযুক্ত এই আয়নদ্বয়ের মধ্যে ক্রিয়াশীল স্থির তড়িৎ আকর্ষণ বলের প্রভাবে উৎপন্ন যৌগকে তড়িৎযোজী বা আয়নীয় যৌগ বলা হয়।

এইভাবে তড়িৎযোজী যৌগ গঠনের সময় কোন তড়িৎ ধনাত্মক মৌল যে সংখ্যক ইলেকট্রন বর্জন করে ক্যাটায়নে পরিণত হয় এবং কোন তড়িৎ ঋণাত্মক মৌল যে সংখ্যক ইলেকট্রন গ্রহণ করে অ্যানায়নে পরিণত হয় সেই সংখ্যাকে ওই মৌলের তড়িৎ যোজ্যতা বলে।

এই নিয়মে Na এবং Cl উভয় পরমাণুর তড়িৎ যোজ্যতা হল 1।

আবার একাধিক প্রকার ক্যাটায়ন আছে এমন কিছু মৌল আমরা দেখতে পাই। যেমন- লোহা (Fe), তামা (Cu), টিন (Sn), পারদ (Hg)। লোহার দুটি ক্যাটায়ন হয় ফেরাস (Fe2+) ও ফেরিক (Fe3+)।

মূলক বা র‍্যাডিক্যাল কাকে বলে?

ক্যাটায়ন বা অ্যানায়ন একাধিক পরমাণুর সমন্বয়েও তৈরি হতে পারে। একাধিক পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত আয়নকে মূলক বা র‍্যাডিক্যাল (Radical) বলা হয়।
যেমন- হাইড্রক্সাইড (OH-), নাইট্রেট (NO3-), সালফেট (SO4-2), অ্যামোনিয়া (NH4+) প্রভৃতি।

সমযোজী যৌগ কাকে বলে?

নিকটতম নিষ্ক্রিয় মৌলের পরমাণুর মত সুস্থিত ইলেকট্রন বিন্যাস লাভের জন্য দুই বা ততোধিক পরমাণু তাদের সর্ববহিস্থ কক্ষ থেকে এক বা একাধিক ইলেকট্রন সমভাবে ব্যবহার করে যে রাসায়নিক বন্ধন গঠন করে তাকে সমযোজী বন্ধন বা Covalent bond বলা হয়।

এইভাবে যৌগ গঠনের ক্ষমতাকে সমযোজ্যতা এবং গঠিত যৌগকে সমযোজী যৌগ বলা হয়।

সমযোজী বন্ধনের শ্রেণিবিভাগ

ইলেকট্রন শেয়ারের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে সমযোজী বন্ধনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়ঃ একক বন্ধন বা bond, দ্বিবন্ধন বা Double bond, ত্রিবন্ধন বা Tripple bond।
জল (H2O), কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), অ্যামোনিয়া (NH3), কার্বন মনোক্সাইড (CO), গ্লুকোজ (C6H12O6) প্রভৃতি সমযোজী যৌগ।

প্রকৃতপক্ষে ইলেকট্রন শেয়ার করা পরমাণুগুলির মধ্যে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বলের যে সুস্থিত ভারসাম্য তৈরি হয়, সেই ভারসাম্য বলই সমযোজী বন্ধন তৈরি করে।
সমযোজী বন্ধন তখনই তৈরি হয় যখন পরমাণুগুলির তড়িৎ ঋণাত্মকতা সমান বা কাছাকাছি হয়।

সমযোজী যৌগের বৈশিষ্ট্য

সমযোজী যৌগের ক্ষেত্রে নীচের বৈশিষ্ট্যগুলি দেখতে পাওয়া যায়:
a) সমযোজী যৌগ সাধারণত তড়িৎ অপরিবাহী হয়।
b) সমযোজী যৌগ সাধারণত নিম্ন গলনাঙ্ক ও নিম্ন স্ফুটনাঙ্ক বিশিষ্ট হয়।
c) এক বা একাধিক ইলেকট্রন শেয়ারের মাধ্যমে এই যৌগ গঠিত হয়।
d) সমযোজী যৌগ সাধারণত জলে দ্রবীভূত হয় না, অর্থাৎ সাধারণভাবে এরা পোলার দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়।এই যৌগগুলি সাধারণত ইথার, বেঞ্জিন প্রভৃতি অপোলার দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়।
e) সমযোজী যৌগগুলির মধ্যে ভ্যান্ডারওয়ালা আকর্ষণ বল দুর্বলভাবে দেখতে পাওয়া যায়।

পর্ব সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতিঃ

বিজ্ঞান স্নাতক এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষিতা নন্দিতা বসুর পেশা শিক্ষকতা।তিনি বই পড়তে বড় ভালোবাসেন। কাজের ফাঁকে, অবসরে, বাসে ট্রামে তো বটেই, শোনা যায় তিনি নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বই পড়তে পারেন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করতে ভুলো না।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –