durjog-biporjoy-prokriti-probhab
WB-Class-9

দুর্যোগ, বিপর্যয়ের প্রকৃতি ও প্রভাব

ভূগোলনবম শ্রেণি – দুর্যোগ ও বির্পযয় (ষষ্ট অধ্যায়)

আগের পর্বে আমরা জেনেছি দুর্যোগ, বির্পযয় ও তার শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে। এই পর্বে আমরা দুর্যোগ, বিপর্যয়ের প্রকৃতি ও প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করবো।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে পার্বত্য অঞ্চল দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর ও পশ্চিমে মালভূমি অঞ্চল হওয়ায় যেমন বৈচিত্র্যপূর্ন তেমনি ঝুঁকিপূর্ন দুর্যোগ ও বিপর্যয়প্রবন এলাকা। পশ্চিমবঙ্গের প্রায়শই কতকগুলি দুর্যোগ এবং সেই দুর্যোগজনিত বির্পযয়ের কবলে পড়ে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বন্যা, ঘূর্নিঝড়, খরা, ভূমিধবস, ভূমিকম্প এছাড়াও দাবানল সুনামিও লক্ষ্য করা যায়।

বন্যা

বন্যা কমবেশী প্রায় প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গের কোনো না কোনো জায়গায় বিপর্যয়ের আকার ধারণ করে। এর প্রধান কারণ হল পশ্চিমবঙ্গ একটি নদীমাতৃক রাজ্য। এখানে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয় তাই বর্ষাকালে রাজ্যের বেশিরভাগ জায়গাই জলমগ্ন হয়ে পড়ে।

সারাবছর ধরেই বৃষ্টিপাত হওয়ার দরুন নদীগুলি ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং সেই সঙ্গে দু-কূল ছাপিয়ে বন্যা সৃষ্টি হয়। উত্তরে তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা প্রভৃতি নদীর মধ্যভাগে গঙ্গা দক্ষিণে বিশেষ করে দামোদর, ময়ূরাক্ষী, অজয় প্রভৃতি নদী অত্যন্ত বন্যাপ্রবন।

বন্যার জলোচ্ছ্বাস

এই রাজ্যের পশ্চিমভাগে বিশেষত ঝাড়খন্ডের ছোটোনাগপুরের মালভূমি অঞ্চলে একটু বেশী বৃষ্টি হলেই দামোদর ও ময়ূরাক্ষী পরিকল্পনার অধীন মাইথন, পাঞ্চেৎ, ম্যাসাঞ্জোর প্রভৃতি জলাধার থেকে বিপুল পরিমাণে জল ছাড়া হয় এবং তার ফলে দক্ষিণবঙ্গের বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলায় বন্যা দেখা দেয়।

গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হওয়ার পর থেকে মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ভাঙন ও বন্যা এক ভয়াবহ বিপর্যয় হিসাবে দেখা দিয়েছে।

বন্যার ফলাফল

• মানুষের মৃত্যু ঘটে।
• কৃষিজও প্রানীজ সম্পদের ক্ষতি হয়।
• পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
• ভূমির গুনাগুন নষ্ট হয়ে যায়, উদাহরন হিসাবে বলা যায় 1978 সালের পশ্চিমবঙ্গে বন্যায় প্রায় 1000 জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়াও 2013 সালের বন্যায় প্রায় 20 লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বেশ কিছু মানুষের মৃত্যুও হয়েছিল।

ঘূর্নিঝড়

এপ্রিল-মে মাসে অতিরিক্ত উষ্ণতার জন্য উচ্চচাপ অঞ্চল থেকে নিম্মচাপ অঞ্চলের দিকে বায়ুর ছুটে আসাকে বলা হয় ঘূর্নিঝড়। কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে চাপের তারতম্যের উপর ঘূর্ণবাতের গতি নির্ভরশীল। এটি অত্যন্ত ধ্বংসাত্নক এবং প্রাণবিনাশকারী।এপ্রিল মে মাস থেকে অক্টোবর নভেম্বর মাস পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্নিঝড় বা সাইক্লোন মাঝে মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন ও দিঘা উপকূলে আছড়ে পড়ে। তারপর স্থলভাগে প্রবেশ করে, মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটায় এবং বিপুল পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতিও ঘটায়।

ঘূর্ণিঝড়

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে 2014 সালের ‘হুদহুদ’ ঘূর্নিঝড় দক্ষিণ ভারতের পূর্ব উপকূলে আছড়ে পড়ে। যার ফলে বিশাখাপওনমে প্রচুর পরিমাণ ক্ষতি হয়। 2020 সালের আম্ফান নামে পরিচিত সুপার সাইক্লোন তীব্র গতি নিয়ে 20শে মে বঙ্গোপসাগর থেকে ভূমিভাগে আছড়ে পড়েছিল। যার ফলস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা ব্যাপক পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

খরা

পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অংশের তুলনায় পশ্চিমের জেলাগুলিতে বিশেষ করে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর ও বর্ধমানে স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টিপাত কম হয়।

খরায় শুষ্ক মাটি

যারফলে এই জেলাগুলিতে খরার সৃষ্টি হয় এবং কৃষিকাজ মৎসচাষে ব্যাঘাত ঘটে। এই অঞ্চলের মানুষজন ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ভূমিকম্প

পশ্চিমবঙ্গের পলিস্তরের অনেক নীচে বড়ো বড়ো চ্যুতিরেখা থাকায় ভূমিকম্প যে কোনো সময়েই এক বিপর্যয় ঘটাতে পারে।

ভূমিকম্পের প্রভাবে ধ্বংসস্তূপ

ভূমিধবস

উত্তরবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলে, বিশেষত দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলার পার্বত্য ভূমিতে বর্ষাকালে মাঝেমধ্যেই ভূমিধবস চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। তখন ওখানকার বিস্তীর্ণ এলাকায় জীবন ও ধনসম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থাও সম্পূর্ন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

দাবানল

পুরুলিয়ার ঝাড়গ্রাম,বাঁকুড়া পশ্চিম মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার শুষ্ক বনভূমিতে মাঝেমাঝেই আগুন লেগে যায় এবং তার ফলে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।

জঙ্গলের দাবানল

শিলাবৃষ্টি

মঝেই মাঝেই পশ্চিমবঙ্গে শিলাবৃষ্টি হতে থাকে যার ফলে প্রচুর পরিমাণে শস্য নষ্ট হয়।উদাহরনস্বরূপ বলা যেতে পারে 2003 সালে হুগলী বাঁকুড়ায় এই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল।
নদীর পাড় ভাঙন
মালদা, মুর্শিদাবাদ, দুই চব্বিশ পরগনায় পাড় ভাঙনের ফলে লক্ষ লক্ষ হেক্টর জমি জলের তলায় চলে যায়।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

বিপর্যয় ব্যবস্থাপনায় গৃহীত পদক্ষেপ

দুর্যোগ ও বিপর্যয় ঘটলে তার মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরী।
দুর্যোগ বা বিপর্যয় হলে তার প্রতিকারের জন্য সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সেগুলি হল-

ক) দুর্যোগ বা বিপর্যয় তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা হলে বিপর্যয়ে প্রভাবিত অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করা।

খ) দুর্যোগ বা বিপর্যয়ের সময়ে ভারত সরকারের বিভিন্ন দপ্তর রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে।

গ) বিপর্যয় আসার পূর্বে রাজ্য সরকার, ত্রাণ কমিশনার এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট -এর ওপর দায়িত্ব থাকে বিপর্যয় সম্বন্ধে মাইকে ঘোষণা করে,হ্যান্ডবিল বিলি ও এসএমএস এর মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা।


নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

ঘ) বিপর্যয় মোকাবিলার স্বার্থে আমাদের রাজ্যের দমকল, আপৎকালীন এবং সিভিল ও ডিফেন্স দপ্তরকে একত্রে আনা হয়েছে।

ঙ) আমাদের রাজ্যে বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর ও ত্রাণ পুনর্বাসন দপ্তর স্থাপন করা হয়েছে।

চ) বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য বিপর্যয় মোকাবিলা কমিটি তৈরি করা হয়ে থাকে এবং ব্লক থেকে রাজ্যস্তর পর্যন্ত অধিকারিক নিয়োগ করা হয়ে থাকে। বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত স্তর থেকে সবাই সক্রিয় থাকে।

ছ) বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে।


দুর্যোগ, বিপর্যয়ের প্রকৃতি ও প্রভাব সম্পর্কিত আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓


জ) বিপর্যয়ের সময় স্বাস্থ্য দপ্তরকে সজাগ রাখা হয় , যাতে বিপর্যয়ের স্থানে দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থার সুবিধা দেওয়া যায়।

ঝ) বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য প্রত্যেকটি জেলার ২৫ জনের এবং রাজ্যস্তরের ৪ পল্টন ব্যাটেলিয়ান ও তিন কোম্পানি পুলিশ দিয়ে “ক্যুইক রেসপন্স” টিম তৈরি করা হয়েছে।

ঞ) বিপর্যয় সংক্রান্ত সকল তথ্য লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে এবং তা জেলা সমাহর্তা-র কাছে জমা রাখা হয়।

ট) পশ্চিমবঙ্গের খরা অধ্যুষিত অঞ্চলে “জল ধরো ও জল ভরো” কর্মসুচী গ্রহণ করা হয়েছে।

ঠ) বিপর্যয় থেকে জনগণকে রক্ষা করার জন্য ত্রাণ শিবির তৈরি করা হয়েছে। এর সাথে সাথে আমাদের রাজ্যে পুনর্বাসন ও পরিকাঠামোর ব্যবস্থা আরও সুদৃঢ় করা হচ্ছে।

ড) বিপর্যয় মোকাবিলার সময়ে স্থানীয় কমিটির সাহায্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সন্ধান, উদ্ধারকার্য ও মৃতদেহের সৎকার করে থাকে।

ঢ) সরকার বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য আর্থিক তহবিল গঠন করে এবং প্রয়োজনে সরকার ঋণ করতেও বাধ্য হয়।

ণ) বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য সরকার ত্রাণ শিবিরে দুর্গতদের যথাযথ আশ্রয়, খাবার, চিকিৎসা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে।

ত) বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি, দূর সংবেদন ব্যবস্থা, জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেম প্রভৃতির মাধ্যমে আবহাওয়া ও দুর্যোগ সংক্রান্ত সঠিক পূর্বাভাস দিয়ে দুর্যোগের ক্ষতির মাত্রা অনেকাংশে কমানো যায়।

অধ্যায় সমাপ্ত। পরবর্তী অধ্যায় → ভারতের সম্পদ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

IX_Geo_6b