kol-chuyar-revolt
Madhyamik

কোল ও চুয়াড় বিদ্রোহ

ইতিহাসদশম শ্রেণি – প্রতিরোধ বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (পর্ব – ২)

ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম যুগের আদিবাসী বিদ্রোহগুলিকে মহাবিদ্রোহের পূর্বাভাস হিসেবে ধরা যায়।

১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল আদিবাসী আন্দোলনের ইতিহাসে জলবিভাজিকাস্বরূপ।

আদিবাসীদের আত্মসত্তা-রক্ষার লড়াইকে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিল এই আন্দোলন এবং এখনও ভূমিপুত্রের অধিকার রক্ষার যে লড়াই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় চলছে, ‘হুল’ তার প্রেরণাস্বরূপ।

গত পর্বে আমরা ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা মূলতঃ উনবিংশ শতকের প্রথমভাগে সংঘটিত চুয়াড় ও কোল উপজাতির অধিকার রক্ষার লড়াই সম্পর্কে জানবো।

ইংরেজিতে ‘race’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয় সেই অর্থে ভারতে বসবাসকারী আদিমতম জাতিগুলি ভারতের বর্তমান জনসংখ্যার নেহাতই নগণ্য একটি অংশ অধিকার করে রয়েছে। ভারতীয় ভূভাগের পর্বত, অরণ্য ও দ্বীপ অঞ্চলগুলিতে এখনও কিছু জনজাতির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। যেমন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে জারোয়া, সেন্টিনেল বা তরাই অঞ্চলে লেপচা, গোর্খা ইত্যাদি।

ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে মধ্যভারতের জঙ্গলময় অঞ্চলে বসবাসকারী সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের চাকমা, খাসি প্রভৃতি জনজাতির লড়াই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের এক চিরস্মরণীয় অধ্যায়।

তবে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের দর্প চূর্ণ করতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল চুয়াড় ও কোল জনজাতি।

1. চুয়াড় বিদ্রোহ

চুয়াড় বিদ্রোহ ছিল ঔপনিবেশিক আমলে সংঘটিত প্রথম আদিবাসী বিদ্রোহ।

‘চুয়াড়’ শব্দের উৎপত্তি কোথা থেকে তা নিয়ে নানান মত রয়েছে। জঙ্গলভূমিতে সহজলভ্য শালগাছের ধুনা থেকে যারা ‘চুয়া’ নিষ্কাশন করতো তাদেরই ‘চুয়াড়’ বলা হত। আবার অনেকে বলেন, ব্রিটিশ শাসক ও জমিদারেরা এই আদিবাসীদের অপমানের সুরে ‘চার’ বলে সম্বোধন করত। এই ‘চার’ই লোকমুখে ‘চুয়াড়’ হয়ে গিয়েছে।

তবে এরা যে লড়াকু জাতি ছিল তা নিয়ে সন্দেহ নেই। জঙ্গলমহলের সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশরা অনেকক্ষেত্রেই চুয়াড়দের গ্রাম রক্ষার দায়িত্বে ব্যবহার করতেন।

বাঁকুড়া ও তদানীন্তন ধলভূমের স্থানীয় জমিদারদের ‘পাইক’ বা লেঠেল ছিল এই চুয়াড়রা। এর বিনিময়ে তারা ‘পাইকান’ বা নিষ্কর জমি ভোগ করত। তাই এরা ভূমিজ আদিবাসী নামেও পরিচিত।


jump magazine smart note book


আগের পর্বে কৃষিজীবী ও অরণ্যচারী সভ্যতার মধ্যে যে টানাপোড়েনের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছিলাম চুয়াড়দের উদাহরণ থেকে ব্যাপারটা অনেকটা স্পষ্ট হবে।

কৃষিজীবী গ্রামীণ সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও চুয়াড়দের সঙ্গে তাদের একটা চাপা সংঘাতের আবহ বরাবরই বজায় ছিল। কালক্রমে উচ্চবর্ণীয় জমিদারদের দেখাদেখি বাংলার মূলধারার সংস্কৃতিতেও ‘চুয়াড়’ শব্দটি অরণ্যচারী মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির প্রতি কটূক্তিবাচক একটি শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকল।

এই প্রসঙ্গে মধ্যযুগের কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর কয়েকটি লাইন উল্লেখ্য –

‘অক্ষটি হিংশক রাড় চৌদিকে পশুর হাড়।
কৃতাঞ্জলি বীর কহে হই গো চোয়াড়।
লোকে না পরশ করে সভে বলে রাড়।’

ঔপনিবেশিক আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে আদিবাসী অধ্যুষিত জঙ্গলমহলকে আদায়ীকৃত জমির আওতায় আনতে তৎপর হয়ে ওঠে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

রাজস্ব আদায়ের জন্য তারা অত্যাচার শুরু করলে অনেক ছোট ভূস্বামীও সমস্যার মুখে পড়ে। অচিরেই এই জমিদারদের সহযোগিতায় চুয়াড়দের মত আদিবাসীরা সংগঠিত হয়।

চুয়াড় বিদ্রোহকে দুটি পর্বে আলোচনা করা যায়।

প্রথম পর্বে, ঘাটশিলার জমিদার জগন্নাথ সিংহ চুয়াড়দের পক্ষ নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষনা করেন। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মর্গ্যান এই বিদ্রোহ দমনে করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন।

বাঁকুড়া জেলায় বিদ্রোহ এতটাই প্রবল আকার ধারণ করে যে বিষ্ণুপুরে সরকারি রাজস্ব পাঠানো কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে।

অবশেষে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি বিরাট দুই সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সাময়িকভাবে বিদ্রোহ দমন করতে সমর্থ হন।

দ্বিতীয় পর্ব (মেদিনীপুর), ১৭৯৮-৯৯ সালে ফের রাজা দুর্জন সি়ংয়ের নেতৃত্বে মেদিনীপুরের চুয়াড়রা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
চুয়াড় বাহিনী পার্শ্ববর্তী শালবনি, রায়গড় ও বীরভূমেও আন্দোলন সংগঠিত করে। প্রায় ১৫০০ চুয়াড় এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।

রায়পুর পরগণার ৩০ টি গ্রামে তারা স্বশাসন প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়। সরকারি দপ্তর ও নথি – উভয়েই ছিল ঔপনিবেশিক ক্ষমতার প্রতীক।
স্বাভাবিকভাবেই বিদ্রোহীদের রাগ এগুলির ওপর গিয়ে পড়েছিল। বিদ্রোহীরা দপ্তর আক্রমণ করে কাগজপত্র পুড়িয়ে দেয়। শালবনিতে তারা সেনাবাহিনীর ব্যারাকে আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়।

এই বিদ্রোহ দমনে পেশিশক্তির পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শক্তির অন্যতম হাতিয়ার ছিল জমিদারশ্রেণী ও চুয়াড়দের মধ্যে সংহতির অভাব। অনেক উচ্চবর্ণীয় জমিদার চুয়াড়দের প্রতি চিরাচরিত অসূয়া থেকে তাদের পাশে দাঁড়াননি। বরং অনেকে সৈন্য পাঠিয়ে ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিলেন।

এছাড়া সময়ে সময়ে ধাদকার শ্যামরঞ্জন, মাধব সিংয়ের মত নেতারা চুয়াড়দের সংগঠিত করেছিলেন।

মেদিনীপুরে বিদ্রোহীদের একজন অন্যতম নেত্রী ছিলেন রানি শিরোমণি।

চুয়াড় বিদ্রোহের চরিত্রকে ঐতিহাসিকেরা নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ঐতিহাসিক নরহরি কবিরাজ যেমন মনে করেন চুয়াড় বিদ্রোহের মূল শক্তি ছিল কৃষক। জীবিকানির্বাহের জন্য অরণ্যের প্রতি চুয়াড়দের নির্ভরশীলতার কথা মাথায় রাখলে এই পর্যালোচনাকে আংশিক সত্য বলেই মনে হয়।

কোল ও চুয়াড় বিদ্রোহের ভিডিও আলোচনা↓

2. কোল বিদ্রোহ

বিহারের ছোটনাগপুর অঞ্চলে কোল, হো, মুন্ডা প্রভৃতি ভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়ের বাস ছিল। চুয়াড়দের মতই এরাও অরণ্যচারী মানুষ হলেও কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তফাতের মধ্যে প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বে এরা কার্যত মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে তাদের এলাকায় জমিদার, মহাজন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে।

স্থানীয় কোল ভাষায় এই বহিরাগতদের ‘দিকু’ বলা হত।

কোল বিদ্রোহের কারণ

এই ‘দিকু’রা নানাভাবে কোলদের মধ্যে অসন্তোষের সঞ্চার করে। যেমন –

i) আগে কোল গ্রামগুলি একজন সর্দারের অধীনে চাষাবাদ করত। উৎপন্ন ফসল বন্টনের অধিকারও সর্দারেরই ছিল। অন্যদিকে কোম্পানি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের পর জমি থেকে মুনাফা লাভ করার জন্য যত বেশি সম্ভব জমি জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্ত করতে চাইছিল।
কিন্তু স্বাধীনচেতা কোলরা তাদের জমিতে সর্দার ছাড়া আর কারো খবরদারি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না।

ii) কোম্পানি বহিরাগত ভূ-স্বামীদের(দিকু) কোল অধ্যুষিত এলাকার ইজারাদার হিসেবে নিয়োগ করে। ফলে কোলদের চিরাচরিত স্বাধিকার খর্ব হয়।

iii) ঔপনিবেশিক কর কাঠামো কোলদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ায় সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচার এবার সরাসরি তাদের জীবনে প্রভাব ফেলল। কর আদায়ের জন্য অত্যাচার শুরু হল।
আদিবাসী মেয়েরাও রেহাই পেল না।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

iv) কোম্পানি নগদে রাজস্ব আদায় করত। ফলে নিরক্ষর কোলরা প্রায়শই প্রবঞ্চনার শিকার হত। এদিকে গুনে গুনে রাজস্ব না দিতে পারলে ঔপনিবেশিক আইনে জমি থেকে উচ্ছেদের বিধান ছিল। এইভাবে কোম্পানির ভূমি-রাজস্ব নীতির ফলে কোলদের বাস্তহারা হবার উপক্রম হয়েছিল।

v) কোলদের রাস্তা তৈরীর মত কাজে বেগার খাটানো হত।

vi) কোম্পানি নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য কোলদের লাভজনক আফিম চাষ করতে বাধ্য করত। এর ফলে কোলদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

vi) স্থানীয় মদ ছিল আদিবাসী সমাজের সঞ্জীবনী। কিন্তু কোম্পানির আইনের ওপর উচ্চহারে কর চাপালো। কোলদের পক্ষে এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

কোল বিদ্রোহের বিস্তার ও পরিণতি

এইসবের প্রতিবাদে কোলদের ‘হো’ সম্প্রদায় ১৮২০-২১ সাল নাগাদ বিদ্রোহ ঘোষনা করে।
সিংভূমের আদিবাসী রাজা তাঁর রাজ্যে ইংরেজদের অনুপ্রবেশে বাধা দেন।

১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে বুদ্ধু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুন্ডা, ঝিন্দরাই মানকি প্রমুখের নেতৃত্বে কোলরা ঐক্যবদ্ধ হয়।

বিদ্রোহীরা তির বা আমগাছের শাখা বিলি করে বিদ্রোহের বার্তা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে দেয়। রাঁচি জেলায় প্রথম শুরু হবার পর এই বিদ্রোহ সিংভূম, মানভূম, পালামৌ, হাজারিবাগে ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৩১-৩৩ এই দুই বছর বিদ্রোহীরা তির, ধনুক, বল্লম নিয়ে যে দুঃসাহসী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তার কোনো তুলনা হয় না। ঔপনিবেশিক শাসনের অত্যাচারই শান্তিপ্রিয় কোলদের হিংসাত্মক করে তুলেছিল।

সেই সময় আদিবাসী ব্যতীত জমিদার, জোতদার, মহাজন, ইংরেজ কর্মচারী ইত্যাদি সকলেই কোলদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল।

শেষমেশ বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের নির্দেশে ১৮৩৩ সালে ক্যাপটেন উইলকিনসনের নেতৃত্বাধীন সৈন্যবাহিনী ছোটনাগপুরে গিয়ে নির্মম হত্যালীলা চালিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করে।

প্রায় ১০,০০০ আদিবাসী নর-নারী ব্রিটিশ-বিরোধী এই সংগ্রামে আত্মাহুতি দেয়।

কোল বিদ্রোহের হিংসাত্মক চেহারা দেখে কোম্পানি তড়িঘড়ি ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে আদিবাসীদের জন্য ‘দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত এজেন্সি’ নামে একটি ভূখন্ড নির্দিষ্ট করে দেয়।

ঘোষণা করা হয় সেখানে ব্রিটিশ আইন বলবৎ হবে না। এতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান তো হলই না, উল্টে আদিবাসী কোলরা মূলস্রোত থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল।

কোলবিদ্রোহের চরিত্র সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে নানারকম মত পাওয়া যায়।

মেজর সাদারল্যান্ড বলেছেন উচ্চহারে ভূমি-রাজস্ব আদায় ও ইজারা ব্যবস্থা এই বিদ্রোহের প্রধান কারণ। জগদীশচন্দ্র ঝা আবার মনে করেন কৃষি অসন্তোষই বিদ্রোহের আকার নিয়েছিল।


jump magazine smart note book


কোলবিদ্রোহের মূল্যায়ন

এই দুটি বিদ্রোহ প্রমাণ করে যে, আদিবাসী সমাজের সঙ্গে মূলধারার টানাপোড়েনে ঔপনিবেশিক উৎপাদন সম্পর্ক এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। আবার আদিবাসীদের জন্য আলাদা জমি নির্দিষ্ট করার মধ্যে দিয়ে যেন ঠিক বন সংরক্ষণ করার মতই তাদের সংস্কৃতিকেও সংরক্ষণ করা হল।

আদিবাসীদের বন্য প্রকৃতিকে অপরিবর্তনীয় সত্য হিসেবে ধরে নেওয়ার চরম পরিণতি হিসাবে মহাবিদ্রোহের পর ঔপনিবেশিক নৃতত্ত্ববিদ্যার জন্ম হয়। এই প্রক্রিয়ায় ধাত্রী হিসেবে কাজ করেছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের ব্যাপকতা।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → সাঁওতাল বিদ্রোহ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X_His_3b