agneo-porbot
WB-Class-9

আগ্নেয় পর্বত (Volcanic Mountains)

ভূগোলনবম শ্রেণি – ভূমিরূপ গঠনকারী প্রক্রিয়া ও পৃথিবীর বিভিন্ন ভূমিরূপ সমূহ (তৃতীয় পর্ব)

আমরা আগের পর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন ভূমিরূপ সম্পর্কে জেনেছি।

এই পর্বে আমরা আগ্নেয় পর্বত সম্পর্কে জেনে নেবো।

পাত সংস্থান তত্ত্বের ভিত্তিতে আগ্নেয় পর্বতের উৎপত্তির ধারণা

পৃথিবীর অন্তরভাগের অতিরিক্ত তাপমাত্রা ও ভূত্বকের দ্বারা প্রদত্ত চাপের ফলে এর অভ্যন্তরে অবস্থিত সকল পদার্থ স্থিতিস্থাপক ও গলন্ত অবস্থায় রয়েছে, একে ম্যাগমা বলা হয়।

কোনো কারণে স্থিতিস্থাপক অবস্থা বিনষ্ট হলে অভ্যন্তরের এই গলিত ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠের কোন ফাটল বা ছিদ্রের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে ভূপৃষ্ঠের উপরে লাভা হিসাবে সঞ্চিত হয়। সঞ্চিত লাভা পরে শীতল হয়ে পর্বতের আকার ধারণ করলে তাকে আগ্নেয় পর্বত বা সঞ্চয়জাত পর্বত বলে।

ভূ-অভ্যন্তরে অবস্থিত এই ম্যাগমা যখন কোন ফাটল বা ছিদ্র পথে ভূপৃষ্ঠের উপর নির্গত হয় তখন একে অগ্নুৎপাত বা অগ্ন্যুদগম বলা হয়। ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠের উপরে এসে সঞ্চিত হলে তখন তাকে লাভা বলা হয়। ভূপৃষ্ঠের ফাটল থেকে ম্যাগমার ছাড়াও উত্তপ্ত জলীয় বাষ্প, গ্যাস, ছাই বা পূর্বের অগ্ন্যুৎপাতের ফলে ফাটলের মধ্যে জমে থাকা শুকনো লাভা শিলাখণ্ড রূপে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে। এই আগ্নেয় পদার্থগুলি দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিত হয়ে শঙ্কু আকৃতির আগ্নেয় পর্বত সৃষ্টি করে। তবে সব ধরনের অগ্ন্যুৎপাতের আগ্নেয় পর্বত সৃষ্টি করে তা নয় যখন অগ্ন্যুদগমের ফলে নির্গত পদার্থ পর্বতের আকার পায় তখনই আগ্নেয় পর্বতের সৃষ্টি হয় যেমন ভারতের ব্যারেন। আগ্নেয়গিরি হলেও এটিকে আগ্নেয় পর্বত বলা চলে না।

ইতালির স্ট্রম্বলি, ভিসুভিয়াস; হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মৌনালোয়া, জাপানের ফুজিয়ামা হল আগ্নেয় পর্বতের উদাহরণ।

জাপানের ফুজিয়ামা পর্বতমালা

আগ্নেয় পর্বতের উৎপত্তি

পাত সংস্থান তত্ত্ব অনুযায়ী আগ্নেয় পর্বত প্রধানত অভিসারী ও অপসারী পাত সীমান্তে সৃষ্টি হয়। তবে পাতমধ্যস্থ উত্তপ্ত কেন্দ্র অর্থাৎ হটস্পট অঞ্চলেও আগ্নেয় পর্বত গঠিত হতে পারে।

আগ্নেয় পর্বতের উৎপত্তির প্রক্রিয়াসমূহ

1. মহাদেশ- মহাসাগর অভিসারী বা ধ্বংসাত্মক পাত সীমানায় আগ্নেয় পর্বতের উৎপত্তি

মহাদেশ মহাসাগরের পাত সীমানায় যখন ভারী মহাসাগরীয় পাত হালকা মহাদেশীয় পাতের নিচে ঢুকে যায় তখন ক্রমবর্ধমান তাপ এবং উপরে শিলাস্তরের চাপে নিম্নগামী মহাসাগরীয় পাতটি গলে যায় এবং বিভিন্ন গ্যাস ও জলীয় বাষ্পের নির্গমন হয়। এই উত্তপ্ত গ্যাস ও জলীয় বাষ্প মহাদেশীয় পাতের শিলা ও খনিজকে গলিয়ে দেয় এবং ভূত্বককে পাতলা করে দেয়।

অ্যাস্থেনোস্ফিয়ারে অবস্থিত গলিত ম্যাগমা ও জলীয়বাষ্প প্রচন্ড ঊর্ধ্বমুখী চাপে এই পাতলা ভূত্বকে অসংখ্য ফাটল তৈরি করে এবং প্লবতার নিয়ম মেনে এই ফাটল দিয়ে ভূপৃষ্ঠে উঠে আসে। এই গলিত ম্যাগমা ঠান্ডা হয়ে জমাট বেঁধে লাভায় পরিণত হয় ও কালক্রমে সঞ্চিত আগ্নেয় পর্বতের সৃষ্টি করে।

অভিসারী বা ধ্বংসাত্মক পাত সীমানায় আগ্নেয় পর্বতের উৎপত্তি উদাহরণ

প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাতটি উত্তর দিকে উত্তর আমেরিকা মহাদেশীয় পাতের তলায়; নাজকা মহাসাগরীয় পাতটি দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশীয় পাতের তলায় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাত পশ্চিম দিকে ইউরেশীয় পাতের তলদেশে প্রবেশ করেছে। এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের প্রান্তদেশীয় অংশে অধঃপাত বলয় বরাবর মহাসাগরীয় পাতের গলনের ফলে প্রচুর আগ্নেয় পর্বত ও আগ্নেয়গিরির সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাতটি পূর্বদিকে মহাদেশীয় পাতের তলদেশে অধিক দূর অব্দি প্রবেশ করার জন্য আগ্নেয় পর্বতগুলি সমুদ্রের নিকট অবস্থান না করে মহাদেশের মাঝে অবস্থান করছে।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]

প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে অভিসারী পাত সীমান্ত বরাবর পূর্ব দিকের মহাসাগরীয় পাতটি উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মহাদেশীয় পাতের তলায় অবনমন করছে।

পশ্চিম দিকের অংশটি ইউরেশীয় পাতের তলায় অবনমন করায় প্রশান্ত সাগরের মাঝ বরাবর অনেক আগ্নেয়গিরি ও আগ্নেয় পর্বত গড়ে উঠেছে একে প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলা বলা হয়।

আগ্নেয় মেখলা
প্রশান্ত সাগরীয় আগ্নেয় মেখলা

 

পৃথিবীর অধিকাংশ জীবন্ত আগ্নেয়গিরি প্রশান্ত মহাসাগরীয় বলয়ের অন্তর্গত উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল থেকে অ্যালিসিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, জাপান, ফিলিপিনস, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জসহ এশিয়া মহাদেশের পূর্ব উপকূল থেকে নিউজিল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত।

2. প্রতিসারী বা গঠনমূলক পাত সীমানায় আগ্নেয় পর্বতের অবস্থান

সাধারণত অ্যাস্থেনোস্ফিয়ার থেকে ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী চাপের ফলে একে অপরের থেকে দূরে সরতে থাকে এই অবস্থায় পাত সীমানা বরাবর থেকে ভূ-অভ্যন্তর থেকে তরল ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠে উঠে আসে এবং তা ক্রমশ জমতে জমতে আগ্নেয় পর্বত এ পরিণত হয়।

প্রতিসারী বা গঠনমূলক পাত সীমানায় আগ্নেয় পর্বতের অবস্থানের উদাহরণ

আটলান্টিক মহাসাগর এর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত প্রতিসারী পাত সীমানা এই মহাসাগরকে দুটি মহাসাগরীয় পাতে বিভক্ত করেছে। এই সীমানা বরাবর লাভা দিয়ে তৈরি ‘S ‘ আকৃতির একটি মধ্য সামুদ্রিক শৈলশিরা উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তারিত হয়েছে। এই শৈলশিরা বরাবর অসংখ্য আগ্নেয় পর্বত অবস্থান করে। আইসল্যান্ডের আগ্নেয় পর্বতগুলি এভাবে সৃষ্টি হয়েছে।



3. পাত মধ্যবর্তী কেন্দ্র বা হটস্পট অঞ্চলে আগ্নেয় পর্বতের অবস্থান

পৃথিবীতে দুটি পাতের সীমান্ত ছাড়াও পাতের মধ্যবর্তী স্থানে আগ্নেয় পর্বত সৃষ্টি হতে পারে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাতের উপর হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ হলো আগ্নেয় পর্বতের উদাহরণ। এই আগ্নেয় পর্বতের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায় যে যেসব অঞ্চলে তাপমাত্রা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের থেকে কিছুটা বেশি সেই সব অঞ্চলের পাতের দুর্বল অংশ দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী পরিচলন স্রোতের সাথে উঠে আসা ম্যাগমা ও লাভা ভূপৃষ্ঠের উপর সঞ্চিত হয় এবং আগ্নেয় পর্বত সৃষ্টি করে। এসব তপ্ত কেন্দ্র (hotspot) গুলি মূলত তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপস্থিতি এবং বিকিরণের ফলে উৎপন্ন হয়েছে।

পৃথিবীতে এরকম 25 টি উত্তপ্ত কেন্দ্রের অবস্থান জানা গেছে। এসমস্ত উত্তপ্ত কেন্দ্রের ঠিক উপরে আগ্নেয় পর্বত সৃষ্টি হয়না। সাহারা মরুভূমির টিবেস্টি হলো এই ধরনের একটি আগ্নেয় পর্বত।


[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌতবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবনবিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]

আগ্নেয়গিরি শ্রেণীবিভাগ

অগ্ন্যুৎপাতের ব্যবধান অনুযায়ী আগ্নেয়গিরিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
● জীবন্ত আগ্নেয়গিরি: সারা পৃথিবীতে প্রায় 500টি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি আছে। যেসব আগ্নেয়গিরি থেকে থেকে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে অগ্নুৎপাত ঘটে।

হাওয়াই দ্বীপের মৌনালোয়া, ইতালির ভিসুভিয়াস, ইকুয়েডরের কোটোপ্যাক্সি জীবন্ত আগ্নেয়গিরির উদাহরণ।

মৌনালোয়া

● সুপ্ত আগ্নেয়গিরি: যেসব আগ্নেয়গিরি থেকে এখন অগ্নুৎপাত না হলেও ভবিষ্যতে অগ্নুৎপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের সুপ্ত আগ্নেয়গিরি বলা হয়।

যেমন জাপানের ফুজিয়ামা, ইন্দোনেশিয়ার ক্রাকাতোয়া আগ্নেয়গিরি।

● মৃত আগ্নেয়গিরি: যেসব আগ্নেয়গিরি থেকে আর অগ্নুৎপাত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই তাদের মৃত আগ্নেয়গিরি বলা হয়।

যেমন- মায়ানমারের পোপা।

মায়ানমারের পোপা [Image by Wagaung,  CC BY-SA 3.0]

আগ্নেয় পর্বতের শ্রেণীবিভাগ

আকৃতি অনুসারে আগ্নেয় পর্বতকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়।

সেগুলি হল –
● শঙ্কু আকৃতির আগ্নেয় পর্বত
● গম্বুজাকৃতি আগ্নেয় পর্বত
● বিস্ফোরক আগ্নেয় পর্বত
● বিমিশ্র আগ্নেয় পর্বত

আগ্নেয় পর্বতের বৈশিষ্ট্য

আগ্নেয় পর্বত বা সঞ্চয়জাত পর্বত এর বৈশিষ্ট্য হলো –
● পৃথিবীর বেশিরভাগ আগ্নেয় পর্বত পাত সীমানা বরাবর এবং ভূপৃষ্ঠের দুর্বল অংশে দেখা যায়।
● পৃথিবীর প্রায় 80% আগ্নেয় পর্বত বিনাশকারী পাত সীমানা বরাবর এবং 15% পর্বত গঠনকারী পাত সীমানা বরাবর অবস্থান করছে।
● আগ্নেয় পর্বত প্রধানত আগ্নেয়শিলা যথা -ব্যাসল্ট ,গ্রানাইট, ডায়ওরাইট এবং পাইরোক্লাস্ট দ্রব্য দ্বারা গঠিত হয়।
● আগ্নেয় পর্বত এক বা একাধিক জ্বালামুখ বা ক্রেটার থাকে।
● আগ্নেয় পর্বতের আকৃতি ত্রিকোণ বা শঙ্কু আকৃতির হয়ে থাকে।
● এই শঙ্কুর উচ্চতা ও নির্ভর করে লাভার সান্দ্রতার উপরে।
● কঠিন আগ্নেয় শিলা দ্বারা গঠিত আগ্নেয় পর্বত দীর্ঘদিন যাবৎ তার আকৃতি ধরে রাখতে পারে। আগ্নেয় পর্বতের শিলা খুব কঠিন ও অপ্রবেশ্য হওয়ায় তা ক্ষয়কাজে বাধা সৃষ্টি করে।
● আগ্নেয় পর্বত অঞ্চল সাধারণত ভূমিকম্প প্রবণ হয়ে থাকে।
● আগ্নেয় পর্বতের যে ছিদ্রপথ বরাবর ম্যাগমা ও লাভা রূপে বাইরে বেরিয়ে আসে তাকে আগ্নেয় গ্রীবা বা ভেন্ট বলা হয়।
● অনেক সময় আগ্নেয় পর্বতের জ্বালামুখ বা ক্রেটার বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গিয়ে কড়াইয়ের মত আকৃতির গর্ত তৈরি করে। একে ক্যালডেরা বলা হয়। এই গর্তে বৃষ্টির জল জমে ক্যালডেরা হ্রদ বা আগ্নেয় হ্রদ তৈরি করে।

তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – স্তূপ পর্বত

লেখিকা পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

IX_Geo_4c