ভূগোল – দশম শ্রেণি – আঞ্চলিক ভূগোল (পঞ্চদশ পর্ব)
আগের পর্বে আমরা ভারতের স্বাভাবিক উদ্ভিদ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা ভারতের অরণ্য সংরক্ষণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
অরণ্য সংরক্ষণের অর্থ হল বিচার বিবেচনা করে বৃক্ষচ্ছেদন এবং সেইসঙ্গে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সেই অংশের গাছের অভাব পূরণ করা। এর ফলে যেমন অরণ্য থেকে সম্পদের যোগান অব্যাহত থাকবে তেমন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অরণ্য থেকে প্রয়োজনীয় উপকারগুলি অর্জন করতে পারবে।
অরণ্য সংরক্ষণের পদ্ধতি সমূহ
● বৃক্ষচ্ছেদন হ্রাস
পাহাড়ি অঞ্চলের অরণ্যভূমিকে পশুচারণভূমিতে রূপান্তরিত করার জন্য এবং ঝুম চাষের জন্য প্রচুর পরিমাণে অপরিণত কেটে ফেলা হয়। অরণ্য সংরক্ষণের জন্য এই অপরিণত বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ করা প্রয়োজন।
● অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষচ্ছেদনের প্রতিরোধ
বর্তমানে মানুষের অদূরদর্শিতা এবং লোভের ফলে বিভিন্ন অপরিণত গাছ নির্বিচারে ছেদন করা হচ্ছে, তেমনি আবার পরিণত গাছ ও অপরিকল্পিতভাবে কাটা হচ্ছে। কাঠের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখেই গাছ কাটার পরিমাণ নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
● বনসৃজন
চিরাচরিত কৃষি ও সামাজিক পদ্ধতিতে বনভূমি সৃষ্টি করা এবং গাছ কাটার পর পুনরায় সেখানে বৃক্ষরোপন করে সম্পদের যোগান অব্যাহত রাখলে বনভূমির ধ্বংস হয় না। তবে আঞ্চলিক পরিবেশের সাথে মানানসই প্রজাতির বৃক্ষ রোপন করলে বনভূমি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
● বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার
সুলভে জ্বালানি পাওয়ার জন্য দেশের জনসাধারণ বনভূমি থেকে সংগৃহীত কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে। যদি কোনো বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বনভূমির কাঠের জ্বালানি হিসেবে যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হবে।
● বৃক্ষের রোগ প্রতিরোধ
বনভূমির গাছপালা যাতে বিষাক্ত কীট পতঙ্গের আক্রমনে আক্রান্ত না হয়ে পড়ে, তার জন্য প্রয়োজনীয় কীটনাশক এবং রোগ প্রতিরোধক ওষুধ ব্যবহার করে বনভূমি সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
● দাবানল প্রতিরোধ
বজ্রপাতের ফলে আগুন লেগে বনভূমিতে দাবানলের সৃষ্টি হয় এমনকি মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটাতে বনভূমিতে স্বেচ্ছায় আগুন লাগিয়ে বনভূমি ধ্বংস করে। দাবানলের ফলে বনভূমির সাথে বন ভূমিতে বসবাসকারী জীবকুল ও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সুতরাং এই বিধ্বংসী বিপর্যয়কে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
● নিয়ন্ত্রিত পশুচারণ
পার্বত্য অঞ্চলে মেষ, ছাগল প্রভৃতি পশুর চরণের জন্য নির্দিষ্ট পশুচারণ ক্ষেত্রের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। নির্দিষ্ট অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে পশুচারণ করলে সেই অঞ্চলের উদ্ভিদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবাধ অনিয়ন্ত্রিত পশুচারণ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনে আইনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
● কর্মসূচি গ্রহণ
বনাঞ্চল আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সম্পদ। বনভূমি রক্ষা করার জন্য সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করা দরকার। বনভূমি সংরক্ষণের জন্য ভারতবর্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
5ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং ঐদিন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করা হয়ে থাকে।
এছাড়া বনভূমির সীমান্তবর্তী স্থানে বসবাসকারী জনগণ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের সহযোগিতায় যদি যৌথ বন সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলে তাহলে সহজেই বন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।
● মানুষের ভূমিকা
সর্বোপরি সর্বস্তরের মানুষকে বৃক্ষরোপণ এর সুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। বনভূমি থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটি অংশ বনবাসী দরিদ্র মানুষের মধ্যে বন্টন করে বনভূমি রক্ষার ক্ষেত্রে তাদের উৎসাহিত করলে বনভূমি খুব সহজে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
1971 সালের মেদিনীপুরে আরাবাড়িতে বনবাসি উপজাতি মানুষদের এইভাবে সর্বপ্রথম যৌথ বনভূমি সংরক্ষণের কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
ভারতের অরণ্য সংরক্ষণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে↓
সামাজিক বনসৃজন
জীবজগতের ভারসাম্য রক্ষা, পরিবেশের সুস্থতা, শহর ও গ্রামাঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সামগ্রিক উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে নির্ধারিত সীমার বাইরে জনগণ ও সরকারি-বেসরকারি সংস্থার যৌথ সহায়তায় পতিত জমিতে বিশেষ বিশেষ বৃক্ষ রোপনের মাধ্যমে বনভূমি সংরক্ষণ ও নতুন সৃষ্টির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাকে সামাজিক বনসৃজন বলা হয়।
1946 সালে সিলভিকালচার সম্মেলনে প্রথম সামাজিক বনসৃজনের ধারণা গৃহীত হয়।
সামাজিক বনসৃজনের উদ্দেশ্য
● পরিবেশের উন্নতিসাধনের মাধ্যমে জলবায়ুর উপাদানগুলির ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে কৃষিকে রক্ষা করা।
● গ্রামবাসী ও নগরবাসীর বনভূমিকেন্দ্রিক বিনোদন সেইসঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি।
● গ্রামাঞ্চলের জ্বালানি, গৃহনির্মাণের জন্য কাঠ, গবাদি পশু পালনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং স্থানীয় শিল্পের জন্য বন সম্পদের যোগান বাড়ানো।
● পতিত জমি পুনরুদ্ধার এবং ভূমিক্ষয়ের প্রতিরোধ।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
● অদক্ষ এবং বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা।
● সার্বিকভাবে গ্রাম ও শহর বেশি মানুষদের সুস্থ জীবন প্রদান এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন।
● জাতীয় সড়ক পথের পাশে ভূমিক্ষয়ের প্রতিরোধ।
● মিশ্র অরণ্য সৃষ্টির মাধ্যমে জ্বালানি কাঠের সাথে মানুষ ও পাখির খাদ্যের যোগান বৃদ্ধি করা এবং পরোক্ষভাবে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা।
● সংরক্ষিত বনভূমির উপর থেকে চাপ হ্রাস করা।
অঞ্চল
● পতিত জমি।
● রাস্তা ও রেললাইনের পার্শ্ববর্তী খালি জমি।
● পঞ্চায়েতের অব্যবহৃত জমি।
● নদী ও খাল পাড়ে ফাঁকা জায়গা।
● শহর ও শিল্পাঞ্চলের ফাঁকা জায়গা।
● বাড়ি, বিদ্যালয় ,অফিস ও ধর্মস্থানের আশেপাশের ফাঁকা জায়গা।
● খনির পার্শ্ববর্তী এবং অব্যবহৃত খনি অঞ্চল প্রভৃতি।
কৃষি বনসৃজন
কৃষক তার নিজের জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের সাথে সাথে অতিরিক্ত কাঠ, ওষুধ ও ফলমূল প্রভৃতি পাওয়ার জন্য ব্যবহৃত জমিতে গাছপালা লাগিয়ে যে বনভূমি গড়ে তোলে, তাকে কৃষি বনসৃজন বলা হয়।
কৃষি জমির প্রান্তসীমা বা আল বরাবর অনুর্বর অংশে যে গাছগুলো লাগানো হয়, সেগুলি হল – ইউক্যালিপটাস ,সোনাচূড়া, সোনাঝুরি, আকাশমনি, তাল, মেহগনি, শাল, কদম, সুপারি, শিশু, নারকেল ইত্যাদি।
উদ্দেশ্য
● কৃষি ভূমিকে নানাভাবে উৎপাদনশীল এবং লাভজনক কাজে ব্যবহার করা।
● এই বনসৃজন ব্যবস্থায় কৃষি কাজের পাশাপাশি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বৃক্ষ ও লতা গুল্ম রোপণ করা হয়।
● কৃষি প্রযুক্তি এবং বনসৃজন প্রযুক্তিকে এই বনসৃজন প্রক্রিয়ায় একসাথে প্রয়োগ করা হয়।
● অরণ্য ভিত্তিক কাজ কর্মের সাথে লাক্ষাকীট রেশম কীট ও মৌমাছি প্রতিপালন করা হয়।
পর্ব সমাপ্ত।
লেখিকা পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-geo-5-a-15