taper-folsorup-kichu-ghotona
WB-Class-9

তাপের ফলস্বরূপ কিছু প্রাকৃতিক ঘটনা

ভৌতবিজ্ঞাননবম শ্রেনি – অধ্যায়: তাপ (তৃতীয় পর্ব)

তাপ সঙ্ক্রান্ত আলোচনায় এর আগের পর্বগুলিতে আপেক্ষিক তাপ এবং লীনতাপ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তৃতীয় পর্বে আমরা তাপের ফলস্বরূপ বিভিন্ন দৈনন্দিন প্রাকৃতিক ঘটনা সম্পর্কে পরিচিতি লাভ করবো।

সূর্য যেহেতু পৃথিবীর তাপ শক্তির মূল উৎস, সূর্যের তাপে সর্বদাই পৃথিবীর জলাশয় গুলি থেকে জলীয় বাষ্প সৃষ্টি হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশছে। বায়ুমণ্ডলে মিশে থাকা এই জলীয় বাষ্পই বায়ুর আর্দ্রতা নামে পরিচিত।

গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার পরিমাণ বেশি থাকায় বাষ্পীভবন বেশি হয় ফলে বায়ুতে আর্দ্রতার পরিমানও বৃদ্ধি পায়। তাই গ্রীষ্মকালে আমাদের শরীরে ঘাম হয়।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

এখন বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প মেশার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আছে।

আসলে এক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি বায়ুমণ্ডলে যেন দ্রাবক আর জলীয় বাষ্প হল দ্রাবকোন স্থানের বায়ুতে জলীয় বাষ্প মিশতে মিশতে যদি সেই বায়ু আর জলীয় বাষ্প গ্রহনের ক্ষমতা হারায় অর্থাৎ এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে ঐ বায়ুতে আর জলীয় বাষ্প না মিশতে পারে তবে ঐ বায়ুকে সম্পৃক্ত বায়ু বলে।

তবে এক্ষেত্রেও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সম্পৃক্ত দ্রবণ সৃষ্টির মত সম্পৃক্ত বায়ুর ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা থাকে এবং তাপমাত্রার পরিবর্তনে তায়ুর জলীয়বাষ্প ধারন ক্ষমতাও পরিবর্তিত হয়।

সাধারণত গ্রীষ্মকালে বা অধিক তাপমাত্রার সময় বায়ুর জলীয় বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং শীতকালে তাপমাত্রা হ্রাস পেলে জলীয়বাষ্প ধারনক্ষমতা হ্রাস পায়।

এখন আমরা যে বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করবো তা হল আপেক্ষিক আর্দ্রতা।

আপেক্ষিক আর্দ্রতা কাকে বলে?

সাধারণত কোন স্থানে বায়ুর আর্দ্রতা এই আপেক্ষিক আর্দ্রতা রাশিটির সাহায্যে পরিমাপ করা হয়।

আপেক্ষিক আর্দ্রতা হল কোন স্থানের বায়ুতে থাকা জলীয় বাষ্প ঐ স্থানের বায়ু সম্পৃক্ত হলে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প থাকত তার শতাংশ।

এখন ধরা যাক কোন স্থানের বায়ুতে জলীয় বাস্পের পরিমাণ = V1 লিটার। এখন ঐ বায়ু সম্পৃক্ত থাকলে জলীয় বাস্পের পরিমাণ হয় V লিটার। সুতরাং আপেক্ষিক আর্দ্রতা হল – 

\left ( \frac{V_{1}}{V} \times 100 \right )% %

এখন আমরা একটা বিষয় খেয়াল করে থাকব, যে তাপমাত্রা যত হ্রাস পায় অর্থাৎ শরৎ থেকে যত শীতকালের দিকে অগ্রসর হয় যত শিশির জমতে দেখি। এই শিশির কিন্তু বড় গাছের পাতা বা ডালে জমতে দেখা যায় না। শিশির জমে মূলত মাটির কাছাকাছি যে সকল গাছ থাকে যেমন ঘাস, ছোট গাছ ইত্যাদিতে।

এখন প্রশ্ন হল শিশির জমে কেন?

এর উত্তর হল বায়ুর উষ্ণতা শিশিরাঙ্কের নিচে নেমে গেলেই বায়ুতে উপস্থিত জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে জলকনায় পরিণত হয় যা শিশির নামে পরিচিত।

এখানে আবার একটা নতুন প্রশ্ন এসে উপস্থিত যেটা হল, শিশিরাঙ্ক কি?

শিশিরাঙ্ক হল সেই উষ্ণতা যে উষ্ণতায় কোন স্থানের বায়ু, ঐ বায়ুতে যে পরিমাণ জলীয় বাষ্প থাকে তা দিয়েই সম্পৃক্তাতা লাভ করে।

এখন আমরা যদি শিশিরাঙ্ককে আপেক্ষিক আর্দ্রতার দৃষ্টিকোন থেকে দেখি তবে দেখব, যে গ্রীষ্মকালে বায়ুতে V1 ও V এর মান প্রায় সমান। সুতরাং গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার সামান্য হ্রাসই বায়ুকে সম্পৃক্ত করতে পারে এবং পরিস্থিতি শিশিরাঙ্কের নিচে নিয়ে যেতে পারে।

কিন্তু গ্রীষ্মকালে কোনদিনই শিশির পড়তে পারে না। এর কারণ হল গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশি থাকায় বায়ুতে পরিচলন স্রোত চলতে থাকে ফলে বায়ু প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। ফলে কোন স্থানে বায়ু স্থির না থাকায় কখনই তা ঐ স্থানের জলীয় বাষ্প দ্বারা সম্পৃক্ততা লাভ করতে পারে না। তাই গ্রীষ্মকালে শিশির পড়ে না।

এখন শিশিরের কথা যখন প্রথম উল্লেখ করা হয়েছিল তখন বলেই দেওয়া হয়েছিল যে, শিশির মাটির কাছাকাছি থাকা ঘাস বা ছোট গাছেই জমে কেন?

এর উত্তর হল, বিকরণ পদ্ধতিতে আশা তাপ প্রথমে ভু – পৃষ্ঠকেই উতপ্ত করে। এরপর তা ধীরে ধীরে সংলগ্ন বায়ুস্তর গুলিকে উতপ্ত করে। ফলে তখন তাপ ছাড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় তখন ভু – পৃষ্ঠই আগে শীতল হয় এবং ভু – পৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু স্তরও ধীরে ধীরে শীতল হয়। এই কারণে ভু-পৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ু স্তরই সবচেয়ে আগে শিশিরাঙ্কে পৌছায় তাই ঐ স্থানের বায়ুর মধ্যে থাকা জলীয় বাষ্পই ঘনীভূত হয়ে শিশিরে পরিণত হয় তাই মাটির বা ভু-পৃষ্টের কাছাকাছি ছোট গাছ বা ঘাসেই শিশির জমতে দেখা যায়।

এরপর যে বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হবে কুয়াশা, অনেক কুয়াশা বা শিশির একই প্রকার বলে মনে করে থাকে কিন্তু শিশির ও কুয়াশার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যই হল শিশির কেবল ভোরের দিকেই সৃষ্টি হয় কিন্তু কুয়াশা বিকেল, রাত বা ভোর বিভিন্ন সময়েই তৈরি হতে পারে। আসলে কুয়াশা তৈরি হওয়ার জন্য বায়ুর উষ্ণতা শিশিরাঙ্কের নিচে নামার কোন প্রয়োজন হয় না।

কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল (সৌজন্যে OutlookIndia)

বায়ুতে ধূলিকণার পরিমাণ বেশি থাকলে এবং বায়ুর তাপমাত্রা যদি সামান্য কমে যায় তাহলেই বায়ুর মধ্যে থাকা জলীয়বাষ্প ধুলিকনাকে আশ্রয় করে ঘনীভূত হয়ে কুয়াশার সৃষ্টি করে। মূলত শহর বা শিল্পাঞ্চলে যেখানে বাতাসের ধূলিকণার পরিমাণ বেশি সেখানেই অধিক কুয়াশা তৈরি হয়। প্রকারান্তরে বলা যায় কুয়াশার সৃষ্টি কিন্তু বায়ুদূষণের মাত্রাকেই নির্দেশ করে।

শিশির ও কুয়াশার পার্থক্য

শিশির কুয়াশা
শিশির সৃষ্টির জন্য বায়ুকে ঐ স্থানের জলীয় বাষ্প দ্বারা সম্পৃক্ত হতে হয়। এর জন্য বায়ুর সম্পৃক্ততার কোন প্রয়োজন নেই।
বায়ুর উষ্ণতা শিশিরাঙ্কের নিচে নামা অবশ্যই প্রয়োজন। বায়ুর উষ্ণতা স্বাভাবিক অপেক্ষা সামান্য কম হলেই কুয়াশার সৃষ্টি সম্ভব।
এক্ষেত্রে বাতাসে উপস্থিত ধূলিকণার কোন ভূমিকা নেই। বাতাসে উপস্থিত অধিক পরিমাণ ধূলিকণাই কুয়াশা সৃষ্টির সহায়ক।
মূলত ভোরের দিকেই সৃষ্টি হয়। সন্ধ্যা থেকে ভোর যে কোন সময়েই হতে পারে।

জলের ব্যতিক্রান্ত প্রসারণ (Anomalous expansion of water)

আমরা জানি কোন বস্তুকে তাপ দিলে তা আয়তনে প্রসারিত হয়। কিন্তু জলের ক্ষেত্রে এই ঘটনার একটি ব্যাতিক্রম দেখা যায়। 0°C উষ্ণতা থেকে জলে যদি তাপ দেওয়া হয় তবে উষ্ণতা বাড়ার সাথে সাথে জলের আয়তন, কমতে থাকবে অর্থাৎ জল সঙ্কুচিত হতে থাকবে এবং এই ঘটনা চলবে 4°C উষ্ণতা পর্যন্ত। সুতরাং থেকে 0°C পর্যন্ত 4°C জলের এইরূপ ব্যাতিক্রমী প্রসারণ বা সংকোচনকেই জলের ব্যাতিক্রান্ত প্রসারণ বলে।

আমরা যদি এই ঘটনাকে লেখচিত্রের সাহায্যে প্রকাশ করি তবে তা নিম্নরূপ হবে –

expansion of water

উপরোক্ত লেখচিত্র AB জলের ব্যাতিক্রান্ত প্রসারণ নির্দেশ করে। লেখচিত্রটি থেকে এটাও পরিষ্কার যে 4°C উষ্ণতাতেই জলের আয়তন সবচেয়ে কম হয়। অর্থাৎ এটাও বলা যায় যে 4°C উষ্ণতাতেই জল ঘন এবং ভারী হয়।

প্রকৃতিতে জলের ব্যাতিক্রান্ত প্রসারণের গুরুত্ব অপরিসীম।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

মূলত শীত প্রধান দেশে যেখানে তাপমাত্রা প্রায়শই শূন্যের নিচে নেমে যায় সকল স্থানের জলাশয় গুলিতে উপরে বরফ জমলেও ব্যাতিক্রান্ত প্রসারণের কারণে নিচে কিন্তু জলই থাকে। এটা কিভাবে সম্ভব তা নিচে ব্যখ্যা করা হল।

পারিপার্শ্বিক-এর উষ্ণতা যখন ধীরে ধীরে কমতে থাকে, তখন সংস্পর্শে থাকা জল অর্থাৎ জলাশয়ের উপরের অংশের জলের তাপমাত্রাও সেই অনুসারে কমতে থাকে। সুতরাং জলাশয়ের নিচের অংশ অপেক্ষা উপরের অংশের জলের তাপমাত্রা কমে গেলে তা ভারী হয়ে যায় ফলে নিচে নেমে আসে এবং নিচের জল উপরে উঠে যায়। অর্থাৎ জলের মধ্যে একটা পরিচলন স্রোত চলতে থাকে।

water-on-marine-life

কিন্তু যখন পারিপার্শ্বিকের তাপমাত্রা 4°Cতে পৌছায় তখন উপরের অংশের জলও 4°C তে পৌছায় ও সবচেয়ে ঘন বা ভারী হওয়ার কারণে তা নিচে নেমে যায় এবং আর উপরে উঠতে পারে না। এই অবস্থায় জলাশয়ের নিচের অংশের জল উপরে ওঠে এবং পরিচনল স্রোত বন্ধ হয়ে যায় এবং উপরের পারিপার্শ্বিকের তাপমাত্রা আরও কমলে ব্যাতিক্রান্ত প্রসারণের কারণে উপরের জলের আয়তন বেড়ে যায় ফলে হাল্কা হওয়ার কারণে তা উপরের থেকে যায়। এরপর ক্রমশ উপরের অংশের জলের তাপমাত্রা আরও কমে তা বরফে পরিণত হয়।

এখন বরফ যেহেতু তাপের কুপরিবাহী তাই নিচের অংশের জল থেকে তাপ যেমন নিষ্কাশিত হতে পারেনা তেমনই উপরের শীতল অবস্থা বরফ ভেদ করে নিচের অংশে পৌঁছাতেও পারে না ফলে জলাশয়ের উপরে বরফ জমলেও নিচের অংশে জলই থাকে ফলে জলজ জীবেরা সহজেই বেঁচে থাকতে পারে।

আরো পড়ো → কার্য, ক্ষমতা ও শক্তি


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX_PSc_6C

Dr. Mrinal Seal
ডঃ মৃণাল শীল সাঁতরাগাছি উচ্চ বিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার একজন জনপ্রিয় শিক্ষক। পড়াশোনার পাশাপাশি ঘুরে বেড়াতে ও নানান ধরণের নতুন নতুন খাবার খেতেও পছন্দ করেন ডঃ শীল।