ইতিহাস – দশম শ্রেণি – উত্তর – ঔপনিবেশিক ভারতঃ বিশ শতকের দ্বিতীয় পর্ব (পর্ব – ১)
এই পর্বে আমরা দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি উদ্যোগ ও বিতর্ক সম্পর্কে জানবো।
বর্তমানে আমরা ভারতের যে গঠন দেখি, তা কিন্তু ভারত স্বাধীনতা পাওয়ার পূর্বে ছিল না। এমন বহু রাজ্যই সেই সময় ছিল, যা ব্রিটিশ শাসনাধীন ছিল না, তারা স্বশাসিত রাজ্য হিসাবে ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতের মধ্যে অবস্থান করতো। এই সকল রাজ্যগুলিকে বলা হত দেশীয় রাজ্য। যেমন – হায়দ্রাবাদ, জুনাগড়, জম্মু ও কাশ্মীর, মহীশুর এছাড়াও রাজাস্থানের বেশ কিছু অঞ্চল।
স্বাধীনতার সময়ে এই সব স্বশাসিত রাজ্যগুলিকে নিয়ে সমস্যা শুরু হয়। তাদের কাছে এই অস্তিত্ব সংকট মোচনের মূলত তিনটি রাস্তা ছিল।
• প্রথমত তারা স্বাধীন রাজ্য হিসাবে অবস্থান করবে।
• দ্বিতীয়ত তারা ভারতের সাথে সংযুক্ত হতে পারে।
• তৃতীয়ত তারা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে পারে।
কিন্তু সেক্ষেত্রেও বিভিন্ন সমস্যা ছিলই। রাজ্য কেন্দ্রের মধ্যে কারা সিদ্ধান্ত নেবে, কিভাবে নেবে ইত্যাদি।
জিন্না ও নেহেরুর বক্তব্য ছিল স্বাধীনতার আগে দেশীয় রাজ্যগুলির সিদ্ধান্ত মান্যতা পাবে।
ভি.পি. মেনন ও বল্লভ ভাই প্যাটেল 1947 সালের 27শে জুন প্রতিষ্ঠা করেন রাজ্য বিভাগ এবং 1947 সালের 15ই আগস্টের আগেই হায়দ্রাবাদ, জম্মুকাশ্মীর ও জুনাগড় বাদে (এই সকল রাজ্যগুলি স্বাধীন হয়ে বা পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে সমর্থন করেছিল) বাকি সব দেশীয় রাজ্য ভারতে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা সকলেই 1949 সালের মধ্যে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
দেশীয় রাজ্যগুলির এই সংযুক্তির সফলতার পিছনে যে যে কারণ ছিল-
• নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার সুবিধা
• রাজ্যগুলির সাধারণ প্রজাদের ভারতে সংযুক্তির ইচ্ছা
• ব্যাক্তিগত সম্পত্তির সুরক্ষা ও রাজস্ব আদায়ের ভাগ প্রদান
এই বিষয়গুলি দেশীয় রাজন্য বর্গকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল। দেশীয় রাজ্য সংযুক্তির এই অবদানের জন্য ‘ভারতের লৌহমানব’ উপাধি তাকে দেওয়া হয়েছে।
দেশীয় রাজ্যগুলির ভারতভুক্তি উদ্যোগ ও বিতর্ক পর্বের আলোচনা দেখে নাও এই ভিডিও থেকে↓
দেশীয় রাজ্য সংযুক্তিতে বল্লভ ভাই প্যাটেলের অবদান
জওহরলাল নেহেরু স্বাধীনতার প্রাক্কালে রাজাদের স্বতন্ত্রতাকে অস্বীকার করেছিলেন, তিনি বারংবার ঘোষণা করেছিলেন দেশীয় রাজাদের ভারত বা পাকিস্তান কারো না কারো সাথে সংযুক্ত হতেই হবে। কিন্তু, সেইখানে বল্লভ ভাই প্যাটেল ও ভি.পি.মেনন-এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নমনীয়। তারা ঐ সকল দেশীয় রাজাকে তাদের স্বার্থের দিকটি বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এই প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পূর্ণ হয়েছিল।
• ঐ দেশীয় রাজাদের প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাই ঐ সকল রাজারা ভারত অন্তর্ভুক্তিতে সম্মত হয়েছিল।
• দ্বিতীয় ধাপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে ভারতে সংযুক্তির কাজ।
• তৃতীয় ধাপে 1947 এর শেষে সকল দেশীয় রাজ্যগুলিকে তাদের অভ্যন্তরীণ সরকার নির্বাচিত করতে বলা হয়।
• চতুর্থ ধাপে স্থির হয় ঐ সকল দেশীয় রাজ্যকে একইভাবে বাকি রাজ্যের ন্যায় ভারতীয় সংবিধান মেনে চলতে হবে।
এইভাবে প্যাটেল ও মেননের উদ্যোগে শান্তিপূর্ণভাবে (হায়দ্রাবাদ, জম্মুকাশ্মীর ও জুনাগড় বাদে) প্রায় পাঁচশোরও বেশি দেশীয় রাজ্য ভারতবর্ষের সাথে যুক্ত হয়েছিল।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
কাশ্মীর
স্বাধীনোত্তর পর্বে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ রাজনৈতিক সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম কাশ্মীর সমস্যা। স্বাধীনতার সময়ে যখন সংযুক্তিকরণ চলছে তখন কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্বতন্ত্রভাবে থাকতে চেয়েছিলেন ভারত বা পাকিস্তান কারো সাথেই যুক্ত হতে চাননি। এই সময় পাকিস্তানের উপজাতিয় আক্রমণকারীরা কাশ্মীরে আক্রমণ করলে হরি সিং ভারতের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘ভারত ভুক্তির দলিল’- এ তিনি স্বাক্ষর করেন।
ঐ অঞ্চলটি মূলত মুসলিম অধ্যুষিত তাই সৈন্য প্রেরণের পূর্বে নেহেরু গণভোট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের দিকে চলে যাচ্ছে বুঝে গণভোট না করিয়েই তিনি সৈন্য প্রেরণ করেন। পাকিস্তানের আক্রমণকারীরা পিছু হটতে শুরু করে, এরকম সময়ে জাতিপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করলে কাশ্মীরের বেশ কিছু অংশ পাক অধিকৃত রয়ে যায়। আজও পাকিস্তান সৈন্য না সরানোর ফলে গণভোট সম্ভব হয়নি।
জুনাগড়
জুনাগড় ছিল গুজরাটের একটি হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল। কিন্তু তাদের শাসক ছিলেন মুসলিম। জুনাগড়ের তিনদিকে ছিল ভারতীয় ভূখণ্ড ও একদিকে ছিল আরব সাগর। তাও শাসক চেয়েছিলেন পাকিস্তানে যুক্ত হতে, এমতাবস্থায় সেখানকার অধিবাসীরা বিদ্রোহ শুরু করলে জুনাগড়ের শাসক পাকিস্তানে পালিয়ে যান। ভারত সেখানকার জনগণের ইচ্ছার মর্যাদা রক্ষার্থে ওইখানে গণভোট অনুষ্ঠিত করে, পরবর্তীকালে জুনাগড়ের সাথে সমস্ত বাণিজ্য বন্ধ করে দেয় ভারত। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে গণভোট হলে 99% জনগণ ভারতভুক্তিতে সমর্থন জানালে 1949 সালে জুনাগড় ভারতে সংযুক্ত হয়।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
হায়দ্রাবাদ
হায়দ্রাবাদের শাসক ছিলেন নিজাম ওসমান আলি খান, তিনি চেয়েছিলেন স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু, সেই সময় হায়দ্রাবাদের অভ্যন্তরে চলছিল কৃষক আন্দোলন, আবার একই সময়ে জেনারেল জয়ন্ত চৌধুরীর নেতৃত্বে 1948 এর 13ই সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনা হায়দ্রাবাদ আক্রমণ করে।
এই উভয় সংকটকে প্রতিহত করার সামর্থ্য হায়দ্রাবাদের নিজামের ছিলনা। এর কিছুদিনের মধ্যে নিজাম আত্মসমর্পণ করলে হায়দ্রাবাদে ভারতে 1950 সালের 26শে জানুয়ারি অন্তর্ভুক্ত হয়।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – স্বাধীনতা পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা
লেখিকা পরিচিতি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_hist_8a