global-warming-green-house-gas
Madhyamik

বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গ্রিনহাউস গ্যাস

ভূগোলদশম শ্রেণি – বায়ুমণ্ডল (ষষ্ট পর্ব)

আগের পর্বে আমরা তাপমন্ডল ও তাপের আনুভূমিক বন্টন সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজকের পর্বে আমরা বিশ্ব উষ্ণায়ন ও গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

বিশ্ব উষ্ণায়নের ধারণা

পৃথিবীব্যাপী প্রবল নগরায়ণ, শিল্পায়ন, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, জনবিস্ফোরণ এবং নির্বিচারে অরণ্য নিধনের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গ্রিনহাউস গ্যাসের উপস্থিতির ফলে শোষিত তাপের সবটা পুনঃবিকিরণ হওয়ার মাধ্যমে মহাশূন্যে বিলীন হতে পারে না। তা পুনরায় ভূপৃষ্ঠে ফিরে এসে ভূপৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে এবং বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়িয়ে তোলে।

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলছে

শোষিত তাপের পুরোটা মহাশূন্যে বিলীন হতে না পারায় পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর তাপমাত্রার এই বৃদ্ধিকেই বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামে আখ্যায়িত করেছেন।

বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা অনুসারে একবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা 1.5°C থেকে 4.5°C পর্যন্ত বাড়তে পারে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

গ্রিনহাউস গ্যাস

পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য যে সমস্ত গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি দায়ী, সেগুলি হল – কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি। এই গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি ক্ষুদ্র তরঙ্গের সৌর বিকিরণকে ভূপৃষ্ঠে আসতে বাঁধা দেয় না অথচ বৃহৎ তরঙ্গ বিশিষ্ট পার্থিব বিকিরণকে মহাশূন্যে বিলীন হতে বাধা দেয়, এই ঘটনাটিকে গ্রিনহাউস এফেক্ট বলা হয়।

কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2)

গ্রিনহাউস গ্যাসের মধ্যে প্রধান গ্যাসটি হল কার্বন ডাই অক্সাইড। কার্বন ডাই অক্সাইড মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির দহন ও অরণ্য নিধনের ফলে উৎপন্ন হয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বায়ুমন্ডলে বর্তমানে 400 ppm। বিশ্ব উষ্ণায়নে কার্বন ডাই অক্সাইডের ভূমিকা 49%।


jump magazine smart note book


মিথেন (CH4)

মিথেনের উৎস হল জলাভূমি, ধান জমি, জৈব পদার্থের পচন, কয়লা খনি, প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের খনি থেকে। বিশ্ব উষ্ণায়নের এর ভূমিকা 18%। বর্তমানে বায়ুমন্ডলে মিথেনের পরিমাণ 1762 ppb

ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (CFC)

ক্লোরোফ্লোরো কার্বনের উৎস হল রেফ্রিজারেটর, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, হিমঘর, স্প্রে জাতীয় প্রসাধনী ইত্যাদি। বিশ্ব উষ্ণায়নের CFC এর ভূমিকা 14%।

নাইট্রাস অক্সাইড (N2O)

নাইট্রাস অক্সাইডের মূল উৎসগুলি হল কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত নাইট্রোজেন সার, জীবাশ্ম জ্বালানির দহন, নাইলন উপাদান, জীবাণুর বিক্রিয়া, সার শিল্প ইত্যাদি। বর্তমানে এর পরিমাণ 324 ppb। বিশ্ব উষ্ণায়নে এর ভূমিকা 6%।
এছাড়া অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসগুলি হল হাইড্রোফ্লুরো কার্বন (HFC), সালফার ক্লোরাইড, ওজোন প্রভৃতি। বিশ্ব উষ্ণায়নে এরা 13% ভূমিকা গ্রহণ করে।

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব

• হিমবাহের গলন

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে গ্রিনল্যান্ড, কারাকোরাম, আল্পস, আন্দিজ, দক্ষিণ মেরুর বরফ গলতে শুরু করেছে এবং এই বরফ গলা জল পৃথিবীর সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করবে।

হিমবাহের গলন

• অধঃক্ষেপণের প্রকৃতি পরিবর্তন

বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বাড়লে বাষ্পীভবন বেশি হবে এবং বাতাসের জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বেড়ে যাবে। এর ফলে বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, তুষারপাতের তীব্রতা বাড়বে এবং অধঃক্ষেপণের ক্ষেত্রে অসম বন্টনের সৃষ্টি হবে। অর্থাৎ কোথাও খরা বা কোথাও বন্যা দেখা দেবে।

• বিপর্যস্ত জনজীবন

হিমবাহ গলার ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর বন্দর ও অনেক ছোট ছোট দ্বীপ সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত হবে। ফলে অনেক মানুষ বাস্তুহারা হয়ে যাবে এবং জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।

• শস্যের উৎপাদনের হ্রাস বৃদ্ধি

উষ্ণায়নের ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও বন্টনের তারতম্যের দেখা গেলে কৃষিকাজে শস্যের চাষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে অসম বন্টন দেখা যাবে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

jump magazine smart note book


• এল নিনো ও লা নিনা এবং তার প্রভাব

স্প্যানিশ শব্দ এল নিনো (El Nino) শব্দের অর্থ Christ child। ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব দিকে পেরু, ইকুয়েডর, চিলির পশ্চিম উপকূলে দুই থেকে ছয় বছর অন্তর ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে শীতল স্রোতের প্রভাবে পরিবর্তে সাময়িকভাবে (6 থেকে 24 মাস পর্যন্ত) একটি দুর্বল উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয়।
যেখানে স্বাভাবিক অবস্থায় উচ্চচাপ বিরাজ করতো এই উষ্ণ স্রোতের আগমনের ফলে এই অঞ্চলে উচ্চচাপের পরিবর্তে নিম্নচাপের তৈরি হয়। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে বায়ুমন্ডলে একটি স্বাভাবিক বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয়, এই অস্বাভাবিক অবস্থাকে একত্রে এল নিনো বলা হয়।

এল নিনোর প্রভাব

  • এই এল নিনোর প্রভাবে ইন্দোনেশিয়া, উত্তর অস্ট্রেলিয়া, ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তীব্র খরার সৃষ্টি হয়। এই সব অঞ্চলের তৃণভূমি এবং বনভূমি দাবানলের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।
বনাঞ্চলে দাবানল
  • অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলীয় দেশগুলিতে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হয়, সেই সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়ে।
  • এছাড়া এর ফলে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে যায়।
  • এই উষ্ণ স্রোতের আগমনের ফলে মাছের খাদ্য প্ল্যাংকটন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্ল্যাংকটনের অভাবে মাছের খাদ্যের পরিমাণ কমে যায় ফলে বাণিজ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
  • এল নিনোর প্রভাবে সমুদ্র জলের উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে প্রচুর প্রবাল কীট মারা যায়।

এল নিনোর বিপরীত অবস্থা হল লানিনা (La Nina) যার অর্থ ছোট বালিকা (Young Girl)। এক্ষেত্রে পেরু ও ইকুয়েডরের উপকূলের নিচ থেকে শীতল স্রোত উপরে উঠে আসে এবং সমুদ্র তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে 4°C কমে যায়। লা নিনার প্রভাবে ভারতের মৌসুমী বায়ু প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে এবং সেই বছর বৃষ্টিপাত বেশি হয়।

• কৃষি পদ্ধতির পরিবর্তন

অসময়ে বৃষ্টিপাত এবং বৃষ্টিপাতের অসম বন্টনের ফলে শস্য চাষের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দেবে। শুষ্ক অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাত এবং আর্দ্র অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাতের ফলে কৃষি পদ্ধতি পরিবর্তন হতে বাধ্য হবে।

• পৃথিবীতে আগত বিকিরিত তাপের বৈষম্য

গ্রিন হাউজ গ্যাসের উপস্থিতির ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে একটি আবরণ তৈরি হয়েছে যার জন্য পৃথিবীর বিকিরিত তাপমাত্রার সবটা মহাশূন্যে ফিরে যেতে পারছে না। এর ফলে আগত ও বিকিরিত তাপের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। এই অস্বাভাবিক বৈষম্য পৃথিবীর আবহমণ্ডলে তথা জীব জগতের ক্ষেত্রে ক্ষতি ডেকে আনছে।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বায়ুচাপের ধারণা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-geo-2-f