শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: ভূগোল । অধ্যায় – মেঘ-বৃষ্টি
আগের পর্বে আমরা জেনেছি চাপ বলয় ও বায়ুপ্রবাহ সম্পর্কে। এই পর্বে আমরা মেঘ-বৃষ্টি সম্পর্কে আলোচনা করবো।
মেঘ কী?
জলীয়বাষ্পপূর্ণ হালকা বায়ু ক্রমশ উপরে উঠে, শীতল হয়ে সম্পৃক্ত হয়। এই সম্পৃক্ত বায়ুর তাপমাত্রা শিশিরাঙ্ক এর নীচে মেনে গেলে ঘনীভবনের ফলে অতিরিক্ত জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা ও তুষারকণায় পরিণত হয়। বায়ুতে ভাসমান ধুলোকণাকে আশ্রয় করে এইসমস্ত জলকণা ও তুষারকণা আকাশে ভেসে বেড়ায়, এদের আমরা মেঘ বলি।
অবস্থান অনুযায়ী মেঘ তিনপ্রকারের – ১) উঁচু মেঘ, ২) মাঝারি মেঘ ৩) নীচু মেঘ।
১) উঁচু মেঘ
ভূপৃষ্ঠ থেকে ৬০৫৭ মিটার থেকে ১২৩৫০ মিটারের মধ্যে অবস্থিত মেঘকে উঁচু মেঘ বলে। তিন প্রকারের উঁচু মেঘ আকাশে দেখতে পাওয়া যায়।
• সিরাস
এটি সর্বোচ্চ স্তরের মেঘ। সাদা রঙের স্বচ্ছ এই মেঘ অনেকটা পালকের মত দেখতে। এই মেঘ পরিষ্কার আবহাওয়াকে নির্দেশ করে। এই মেঘে আকাশ ঢেকে থাকলেও সূর্য দেখা যায়। দিনের আলোয় সাদা পালকের মত দেখতে হলেও সূর্যাস্তের আলোয় বর্ণচ্ছটা দেখা যায়। তবে সিরাস মেঘ একে অপরের সঙ্গে মিশে বন্ধনী তৈরি করে, তখন আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়ে।
• সিরো স্ট্র্যাটাস –
এই মেঘ পাতলা সাদা চাদরের মত দেখতে হয়। এই মেঘের মধ্য দিয়ে সূর্য ও চাঁদকে উজ্জ্বল গোলকের মত দেখায়। এই মেঘের কারণে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে রামধনু দেখা যায়। এই মেঘ ঝড়ের সঙ্কেত বহন করে।
• সিরো কিউমুলাস –
এই মেঘ গোলাকার স্তূপের মত, আকাশে ভেসে বেড়ায়। অতি সূক্ষ্ম তুষারকণা দিয়ে এই মেঘ গঠিত। আকাশে মেঘ থাকলে ম্যাকারেল মাছের আঁশের মত দেখতে হয়, এরূপ আকাশকে ম্যাকারেল আকাশ বলা হয়। আকাশে এই মেঘ থাকলে আবহাওয়া খুব মনোরম হয়।
২) মাঝারি মেঘ –
ভূপৃষ্ঠের উপর থেকে ২১৩৫ মিটার থেকে ৬০৯৭ মিটার এর মধ্যবর্তী মেঘকে মাঝারি মেঘ বলে।
দুই প্রকারের মাঝারি মেঘ দেখা যায়, যথা –
• অল্টো স্ট্র্যাটাস
ধূসর বা নীল রঙের এই মেঘ অনেকটা তন্তুর মত দেখতে। চাদরের মত এই মেঘ পুরো আকাশ জুড়ে বিস্তৃত থাকে। এই মেঘের মধ্যে দিয়ে সূর্যকে অনেকটা অনুজ্জ্বল দেখায়। এই মেঘ আকাশে থাকলে একটানা বৃষ্টিপাত হয়।
• অল্টো কিউমুলাস
এই মেঘ চ্যাপ্টা, গোলাকার পশমের মণ্ডের মত দেখতে, সাদা বা ধূসর রঙের। এই মেঘের মাঝে মাঝে নীল আকাশ দেখা যায়। এই মেঘের স্তূপগুলি আকারে বড় এবং ঢিপির মত দেখতে। আকাশে এই মেঘ থাকলে আবহাওয়া পরিষ্কার থাকে।
অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান | ভূগোল
৩) নীচু মেঘ
ভূপৃষ্ঠ থেকে ২১৩৫ মিটার উচ্চতার মধ্যে যে মেঘ থাকে, তাকে নীচু মেঘ বলে। সাধারণত পাঁচ প্রকারের মেঘ দেখা যায়,
• স্ট্র্যাটো কিউমুলাস
এই মেঘের রঙ ধূসর থেকে কালো হয়ে থাকে, দেখতে স্তূপের মত ও স্তরে স্তরে সাজানো থাকে। মাঝ আকাশের অল্টো কিউমুলাস মেঘ আরও ভারী হয়ে নীচে নেমে এসে এই মেঘের সৃষ্টি হয়।
• স্ট্র্যাটাস
সাদা থেকে ধূসর রঙের এই মেঘ আকাশে কুয়াশার মত ছেয়ে থাকে। পাহাড়ের উঁচু অংশে এই মেঘ জমলে পর্বতারোহী ও বিমানচালকের পক্ষে অসুবিধাজনক। এই মেঘের জন্যে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিপাত হয়।
• নিম্বাস বা বাদল মেঘ
এই মেঘ এর গাড় ধূসর বা কালো রঙের। ভূপৃষ্ঠের খুব কাছেই এই মেঘে আকাশ ঢেকে থাকে। আকাশে মেঘ জমলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
• নিম্বো স্ট্র্যাটাস
বর্ষাকালে এই মেঘ আকাশে স্তরে স্তরে জমা হয়। ঘন, পুরু, ধূসর থেকে কালো রঙের এই মেঘ খারাপ আবহাওয়াকে নির্দেশ করে। এই মেঘের কোন নির্দিষ্ট আকৃতি নেই। আকাশে মেঘ জমলে একটানা বৃষ্টিপাত ও শিলাবৃষ্টি হয়ে থাকে।
অবস্থান অনুযায়ী এই এত প্রকারের মেঘ ছাড়াও উল্লম্ব প্রকৃতির দুটি মেঘ প্রকৃতিতে দেখতে পাওয়া যায়। যথা-
• কিউমুলাস
এই মেঘ লম্বালম্বিভাবে গম্বুজ আকারের মত বিস্তৃত হয়। এই মেঘের শীর্ষদেশ অনেকটা উঁচু। এই মেঘের উপর দিয়ে উজ্জ্বল সূর্যালোক দেখা যায়। আকাশে এই মেঘ পরিষ্কার আবহাওয়া নির্দেশ করে।
• কিউমুলোনিম্বাস
অনেকটা গম্বুজের মত দেখতে এই মেঘ সাদা-ধূসর ও কালো রঙের হয়। সাধারণত ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুস্তর, থেকে প্রায় ৯০০০ মিটার পর্যন্ত এই মেঘের লম্বালম্বি বিস্তার দেখা যায়। কালবৈশাখীর সময় এই মেঘ উত্তর পশ্চিম আকশে দেখা যায়। আকাশে মেঘ জমলে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাত হয় ফলে, এই মেঘের আরেক নাম বজ্রমেঘ।
মেঘ সৃষ্টির প্রক্রিয়া
মেঘ জলীয় বাষ্প দিয়ে তৈরি। সূর্যের তাপে সমুদ্র, নদী, পুকুরের জল উত্তপ্ত হয়ে বাষ্পে পরিণত হয়ে বায়ুতে মেশে। এছাড়াও গাছপালার বাষ্পমোচনের ফলে বাতাসে জলীয় বাষ্প জমা হয়। এই জলীয় বাষ্প বাতাসের চেয়ে হালকা বলে এটি সহজে উপরের দিকে উঠতে থাকে। অপরের শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে এই জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা তত কমে যায়। ধীরে ধীরে ঐ আর্দ্র বায়ুর তাপমাত্রা শিশিরাঙ্কে পৌঁছায় এবং বায়ু সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। এই সম্পৃক্ত বায়ু আরও শীতল হলে জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে ছোট ছোট জলকণায় পরিণত হয়। এই জলকণা বায়ুতে ভাসমান ধূলিকণা, লবণকণাকে অবলম্বন করে মেঘ হিসেবে ভেসে বেড়ায়। সাধারণত মেঘের জলকণার ব্যাস হয় ০.০২ মিলিমিটারের। বায়ুমণ্ডলের ট্রপোস্ফিয়ারে মেঘের সৃষ্টি হয়।
অধঃক্ষেপণ এর ধারণা
পৃথিবীর অভিকর্ষ টানের প্রভাবে বায়ুমণ্ডল থেকে জলকণা বা বরফকণা (তরল বা কঠিন অবস্থায়) ভূপৃষ্ঠে নেমে এলে তাকে বলে অধঃক্ষেপণ। বৃষ্টিপাত হল প্রধান অধঃক্ষেপণ। সম্পৃক্ত জলকণা মেঘের মধ্যে মিলিত হয়ে আকারে বড় হয়ে ভারী হলে বাতাসে ভেসে থাকতে পারেনা, ফলে প্রথিবির অভিকর্ষ টানের প্রভাবে বৃষ্টির আকারে ঝরে পড়ে।
বৃষ্টিপাতের প্রকারভেদ
১) পরিচলন বৃষ্টিপাত
যেসব অঞ্চলে সূর্যরশ্মি সারাবছর লম্বভাবে পড়ে এবং যেখানে জলভাগের বিস্তার বেশি সেখানে বাষ্পীভবনের পরিমাণ বেশি হয়। এই উষ্ণ ও হালকা বায়ু উপরের দিকে উঠে প্রসারিত হয়। উপরের বায়ুমণ্ডলের শৈত্যের সংস্পর্শে এসে ঘনীভবনের ফলে জলীয় বাষ্প জলকণায় পরিণত হয়, ও বাতাসে ভাসমান ধূলিকণাকে আশ্রয় করে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ গঠন করে। অবশেষে এই মেঘ আরও ঘনীভূত হলে জলকণাগুলি বৃষ্টি রূপে পৃথিবীতে ঝরে পড়ে। নিরক্ষীয় অঞ্চলে বিকেলে প্রতিদিন বজ্রবিদ্যুৎসহ মুষলধারে এই পরিচলন বৃষ্টিপাত হয়। কঙ্গো ও আমাজন অববাহিকা, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে সারাবছর পরিচলন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
২) শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত
সমুদ্রের দিক থেকে আসা জলীয়বাষ্পযুক্ত আর্দ্র বায়ুর প্রবাহ পথে আড়াআড়িভাবে কোন পর্বত বা উচ্চভূমি অবস্থান করলে ঐ বায়ু পর্বত বা উচ্চভূমিতে বাধা পেয়ে ঐ পর্বতের ঢাল বেয়ে অপরের দিকে উঠে যায়। ঊর্ধ্বগামী এই বায়ু ক্রমশ প্রসারিত হয় ও ঠাণ্ডা হয়। আরও ওপরে উঠলে এই বায়ু সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে এবং ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই বৃষ্টিপাত হল শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত।
৩) ঘূর্ণ বৃষ্টিপাত
উষ্ণ ও জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস ও ঠান্ডা বাতাস ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে পরস্পরের মুখোমুখি হলে উষ্ণ বাতাস শীতল বায়ুস্তরের সীমারেখা ধরে উচ্চ ঢালে উপরে উঠতে থাকে। ফলে সেখানে বায়ুর চাপ কমে গিয়ে নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়। চারিদিক থেকে ছুটে আসা শুকনো, ঠান্ডা ও ভারী বাতাসের ওপর জলীয় বাষ্পপূর্ণ গরম বাতাস উঠে যাওয়ার জন্যই ঘূর্ণবাত বৃষ্টিপাতের সৃষ্টি হয় । ঘূর্ণবাত বৃষ্টি সাধারণত দীর্ঘ সময় ধরে ঝিরঝির করে পড়ে ।উষ্ণ জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে বৃষ্টিপাত ঘটায় । আবার জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু ঘূর্ণবাতের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নিম্নচাপের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে উপরে উঠে শীতল হয়ে যে বৃষ্টিপাত ঘটায়, তাকে ঘূর্ণবাত বৃষ্টি বলে।
ঘূর্ণবাত বৃষ্টি দুই ধরনের, যথা:- ক) ক্রান্তীয় ঘূর্ণবৃষ্টি এবং খ) নাতিশীতোষ্ণ ঘূর্ণবৃষ্টি ।
এছাড়াও আরও কয়েকপ্রকার অধঃক্ষেপণগুলি হল –
i. খুব ছোট জলকণা (০.৫ মিলিমিটারের কম ব্যসযুক্ত) বৃষ্টিপাতকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি বলে।
ii. জলকণা ও তুষারকণার আংশিক মিশ্রিত রূপ হল স্লিট।
iii. ঊর্ধ্বমুখী সম্পৃক্ত বায়ুতে উপস্থিত জলকণা অনেকসময় ঠাণ্ডা হয়ে বরফের টুকরোতে পরিণত হয়ে যায়, এই বরফের টুকরো, বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টিপাতে ভূপৃষ্ঠে ঝরে পরে।
iv. উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে জলকণা বরফে পরিণত হয়, অভিকর্ষ বলের প্রভাবে এই বরফ তুষারপাত রূপে ভূপৃষ্ঠে ঝরে পরে।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব →জলবায়ু অঞ্চল
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
VIII_Geo_5a