ইতিহাস– নবম শ্রেণি – বিশ শতকে ইউরোপ (প্রথম পর্ব)
পৃথিবীর বুকে পালাবদলের ঘটনা ঘটে চলেছে অবিরত। নবম শ্রেণির গোড়ায় আমরা ফ্রান্সে বিপ্লবের কথা পড়েছি। আমরা জেনেছি যে ফ্রান্সের বিপ্লব পৃথিবীকে প্রথমবার গণতন্ত্রের আস্বাদ দিয়েছিল। ফ্রান্সের বিপ্লবের মতোই বিশ্বের ইতিহাসের আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা রাশিয়ার জারতন্ত্রের পতন এবং সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, যাকে আমরা রুশ বিপ্লব বলে চিহ্নিত করি।
রাশিয়ার জারতন্ত্র
জার (Czar) শব্দটা আমাদের কাছে নতুন, সাধারণভাবে বলা যেতে পারে রাশিয়ার রাজা বা সম্রাটকে ‘জার’ বলে সম্বোধন করা হত। আর রানী বা সম্রাজ্ঞীকে বলা হত ‘জারিনা’। ইউরোপের অন্যান্য দেশের যে ভাবে বংশানুক্রমে রাজা হতেন, ঠিক তেমনভাবে রাশিয়াতেও ‘জার’ নির্বাচিত হতেন বংশানুক্রমে। জার দ্বারা শাসিত সমাজব্যবস্থাকে বলা হয় ‘জারতন্ত্র’। সপ্তাদশ শতকে মাইকেল রোমানভের দক্ষতায় রাশিয়ায় ‘রোমানভ’ রাজবংশ ক্ষমতা দখল করে। তারপর থেকে বিশাল রাশিয়া ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধি করে এবং ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালি দেশরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
কিন্তু বলা যায় প্রতিটি জারই ছিলেন স্বৈরতান্ত্রিক, তারা তাদের ইচ্ছা মতো রাশিয়া পরিচালনা করতেন। এমনকি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব শুরু হলেও, রাশিয়ায় জারতন্ত্র অক্ষুন্ন ছিল।
১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়ার সিংহাসন লাভ করেন দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। তিনি সর্বপ্রথম রাশিয়ায় উদারনৈতিক সংস্কার শুরু করেন। তিনি ভূমিদাস প্রথার বিলোপ করেন এবং নানান বিচার বিভাগীয় ও সামরিক সংস্কার করেন। কিন্তু ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে আভ্যন্তরীণ বিপ্লবের (পোল বিদ্রোহ) ফলে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার তাঁর সংস্কারমূলক পরিকল্পনা বাতিল করেন এবং একজন প্রতিক্রিয়াশীল শাসক হয়ে ওঠেন। ‘নারোদনায়া’ নামক একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের হাতে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যু হয়।
এর পর রাশিয়ার জার হন তৃতীয় আলেকজান্ডার।
তিনি ছিলেন চরম স্বৈরতান্ত্রিক। তাঁর আদর্শ ছিল ‘এক জার, একজ চার্চ, এক রাশিয়া’। তিনি বহু মানুষকে বিনা বিচারে খুন করেন, সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেন। এছাড়াও আরো অনেক স্বৈরতান্ত্রিক পন্থা যেমন সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিচারালয়ের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ, গুপ্তচর নিয়োগ ইত্যাদিও তিনি ব্যবহার করতে শুরু করেন।
তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরে রাশিয়ার জার রূপে সিংহাসন লাভ করে তাঁর পুত্র দ্বিতীয় নিকোলাস (১৮৯৪)। তিনিও তাঁর পিতার মতো স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন দুর্বল চিত্তের মানুষ, শাসন পরিচালনে তিনি জারিনা আলেকজান্দ্রা এবং এক ভন্ড সন্ন্যাসী রাসপুতিনের উপর নির্ভর করতেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে বলসেভিকদের বিপ্লবে জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে হত্যা করা হয় এবং রাশিয়ায় জারতন্ত্র উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।
রুশ বিপ্লবের রাজনৈতিক কারণ
আমরা আগেই জানলাম যে জারদের শাসনকালে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ফরাসী বিপ্লব পূর্বের ফ্রান্সের মতোই রাশিয়াতেও অভিজাতরা সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী ছিলেন। শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনকালে অব্যবস্থা চরমে ওঠে। জার সম্পূর্ণ রূপে চালিত হতে শুরু করেন জারিনা আলেকজান্দ্রা এবং ভন্ড সন্ন্যাসী রাসপুতিনের পরামর্শ অনুসারে। এর ফলে অভিজাত সম্প্রদায় জারের প্রতি আস্থা হারায়।
অপরদিকে দীর্ঘকালীন বঞ্চনার শিকার হয়ে রাশিয়ার জনগণ জারের শাসনের উপর তাদের আস্থা হারায়। বিবাদ চরমে পৌঁছালে রাশিয়ার শ্রমিক – কৃষকরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন শুরু করেন। আবার, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার ক্রমাগত হার রাশিয়ার জনগণকে আরো খেপিয়ে তোলে।
রুশ বিপ্লবের সামাজিক কারণ
রুশ বিপ্লবের অনেকগুলি সামাজিক কারণ ছিল।
কৃষকদের আন্দোলন
সেই সময়ে রাশিয়া ছিল একটি কৃষিপ্রধান দেশ। দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ভুমিদাস প্রথার অবসান ঘটালেও, দেশের শ্রমিকদের সেইভাবে কোন উন্নতি হয়নি। কারণ, জমিদার প্রথা অবলুপ্ত হলেও ‘মীর’ নামক একটি গ্রামীণ প্রশাসনিক সংস্থা কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের অবস্থার অবনতি হয়, তাদের কোন প্রকার স্বাধীনতা ছিল না।
গ্রাসাচ্ছাদন করার লক্ষ্যে তারা তাদের জমি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। এই স্বল্প মূল্যে বিক্রিত জমি কিনতে শুরু করেন এক বিশেষ জোতদার সম্প্রদায় (যাদের কাছে বিপুল সংখ্যায় জমি আছে), রাশিয়ায় এদের কূলক বলা হত।
জারের অস্বচ্ছ নীতি এবং এই সুযোগ সন্ধানী কুলকদের অত্যাচারে রাশিয়ায় বিশ লাখের বেশি কৃষক সর্বস্বান্ত। বেঁচে থাকার স্বার্থে, এই কৃষকরা রাশিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে।
শ্রমিকদের আন্দোলন
উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লব শুরু হয়, অর্থাৎ ইউরোপে শিল্পবিল্পবের বেশ কিছু সময় পরে রাশিয়ার এর প্রভাব শুরু হয়। রাশিয়ার শহর অঞ্চলে প্রচুর কল – কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু কোনরূপ শ্রমিক আইন না থাকার ফলে শ্রমিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। তাদের নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হত, তাদের কাজের কোন সুস্পষ্ট সময় এবং নিরাপত্তা ছিল না, এছাড়া তাদের মজুরী ছিল খুব কম। তাদের মধ্যে নানান অসন্তোষ থাকলেও, শ্রমিকদের সংগঠন গড়া বা বিরোধ প্রদর্শনের অধিকার ছিল না। শ্রমিকদের এই দীর্ঘকালীন অব্যবস্থা তাদের আন্দোলনের দিকে অগ্রসর করে।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]
ভিন্ন জাতির উপর অত্যাচার
রাশিয়ায় কিন্তু কেবল রুশ (খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এবং রাশিয়ান মাতৃভাষা) জাতিগোষ্ঠীর বাস ছিল না। রাশিয়ায় পোল (যারা পোলিস ভাষায় কথা বলেন), ফিন, ইউক্রেনিয়ান, তুর্কি, আর্মেনিয়ান প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর বাস ছিল। রাশিয়ার জারের তৎকালীন নীতি ছিল ‘এক রাশিয়া, এক চার্চ, এক ভাষা’ এর ফলে জারের শাসনকালে অন্য জাতিগোষ্ঠীদের উপর অত্যাচার শুরু হয়। তারা জমি অধিগ্রহন করতে শুরু করেন, অন্য জাতিগোষ্ঠীদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করা হয়, তাদের ভাষা দমন করে রাশিয়ান সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়। এর ফলে জাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সঞ্চার হয় এবং তারা আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হন।
ষষ্ঠ অধ্যায়ের ভিডিও ক্লাস
রুশ বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ
আমরা আগেই জেনেছি যে রাশিয়ার শিল্পবিপ্লব শুরু হয় ইউরোপের অন্য দেশগুলির বেশ কিছুটা পরে। এর ফলে অর্থনৈতিক ভাবে ইউরোপের অন্য দেশগুলির তুলনায় রাশিয়া দুর্বল ছিল। এর পরে রাশিয়ায় ধীরে ধীরে বিদেশী পুজির বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। এই ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবার ফলে রাশিয়ার অর্থনীতি দুর্বল হতে শুরু করে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, রাশিয়ার অর্থনীতির ভীত নড়ে যায়।
রুশ বিপ্লব এবং প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ
রুশ বিপ্লবের অন্যতম প্রত্যক্ষ কারণ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
প্রথমত – প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরুর আগেই রাশিয়ার অর্থনীতি দুর্বল হয়েছিল। তাই ব্যাপকভাবে ব্যয়বহুল যুদ্ধের খরচ বহন করা রাশিয়ার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বিরাট সেনার বেতন এবং রশদ যোগাতে গিয়ে রাশিয়ার রাজকোষ দুর্বল হয়ে যায়, ফলে রাশিয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয়ত – যুদ্ধের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে কৃষকদের সেনা বাহিনীতে নিয়োগ করা হয়। এর ফলে কৃষিপ্রধান রাশিয়ার কৃষি উৎপাদন হ্রাস পায় এবং মুদ্রাস্ফিতি বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে রাশিয়ার জনগণ একেবারেই প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের পক্ষে ছিল না, তাই ক্ষুব্ধ কৃষকদের জোর করে যুদ্ধে পাঠালে তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত]
তৃতীয়ত – বিরাট রাশিয়ার প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম ছিল রেল পথ। যুদ্ধের সেনা, যুদ্ধ সরঞ্জাম এবং সেনার জন্য খাদ্য – রসদ সরবরাহ করার জন্য রেলপথের ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানি সরবারহ কমে যায়, এবং জ্বালানি না থাকার ফলে কলকারখায় স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যহত হয়। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণ মানুষ সংকটে পড়েন।
বলা যায় রাশিয়ার জনগণের দীর্ঘকালীন ক্ষোভ, ত্বরান্বিত হয় প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের কারণে এবং রুশ বিপ্লবে এক বিরাট ভূমিকা পালন করে বলশেভিকরা।
আমরা পরের পর্বে বলশেভিকদের কথা বিস্তারিত আলোচনা করবো।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → রুশ বিপ্লব
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-His-IX-His