ভৌতবিজ্ঞান – নবম শ্রেণি – অধ্যায়: পদার্থঃ গঠন ও ধর্ম (চতুর্থ পর্ব)
আমরা আগের পর্বগুলিতে প্রবাহীর চাপ এবং আর্কিমিডিসের সূত্র সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমরা তরলের প্রবাহের কারন হিসাবে চাপের পার্থক্যকে অন্যতম কারন হিসাবে জেনেছি। এখন তরলের হিসাবে আমরা আরও একটি বিষয় আলোচনা করব, যা হল তরলের পৃষ্ঠটান।
তরলের পৃষ্ঠটান
আমরা দৈনন্দিন জীবনে বেশ কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয়ে থাকি,যেমন কিছু কীট পতঙ্গ অনায়াসেই তরল পৃষ্ঠের উপর হেঁটে বেড়াতে পারে, এমনকি তাদের পা জলে ভিজে যায় না। আবার জমে থাকা জলের উপর কিছুটা সাবানের ফেনা বা থুতু ফেললে দেখা যায় ঐ ফেনাকে কেউ যেন চারপাশ থেকে টেনে নিল এবং সমস্ত ফেনা অদৃশ্য হয়ে গেল।
অর্থাৎ এই ঘটনাগুলি থেকে বোঝা যায় যে তরল পৃষ্ঠে এক প্রকার টান কাজ করে।
এবার প্রশ্ন হল এই তরল পৃষ্ঠে টানের উদ্ভবের কারন কি?
কারন হিসাবে যেটি বলা যায় তা হল মূলত তরলের মধ্যস্থ অনুগুলির নিজেদের মধ্যে ক্রিয়াশীল আভ্যন্তরীণ বল যা inter molecular force (আন্তঃআনবিক আকর্ষন বল)।
উপরের চিত্রটিতে আমরা কোন পাত্রে রাখা তরলকে দেখতে পাচ্ছি, এখন কল্পনা করে নেওয়া হল যে তরলের মধ্যে A (যে কোন বিন্দু) অবস্থানে তরলের কোন একটি অনু আছে। যেহেতু তরল মধ্যস্থ এই অনুটিকে ঘিরে সব দিকেই অসংখ্য একই তরলের আরও অনু বর্ত্তমান সুতরাং A অবস্থানের অনুটি সব দিকেই সমান আকর্ষন বল অনুভব করবে ফলে অনুটির উপর ক্রিয়াশীল লব্ধি বলের পরিমাণ হবে শূন্য।
এখন যে সকল অনুগুলি তরল পৃষ্ঠের কাছাকাছি রয়েছে সেই অনুগুলির কিন্তু সব দিকে ঐ একই তরলের অনু থাকা সম্ভব নয়। ফলে পৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা অনুগুলি তার নিচের অনুগুলির কারনে নিম্নমূখী লব্ধি বল অনুভব করে।
উপরে কেবল মাত্র তরলের পৃষ্ঠের অনুগুলিকে নিয়ে একটি চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে তরল পৃষ্ঠে থাকা সকল অনুই নিম্নাভিমুখী বল অনুভব করছে, কেবল ‘P’ ও ‘Q’ বিন্দু ছাড়া। আসলে এই ‘P’ ও ‘Q’ বিন্দু হল তরল পৃষ্ঠ ও যে পাত্রে তরল রাখা আছে তার সংযোগস্থল। এই স্থানের অনুগুলি আরও এক প্রকার বল পাত্রের গায়ের সঙ্গে লম্ব ভাবে বাইরের দিকে অনুভব করে, যার উৎস হল পাত্রের পদার্থের অনু ও তরলের অনুগুলির মধ্যে আকর্ষন বল।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে তরল পৃষ্ঠের অনুগুলি বিশেষ করে যে অনুগুলি পাত্রের দেওয়ালের কাছাকাছি থাকে তারা দুই প্রকার বলের সম্মুখীন হয় তারা হল →
(১) তরলের নিজের অনুগুলির কারনে নিম্নমুখী লব্ধি আকর্ষন বল (এটি সংশক্তি বল নামেও পরিচিত)
(২) পাতের অনুগুলির কারনে পাতের দেওয়ালের কাছাকাছি থাকা অনুগুলির উপর প্রযুক্ত আনবিক বল (এটি আসঞ্জন বল নামেও পরিচিত) মূলত এই সংশক্তি ও আসঞ্জন বলের লব্ধির প্রভাবেই পৃষ্ঠটানের সৃষ্টি হয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
এখন প্রশ্ন হল পৃষ্ঠটান কি আমরা মাপতে পারি?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে এটা জানা প্রয়োজন যে পৃষ্ঠটানের ফলে সত্যিই কি তরল পৃষ্ঠের কোন পরিবর্ত্তন হয়।
উত্তর হল ‘হয়’। এই কারনেই আমরা গ্লাসে জল রেখে তার পৃষ্ঠ দেশ ভাল করে খেয়াল করলে দেখব যে তা একেবারে সমতল নয় বরং অবতল।
কিংবা কাঁচের পাত্রে পারদপূর্ন করলে পারদ পৃষ্ঠ উত্তল থাকে।
আসলে একটা ব্যাপার জেনে রাখা ভাল যে, যে সকল তরল কোন পাত্রে রাখলে যদি ঐ পাত্রের দেওয়াল ভিজে যায় তবে ঐ পাত্রে তরলটি রাখলে তার পৃষ্ঠদেশ অবতল এবং যদি পাত্রের দেওয়াল তরল দ্বারা না ভিজে যায় তবে তরল পৃষ্ঠ উত্তল হবে।
যাই হোক আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পৃষ্ঠটানের কারনে তরল পৃষ্ঠ সমতল থেকে হয় উত্তল বা অবতল আকৃতি ধারন করে অর্থাৎ তরল পৃষ্ঠের ক্ষেত্র ফল বৃদ্ধি পায়।
আসলে এই ক্ষেত্রেফল বৃদ্ধির জন্য যে প্রয়োজনীয় শক্তি তা তরল লাভ করে পৃষ্ঠটান বলের কারনে, যা স্থিতি শক্তি হিসাবে তরল পৃষ্ঠে সঞ্চিত থাকে।
আরো একটি বিষয় জানা প্রয়োজন, পৃষ্ঠটান যে বিষয়ের উপর নির্ভর করে সেটি হল তাপমাত্রা।
সাধারন ভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে কোন তরলের পৃষ্ঠটান হ্রাস পেতে থাকে।
স্পর্শ কোণ (Angle of contact)
আমরা আগেই জেনে ফেলেছি যে পৃষ্ঠটানের তারতম্য জনিত কারনে কোন তরল পৃষ্ঠ উত্তল আবার কোন তরল পৃষ্ঠ অবতল হয়ে থাকে। তবে এই উত্তল বা অবতল তরল পৃষ্ঠের প্রকৃতিকে আমরা একটু অন্য আঙ্গিকে ব্যাখ্যা করতে পারি। তা হল স্পর্শ কোনের স্বাপেক্ষে।
স্পর্শ কোন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তরলের শেষ প্রান্ত বিন্দু যা পাত্রের গায়ে লেগে আছে সেটিকে নির্ণয় করা (A বিন্দু উভয় ক্ষেত্রেই) অত্যন্ত জরুরী। অতঃপর এই বিন্দু থেকে তরলের গা বরাবর একটি স্পর্শক (AB) অঙ্কন করতে হবে। এই স্পর্শক AB তরলের মধ্য দিয়ে পাত্রের দেওয়ালের সঙ্গে যে কোন উৎপন্ন করে তাই হল স্পর্শ কোন বা Angle of contact।
মনে রাখা প্রয়োজন, যে স্পর্শ কোন যদি সূক্ষ্ণ কোন হয় তবে তরল পৃষ্ঠ অবতল হয় এবং তা পাত্রের দেওয়ালকে ভিজিয়ে দেয়।
অন্যদিকে যদি স্পর্শ কোন স্থল কোন হয় তবে তরল পৃষ্ঠ উত্তল হয় এবং তা পাত্রের দেওয়ালকে ভেজায় না।
আমরা পৃষ্ঠটান বিষয়টি শুরু করার সময় বেশ কিছু দৈনন্দিন ঘটনার উদাহরন দিয়েছিলাম। যেমন জলের উপর বেশ কিছু পোকা অনায়াসেই হেঁটে বেড়াতে পারে কিন্তু তারা ভিজে যায় না, কিংবা কচু পাতার উপর জলের ফোঁটা পড়লে তা গোলাকার হয় এবং কচু পাতা ভেজে না।
আসলে এই সব ক্ষেত্রে জল এবং উক্ত সকল বস্তুর গায়ের সাথে যে স্পর্শ কোন হয় তা স্থুল কোন হয়ে থাকে।
এবার আমরা পৃষ্ঠটান সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নের আলোচনা করবো।
বৃষ্টির ফোঁটা বা জল বিন্দু সাধারণত গোলাকার হয় কেন?
আমরা পৃষ্ঠটান বিষয়টা শুরু করার সময়েই উল্লেখ করেছিলাম যে তরলের পৃষ্ঠটান তরলের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি জনিত কারনে সৃষ্টি হয় এবং তা তরল পৃষ্ঠের অনুগুলির মধ্যে স্থিতি শক্তি হিসাবে সঞ্চিত থাকে।
আমরা জানি, যে কোন বস্তুই তাদের সুস্থির অবস্থা বজায় রাখার জন্য স্থিতি শক্তির নিম্নতম স্তরে থাকতে চায়। আবার প্রকৃতিতে, গোলাকাকার বস্তুর পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল অন্যান্য আকার অপেক্ষা কম হয়। ফলে পৃষ্ঠটান জনিত যে স্থিতিশক্তি তাও কম হয়। ফলে গোলাকাকার অবস্থাতেই তরল পৃষ্ঠটান জনিত স্থিতি শক্তির নিম্নতম অবস্থায় থাকতে পারে। তাই বাধাহীন ভাবে পড়তে থাকা জলবিন্দু বা বৃষ্টির ফোটা গোলাকাকার হয়।
স্টীলের সূঁচ বা লোহার ব্লেডকে অনেক সময় জলে ভাসানো যায় কি ভাবে?
আমরা ১ নং চিত্রানুযায়ী ব্লেডটিকে তরল পৃষ্ঠের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে যদি ধীরে ধীরে ভাসিয়ে দিতে পারি তবেই ব্লেডটি তরলে ভাসতে পারে।
২ নং চিত্রের মত করে ব্লেডকে ভাসাতে চেষ্টা করলে তা কখনই ভাসবে না। আমরা যদি ব্লেড জলে ভাসার কারন পর্যালোচনা করি তবে দেখা যায় যে ব্লেডের নিজের ওজন জনিত যে নিম্নমূখী বল তা দুই প্রকার বল দ্বারা প্রতিমিত হয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
(ক) ব্লেড কর্ত্তৃক অপসারিত তরলের কারনে উর্দ্ধমূখী প্লবতা বল এবং (খ) পৃষ্ঠটান জনিত বল।
এক্ষেত্রে প্রথমটি অপেক্ষাও দ্বিতীয় শর্তটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। আসলে তরল পৃষ্ঠে থাকা অনুগুলি নিজেদের মধ্যে আন্ত রানবিক আকর্ষন বলের কারনে পরস্পর যুক্ত হয়ে একটি পাতলা চাদরের ন্যায় আচরন করে। এই অবস্থায় ব্লেডটিকে তরল পৃষ্ঠের সমান্তরাল ভাবে ফেললে ব্লেড জনিত ওজনের কারনে নিম্নমূখী যে চাপ সৃষ্টি হয় তা উক্ত পাতলা চাদরের ন্যায় তলের আস্তরণকে ছিন্ন করতে পারে না।
এছাড়াও ব্লেডকে উক্ত রূপে ভাসানো হলে ব্লেডের কিনারার সঙ্গে তরল পৃষ্ঠের কোন হয় স্থূল কোণ (৪ নং চিত্রানুযায়ী)। আমরা আগেই জেনেছি যে স্পর্স কোণ স্থূল কোণ হলে তরল ভিজিয়ে দেয় না। ফলে তরল বা জল ব্লেডের উপরের তলে উঠে আস্তে পারে না। ফলে ব্লেড ভেসে থাকে।
সরু সূঁচ বা পেপার ক্লিপকেও একই ভাবে জলে ভাসানো যায়।
চতুর্থ পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব পড়ুন → তরলের সান্দ্রতা।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-PSc-3d