santhal-revolt-in-bengali
Madhyamik

সাঁওতাল বিদ্রোহ | সম্পূর্ণ আলোচনা | কারণ ও ফলাফল

ইতিহাসদশম শ্রেণি – প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ: বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (পর্ব – ৩)

গত পর্বে আমরা চুয়াড় ও কোল বিদ্রোহ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে জানবো।

সাঁওতাল হুল

আদিবাসীদের স্বাধিকার রক্ষার লড়াই যে আসলে ছিল ঔপনিবেশিক ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পরিপূরক, সাঁওতাল বিদ্রোহ তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

সাঁওতাল বিদ্রোহের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বহু নিম্নবর্গীয় মানুষকে এই আন্দোলনে সামিল হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। শুধু আদিবাসী বিদ্রোহ বললে তাই সাঁওতাল বিদ্রোহের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্যকে অনেকাংশেই অবহেলা করা হয়। এই আন্দোলন ছিল তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক কাঠামোকে রক্ষার লড়াই।


jump magazine smart note book


তাই ১৮৫৫ সালে বিদ্রোহ দমনের মধ্যে দিয়েই সাঁওতাল বিদ্রোহের ইতিহাস শেষ হয়ে যায় না। ধীরেন্দ্রনাথ বাসকের মত সাঁওতাল ঐতিহাসিকেরা সাঁওতালদের জীবনচর্যায় হুলের বহমান ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরেছেন।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

বিদ্রোহের পর সাঁওতাল পরগণা গঠন করে তাকে ভারতীয় সমাজের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ঔপনিবেশিক সরকার সাঁওতালদের প্রতি অবিচারের ধারা অক্ষুণ্ন রাখে। এই পরগণায় শুধু মিশনারীদের প্রবেশাধিকার ছিল।

তাদের ক্রমাগত অপপ্রচারের সৌজন্যে সাঁওতালদের ভারতীয় সমাজের মূলস্রোতের ‘অপর’ হিসাবে দেখানো চিত্রকল্পটিই শিক্ষিত ভদ্রলোকদের মধ্যেও বদ্ধমূল হয়ে যায়।

আধুনিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে সাঁওতালরা ক্রমাগত এই সাংস্কৃতিক নির্মাণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

শান্তিপ্রিয় ও কষ্টসহিষ্ণু সাঁওতালরা মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, মানভূম, ছোটনাগপুরের জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে বসবাস করত।

ইংরেজ আমলে এইসব এলাকায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হলে কোম্পানি তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তার ও অত্যাচার শুরু করে। স্বাধীনচেতা সাঁওতালরা তখন সেখানকার পাট গুটিয়ে রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চল ও মুর্শিদাবাদের দিকে সরে যায়।

তারা তাদের নতুন বাসভূমির নাম দিল ‘দামিন-ই-কোহ’ বা পাহাড়ের প্রান্তদেশ।

এখানে তারা বনভূমি পরিষ্কার করে কৃষিকাজ শুরু করে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট

১) ভাগলপুরের কালেক্টর ক্লিভল্যান্ড সাঁওতালদের জমির উপর খাজনা চালু করলে সাঁওতালরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের এই খবরদারি তাদের আত্মগরিমায় আঘাত করে। অন্যদিকে ঔপনিবেশিক সরকার সাঁওতালদের খাজনা দিতে অনীহাকে সরকারি কর্তৃত্বের পক্ষে চ্যালেঞ্জ মনে করেছিলেন। তাই তারাও খাজনার হার বাড়াতে থাকে। এইভাবে আসন্ন সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

২) মধ্য ও পূর্ব ভারতের অন্যান্য আদিবাসীদের মতই নগদে খাজনা দেওয়ার রীতি সরল সাঁওতালদের পক্ষেও ক্ষতিকারক হয়েছিল। তারাও অচিরেই ‘দিকু’ বা বহিরাগত মহাজনদের কাছে ঋণের দায়ে আবদ্ধ হয়। ধূর্ত মহাজনরা নিরক্ষর সাঁওতালদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তাদের ৫০-৫০০% সুদে ঋণ দিতে। এই অস্বাভাবিক ঋণভার বহন করতে না পেরে তারা মহাজনদের জমিতে বেগার খাটতে বাধ্য হত। এই বেগার শ্রমকে ‘কামিয়াতি’ বলা হত।


সাঁওতাল বিদ্রোহের বিস্তারিত আলোচনা। ↓


৩) দ্রব্য কেনাবেচার সময় সাঁওতালরা মহাজনদের ব্যবহৃত ‘কেনারাম'(দ্রব্য কেনার জন্য বেশি ওজনের বাঁটখারা) ও ‘বেচারাম’ (সাঁওতালদের কাছে দ্রব্য বেচার জন্য কম ওজনের বাঁটখারা) নামক বাঁটখারার দ্বারা প্রতারিত হত।

৪) সাঁওতালদের সারল্যের সুযোগ নিয়ে যৎসামান্য পারিশ্রমিকে তাদের রেলপথ নির্মাণের কাজে নিয়োগ করা হত। রেলের ঠিকাদারেরাও তাদের ওপর অত্যাচার চালাত; জোর করে তাদের হাঁস-মুরগি কেড়ে নিতে। দরিদ্র সাঁওতালদের পক্ষে এইসব অত্যাচারের বিচার চেয়ে আদালতে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

৫) সাঁওতাল এলাকায় ইংরেজদের প্রবর্তিত আইনের শাসন ‘দিকু’ মহাজন ব্যবসায়ীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। এর ফলে আত্মসচেতন সাঁওতালরা অপমানিত বোধ করে।

৬) খ্রিষ্টান মিশনারীদের জোর করে ধর্মান্তরকরণের প্রচেষ্টাও সাঁওতালদের ক্ষোভের অন্যতম কারণ ছিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের বিস্তার ও পরিণতি

১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন সিধু ও কানু (বা সিধো ও কানহু) নেতৃত্বে প্রায় ১০০০০ সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে একত্রিত হয়ে ‘হুল’ বা বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

সিধু ও কানু

তাদের চিরায়ত সংস্কৃতির উপর ঔপনিবেশিক শাসকের আক্রমণকে নিরক্ষর সাঁওতালরা ধর্মীয় আঙ্গিকেই ব্যাখ্যা করেছিল। সিধু-কানহুরা জমায়েত হওয়া সাঁওতালদের বোঝান যে ‘হুল’ বা বিদ্রোহ হল ঠাকুরের নির্দেশ যা পালন করা সাঁওতালদের কর্তব্য।

স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সাঁওতালরা আসলে ঔপনিবেশিক আমলে ঘনীভূত ক্ষমতার রসায়নটিকে মূলগতভাবে অস্বীকার করতে চেয়েছিল।

জমিদার, মহাজন ও তাদের সমর্থক সরকারের বিরুদ্ধেই ছিল বিদ্রোহীদের সংগ্রাম। ভাগলপুর থেকে মুঙ্গের পর্যন্ত সাঁওতাল বিদ্রোহ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল।

সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ

এই বিদ্রোহের অন্যান্য নেতারা ছিলেন সিধু-কানহু, ডোমন মাঝি, চাঁদ-ভৈরব, কালো প্রামাণিক প্রমুখ।

১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে নিষ্ঠুর দমননীতির মাধ্যমে সরকার এই বিদ্রোহ দমন করে। এই বিদ্রোহে ২৩০০০ সাঁওতাল মৃত্যুবরণ করে। সিধু-কানহু সহ অন্যান্য নেতাদের ফাঁসি হয়। বহু সাঁওতাল গ্রাম ধ্বংস করা হয়।

সাঁওতাল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য

১) সাঁওতাল বিদ্রোহের স্বাতন্ত্র্য এর স্বতঃস্ফূর্ততায়। ক্ষোভের এই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের পিছনে ধর্মীয় উন্মাদনা বা আত্মচেতনার উন্মেষ যাই কাজ করে থাকুক, এর জন্যই সাঁওতাল বিদ্রোহ আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে রয়েছে।

২) ঔপনিবেশিক ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা ছিল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। এই প্রথম দেশজ সমাজ থেকে কোম্পানির আর্থিক নীতির বিরুদ্ধেও এক চরম বার্তা দেওয়া হয়। বলা বাহুল্য, সাঁওতাল বিদ্রোহ পরবর্তীকালের আর্থিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণির আন্দোলনের পথ প্রদর্শকের কাজ করেছে।



Join JUMP Magazine Telegram


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

৩) সাঁওতাল বিদ্রোহে নিম্নবর্গের হিন্দুরাও অংশগ্রহণ করেছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পরবর্তী গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে জমিতে সর্বাধিক শ্রম দিতে এই নিম্নবর্গীয় মানুষেরাই। অথচ জমির ওপর তাদের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। স্বভাবতই এই ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের বিস্তর অভিযোগ ছিল। আন্দোলনে তাদের অংশগ্রহণ প্রকারান্তরে সাঁওতালদের অসন্তোষের যাথার্থ্যকেই প্রতিপন্ন করে।

৪) ভারতে উপনিবেশবিরোধী সংগঠিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে গণআন্দোলনের একটি অন্তঃপ্রবাহও সমানভাবে বিদ্যমান ছিল বলে আধুনিক ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। সাঁওতাল বিদ্রোহ এই সমান্তরাল আন্দোলনের প্রবাহ থেকেই উঠে এসেছিল।


jump magazine smart note book


সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কিত ঐতিহাসিকদের মতামত

সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রাবল্যের কারণেই এর চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। বিপাশা চন্দ্র, বরুণ দে ও অমলেশ ত্রিপাঠী মনে করেন যে, অরণ্যে সাঁওতালদের অধিকারকে কেন্দ্র করে সাঁওতাল বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়েছিল।

অন্যদিকে সাঁওতাল ছাড়াও অন্যান্য নিম্নবর্গীয় মানুষের এই আন্দোলনে যোগদানের প্রবণতা লক্ষ্য করে নরহরি কবিরাজ একে ‘নিম্নশ্রেণির গণবিদ্রোহ’ বলেছেন।

তবে রণজিৎ গুহ তাঁর ‘প্রোস অফ কাউন্টার ইন্সার্জেন্সী’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে আধুনিক আর্থ-সামাজিক চেতনা নয়, সাঁওতালদের সনাতনী ধর্মীয় ভাবনাই ছিল বিদ্রোহের মূল চালিকাশক্তি।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী → মুন্ডা বিদ্রোহ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X_His_3c