ভূগোল – নবম শ্রেণি – দুর্যোগ ও বির্পযয় (ষষ্ট অধ্যায়)
এই পর্বে আমরা দুর্যোগ, বির্পযয় ও তার শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করবো।
পরিবেশের ভারসাম্য অবস্থার কোনোরকম বিচ্যুতি যদি মানুষের জীবনযাত্রাকে বিঘ্নিত করে তবে তাকে দুর্যোগ বলে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই দুর্যোগ সৃষ্টি হয় প্রাকৃতিক কারনে। দুর্যোগের দ্বারা মানুষ ও সম্পদের ক্ষয় ক্ষতি হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কিন্তু, বিপুল হারে ক্ষয়ক্ষতি কতটা মাত্রায় করছে তার উপর নির্ভর করে আমরা বলতে পারি সেটা দুর্যোগ না বিপর্যয়।
যেমন বলা যেতে পারে যে কোনো বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প মানুষ বা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কতটা পরিমাণ করছে তার উপর নির্ভর করছে সেটি দুর্যোগ না বিপর্যয়। এই দুর্যোগ যখন সম্পদহানি ও বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনহানি ঘটায় এবং অন্যের সাহায্য (আন্তর্জাতিক) ছাড়া মোকাবিলা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, তখনই তাকে বিপর্যয় বলে।
এই অধ্যায়ের আলোচনার বুঝে নাও এই ভিডিও থেকে ↓
বিপর্যয় হল দুর্যোগের পরবর্তী অবস্থা।
দুর্যোগ
ফরাসী শব্দ ‘hasard’ থেকে ইংরাজীতে ‘hazard’ শব্দটি এসেছে, যার বাংলা অর্থ হল দুর্যোগ। কোনো ঘটনা আমরা তখনই দুর্যোগ বলি এটি খুব কম সংঘঠিত হয়।
দুর্যোগের বৈশিষ্ট্য
i) দুর্যোগ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে।
ii) প্রকৃতি হল দুর্যোগ সৃষ্টির প্রধান কারিগর তবে মানুষ নিজের অবিবেচনামূলক কাজের জন্য দুর্যোগ ডেকে আনে।
iii) দুর্যোগে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ হয় না।
iv) ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হওয়ায় দেশীয় অর্থনীতির উপর চাপ পড়ে না।
বিপর্যয়
‘disaster’ শব্দটি এসেছে ফরাসী শব্দ desastre থেকে। যেখানে ‘Des’ শব্দের অর্থ হচ্ছে bad or evil star বা শয়তানের তারা। অতীতে মানুষ মনে করত শয়তান তারার প্রভাবেই প্রকৃতিতে বিপর্যয় নেমে আসে। যখন কোনো দুর্যোগ চরম আকার নিয়ে জীবন ও সম্পত্তি ক্ষতিসাধন করে, তখন তাকে বিপর্যয় বলে।
বির্পযয়ের বৈশিষ্ট্য
ক) বিপর্যয় হল এমন এক আকস্মিক ঘটনা যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে সাময়িকভাবে অথবা দীর্ঘকালীনভাবে স্তব্ধ করে দেয়।
খ) প্রকৃতির রোষে বিপর্যয় ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ-ই দায়ী।
গ) বির্পযয় বিপুল এলাকা জুড়ে হয়।
ঘ) বির্পযয়ের ফলে বিপুল সংখ্যায় প্রানহানি ঘটে।
ঙ) প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে, দেশীয় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও বেশী হয়।
বিভিন্ন বিপর্যয়ের সংক্ষিপ্ত ধারণা
বন্যা
বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় 75% বেশী বৃষ্টিপাত হলে তাকে বন্যা হিসাবে গন্য করা হয়, এরফলে বিপুল জলরাশি দ্বারা আবৃত ভূ-ভাগ জলমগ্ন হয়ে পড়ে। নদী অববাহিকায় অতি বৃষ্টি অথবা অন্য কোনো উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে জল চলে এলে নদী তা বহন করতে পারে না, ফলে নদীখাতের জল তীরের দিকে প্রসারিত হয়ে বন্যা ঘটায়। প্রতি বছর আমাদের পৃথিবীতে বন্যার ফলে প্রায় কয়েক হাজার লোকের মৃত্যু হয়, এবং 20 মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে অধিক বৃষ্টিপাত জনিত কারণে বন্যা দেখা দেয় দামোদর- রপনারায়ণ অববাহিকায় 1978 সালে।
বন্যার কারন
বন্যা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যেমন –
ক) একটানা বেশ কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাত হলে বন্যা হয়।
খ) হঠাৎ খুব ভারী বর্ষনের জন্য নদীর বহন ক্ষমতার তুলনায় জলের পরিমাণ বেড়ে বন্যা হয়।
গ) উপকূল অঞ্চলে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে বন্যা হয়।
ঘ) ধ্বস নামার জন্য নদীর গতিপথে বাধা সৃষ্টি হলে বন্যা হয়।
ঙ) জলাধার থেকে হঠাৎ অতিরিক্ত পরিমাণে জল ছাড়লে বন্যা দেখা দেয়।
চ) নদীতে বেশী সংখ্যায় সেতু নির্মান করলে গতিপথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এবং তার ফলে বন্যা হয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
ভারতের বন্যা প্রবণ অঞ্চল
ভারতের কেন্দ্রীয় জল কমিশনের মতে দেশের ১১% এলাকা বন্যাপ্রবণ। এই সব অঞ্চলগুলি হল -পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী, মহানন্দা, অজয়, দামোর, কংসাবতী, শিলাবতী, তিস্তা, তোর্সা প্রভৃতি নদীর উপত্যকা অঞ্চল; উত্তরপ্রদেশের ও বিহারের গোমতি, ঘর্ঘরা, কোশী, যমুনা, চম্বল প্রভৃতি নদী সংলগ্ন এলাকা।
খরা
কোনো অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টি না হলে ভৌমজলস্তর নেমে যায় বা বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় 75% এর কম বৃষ্টিপাত হলে যে শুষ্ক অবস্থার সৃষ্টি হয়, তাকে খরা বলে।
2000 সালে রাজস্থান ও ওড়িশায় কোটি কোটি মানুষ খরার কবলে পড়ে।
খরার কারণ
ক) মৌসুমি বায়ু দেরিতে এলে বা আগে ফিরে গিয়ে বৃষ্টি কম হলে খরা হয়।
খ) দুর্বল মৌসুমি বায়ুর কারণে স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টি কম হলে খরা দেখা দেয়।
গ) বর্ষাকাল একভাবে ১৫ দিন শুষ্ক থাকলে খরা হয়।
ঘ) পরিবেশ উষ্ণ ও শুষ্ক হয়ে উঠলে খরার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
ঙ) অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাছ কাটার ফলে জলীয়বাষ্পের জোগান কম হলে কৌশিক জল ও ভৌমজল কমে গেলে খরার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
ভারতের খরা প্র্রবণ অঞ্চল
উত্তরপ্রদেশের ঝাঁসি, মির্জাপুর; মধ্যভারতের তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র; দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক; মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলের রাজাস্থান, গুজরাট এবং ঝাড়খণ্ডের মধ্যাংশ ও ওড়িশার কালাহান্ডি প্রভৃতি খরাপ্রবণ অঞ্চল।
ঘূর্ণিঝড়
ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল ঝড় হল ঘূর্ণিঝড়।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণ
ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলে সমুদ্রের ওপর গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হলে তা পাশ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বায়ু সঞ্চয় করতে থাকে ও শক্তিশালী হতে থাকে। এইভাবে এই নিম্নচাপ ঘূর্ণাবর্তে পরিণত হয় এবং স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং স্থলভাগে এসে পতিত হয়ে অতিপ্রবল ঝড় বৃষ্টি ঘটায়।
ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিমবঙ্গে ২০০৯-এ আয়লা ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল, যা পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছিল।
ভারতের ঘূর্ণিঝড় প্র্রবণ অঞ্চল
ভারতের সমগ্র উপকূল বিশেষ করে পূর্ব উপকূলের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, তামিলনাডু, অন্ধ্রপ্রদেশ এই রাজ্যগুলিতে বেশী প্রভাব দেখা যায়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
ভূমিকম্প
মাটিতে হঠাৎ করে কম্পন অনুভূত হয় এবং পারিপার্শ্বিক সমস্ত কিছু ধূলিসাৎ হয়ে যায় ভূমিকম্পের প্রভাবে।
ভূমিকম্পের কারণ
পাতগুলির সঞ্চালনে চাপের হ্রাস
বৃদ্ধি, পাতের সরণ, অগ্নুৎপাত, শিলাস্তরের চ্যুতির সৃষ্টি, ভঙ্গিল পর্বতের উথ্থান প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণে এবং জলাধার নির্মাণ, পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ প্রভৃতি মনুষ্যসৃষ্ট কারণে ভূমিকম্প হয়ে থাকে।
2001-এ গুজরাটের ভুজের ভূমিকম্প একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
ভারতের ভূমিকম্প প্র্রবণ অঞ্চল-
ভারতের হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, গুজরাট, পশ্চিমঘাট পার্বত্য অঞ্চল, ডেকান ট্র্যাপ অঞ্চল, বিহার, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ প্রভৃতি ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল।
ভূমিধ্বস
যখন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে মাটি ও পাথরের স্তূপ অভিকর্ষের টানে নেমে আসে, তাকে ভূমিধ্বস বলে।
২০১০-এ লাদাখে এবং ২০১৩ তে উত্তরাখন্ডে হড়পাবান-জনিত ভূমিধ্বস প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়।
ভূমিধ্বসের কারন
ক) পার্বত্য অঞ্চলে শিলাস্তরে ফাটল তৈরি হলে তার ফাঁকে জল ঢুকে মাটি আলগা করে ফেলে, এরপর ঐ মাটি ও শিলাস্তর অভিকর্ষজ টানে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে ভূমিধ্বস সংগঠিত হয়।
খ) পাহাড়ি এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে রাস্তাঘাট নির্মাণ ও বাড়ি তৈরির কারণে অতিরিক্ত পরিমাণে গাছ কাটা হচ্ছে, ফলে মাটি হালকা হয়ে যাচ্ছে এবং ভূমিধ্বস হচ্ছে।
ভারতের ভূমিধ্বস প্র্রবণ অঞ্চল
পূর্ব হিমালয়ের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল প্রদেশ, উত্তরপূর্বের পাহাড়ি রাজ্জ্যসমূহ, পশ্চিম হিমালয়ের উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রাদেশ,দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি অঞ্চল।
সুনামি
বিশালাকার সামুদ্রিক জলোচ্ছাসকে জাপানি ভাষায় সুনামি বলা হয়।
2004 সালে ইন্দোনেশিয়ার সুনামী এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
সুনামির কারণ
ক) সমূদ্রগর্ভে শিলাধ্বস বা অগ্ন্যুৎপাত হলে বা বড়ো বরফের চাঁই পতিত হলে সুনামির উৎপত্তি হতে পারে।
খ) সমুদ্রগর্ভ বা সমূদ্রউপকূলে সাধারণত ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে ৮ অতিক্রম করলে সুনামি হয়ে থাকে।
ভারতের সুনামি প্র্রবণ অঞ্চল
ভারতের পূর্ব উপকূলের তামিলনাডু, ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশের উপকূলে সুনামির প্রভাব দেখা দেয়।
হিমানী সম্প্রপাত
পার্বত্য অঞ্চলে একসাথে প্রচুর তুষারপাত হলে হিমানী সম্প্রপাত ঘটে থাকে। পর্বতের উপর থেকে যখন বিশালাকার বরফের স্তূপ নেমে আসে, তখন তাকে হিমানী সম্প্রপাত বলে।
ভারতীয় উপমহাদেশে হিমানী সম্প্রপাত সাধারণত দেখা যায় না। ইউরোপের আল্পস পার্বত্য অঞ্চল, উত্তর আমেরিকার রকি পার্বত্য অঞ্চল এবং দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চলে এই বিপর্যয় দেখা যায়।
তুষারঝড়
শীতপ্রধান নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে প্রবল ঝড়ের সাথে তুষারপাত হলে, সেটিকে তুষারঝড় বা ব্লিজার্ড বলে।
এই দুর্যোগ সাইবেরিয়া, কানাডা ও ইউরোপের উত্তরের দেশগুলিতে দেখা যায়। ভারতে এই দুর্যোগ দেখা যায় না।
অগ্ন্যুৎপাত
ভূ-অভ্যন্তর থেকে গলিত তরল ম্যগমা বেরিয়ে এলে, তাকে অগ্ন্যুৎপাত বলে। আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ব্যারেন, নারকোন্ডাম দ্বীপ্পুঞ্জের আগ্নেয়গিরিতে মাঝে মাঝে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে থাকে।
দাবানল
বনভূমিতে ডালপালা থেকে যখন ভয়াবহ আগুন লেগে যায়, তখন তাকে দাবানল বলে। সেই আগুন সমগ্র বনভূমিতে ছড়িয়ে যায় এবং প্রায় সমগ্র বনভূমি ধ্বংস হয় ও প্রচুর পশুপাখির মৃত্যু হয়।
2020 সালে আমাজন জঙ্গলের দাবানলে প্রায় 2500 পাখি পুড়ে মারা যায়।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → দুর্যোগ, বিপর্যয়ের প্রকৃতি ও প্রভাব
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX_Geo_6a