পদার্থবিদ্যা – একাদশ শ্রেণি –সান্দ্রতা এবং প্রবাহীর গতিবিদ্যা (অধ্যায়- পদার্থের ধর্মসমূহ)
বার্নোলির উপপাদ্য
আদর্শ প্রবাহীর ধারারেখ প্রবাহের ক্ষেত্রে ফরাসী গণিতবিদ ড্যানিয়েল বার্নোলি একটি সূত্রের প্রতিষ্ঠা করেন, যা বার্নোলির উপপাদ্য হিসাবে পরিচিত।
আদর্শ প্রবাহী সর্বদা অসংনম্য ও অসান্দ্র হয়ে থাকে।
Hydrodynamics বা জল গতিবিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপপাদ্য যেটি মূলত আদর্শ তরলের ধারারেখ প্রবাহের ক্ষেত্রে শক্তির সংরক্ষণ নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
বার্নোলির উপপাদ্যের বিবৃতি
আদর্শ তরলের ধারারেখ প্রবাহ হলে ধারা রেখার প্রতেক্য বিন্দুতে একক আয়তনের তরলের স্থিতিশক্তি, গতিশক্তি এবং চাপশক্তির সমষ্টি সর্বদা ধ্রুবক হয়ে থাকে।
উপরোক্ত বিবৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে ধারারেখ প্রবাহের ক্ষেত্রে তরলের শক্তি নিয়ে একটু বলে রেখি।
প্রবাহ তরলের কোন বিন্দুতে তরলের মোট শক্তি তিন ধরণের হয়ে থাকে। যেমন- i) গতিশক্তি, ii) স্থিতিশক্তি, iii) চাপশক্তি।
i) গতিশক্তি
m ভরের তরল v বেগে প্রবাহিত হলে তার গতিশক্তি হল
একক ভরে গতিশক্তি
তরলের আয়তন = V এবং ঘনত্ব = P হলে,
একক আয়তনের গতিশক্তি [ঘনত্ব ]
ii) স্থিতিশক্তি
নির্দেশতল থেকে h উচ্চতায় থাকা P ঘনত্বের, V আয়তনের এবং m ভরের তরলের স্থিতিশক্তি = mgh
একক ভরে স্থিতিশক্তি
একক আয়তনে স্থিতিশক্তি
iii) চাপশক্তি
কোনো তরলের মধ্যে যদি চাপ প্রয়োগ করা হয় তাহলে তার মধ্যে শক্তির সঞ্চয় হয়, যা চাপশক্তি হিসাবে পরিচিত।
ধরি, একটি পাত্রে P ঘনত্বের তরল রাখা আছে। PQ হল তরলের মুক্তপৃষ্ঠ। পাত্রের নীচের দিকে α ক্ষেত্রফলের সরু নল AB আছে। নলের মধ্যে বাধাহীনভাবে চলাচল করতে পারে এমন একটি পিস্টন P লাগানো আছে। সরু নলের অক্ষ বরাবর স্থির তরলের চাপ p হলে পিস্টনের উপর প্রযুক্ত বল = pα।
এবার পিস্টনকে ধীরে ধীরে x দূরত্বে সরানো হলে কৃতকার্য = pαx। P চাপের জন্য পাত্রের ভিতরে αx আয়তনের বা αxP ভরের তরল প্রবেশ করবে। পিস্টনকে ধীরে ধীরে সরানোর জন্য তরলের বেগের পরিবর্তন খুব একটা বেশি হবে না, ফলে তরলের কোনো গতিশক্তি থাকবে না বলে ধরা হয় না। ‘pαx’ এই পরিমাণ কৃতকার্য তরলের মধ্যে স্থিতিশক্তি হিসাবে জমা হয়। এই সঞ্চিত শক্তিকেই তরলের চাপশক্তি বলা হয়।
একক ভরে তরলের চাপশক্তি
একক আয়তনে তরলের চাপশক্তি
এবার বার্নোলির উপপাদ্যে আসা যাক।
আগের আলোচনা থেকে জানলাম,
একক আয়তনে তরলের গতিশক্তি
একক আয়তনে তরলের স্থিতিশক্তি = Pgh
একক আয়তনে তরলের চাপশক্তি = p
হলে, বার্নোলির উপপাদ্য অনুসারে,
ধ্রুবক
বা, ধ্রুবক হয়
বা, ধ্রুবক।
এটি বার্নোলির উপপাদ্যের গাণিতিক রূপ।
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
এই সূত্রের হল বেগশীর্ষ, h হল উচ্চতাশীর্ষ এবং কে চাপশীর্ষ বলা হয়। অর্থাৎ আমরা বার্নোলির উপপাদ্যকে গাণিতিক রূপ দেখে এভাবেও বলতে পারি যে, ধারারেখ প্রবাহের ক্ষেত্রে আদর্শ তরলের যে কোনো বিন্দুতে বেগশীর্ষ, উচ্চতাশীর্ষ এবং চাপশীর্ষের যোগফল ধ্রুবক হয়।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে বার্নোলির উপপাদ্য আদর্শ তরলের জন্য প্রযোজ্য। আদর্শ তরল সর্বদা অসংনম্য এবং অসান্দ্র হয়ে থাকে।
বার্নোলির উপপাদ্যের সীমাবদ্ধতা
ক) বার্নোলির উপপাদ্য তরলের সরবরাহের জন্য প্রযোজ্য। এটি অশান্ত বা অস্থির প্রবাহের (Turbulent flow) এর জন্য উপযুক্ত নয়।
খ) সান্দ্রতার প্রভাব নগণ্য হিসেবে গন্য করা হয়।
গ) কোনো টিউবের মধ্যে তরলের বেগ সব জায়গায় সমান হয় না। তরল কণার বেগ সর্বাধিক হয় টিউবের মাঝখানে থেকে বাইরের দিকে বেগ ক্রমশ কমতে থাকে। তাই তরলের বেগের এই অসামঞ্জস্যতার জন্যে তরলের গড়বেগ ব্যবহার করা হয়।
ঘ) এক্ষেত্রে তরলটি অসংনম্য হতে হবে।
ঙ) যদি তরলের গতি কোনো বাঁকাপথ বরাবর হয়, তাহলে কেন্দ্রাতিগ বলের জন্য শক্তি বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু বার্নোলির উপপাদ্যে তা বিবেচনা করা হয় না।
চ) সময়ের সাপেক্ষে তরল প্রবাহের হার পরিবর্তন হলে এই উপপাদ্য খাটে না।
ছ) অস্থির প্রবাহে সামান্য গতিশক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এক্ষেত্রে সেটা বিবেচনা করা হয় না।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
বার্নোলির উপপাদ্যের কয়েকটি প্রয়োগ
যদি তরলের প্রবাহ অনুভূমিক তল বরাবর হয় তবে নির্দেশতল থেকে তরলের সব জায়গার উচ্চতা প্রায় সর্বদা সমান থাকে অর্থাৎ এক্ষেত্রে h ধ্রুবক থাকে। বার্নোলির উপপাদ্য থেকে বলতে পারি যে,
ধ্রুবক হয়।
বা, ধ্রুবক
অর্থাৎ প্রবাহের বেগ যত বেশি চাপ তত কম হয়। আবার বেগ কম হলে সেখানে চাপ বেশি হয়।
স্প্রেয়ার বা অ্যাটোমাইজার
জল, কীটনাশক ইত্যাদি ছড়ানোর জন্য স্প্রেয়ারের ব্যবহার করা হয়। বার্নোলির উপপাদ্যের নীতি মেনেই এর ব্যাখ্যা করা যায়।
পাশের চিত্রে একটি স্প্রেয়ার বোতলের চিত্র দেওয়া হল। এখানে সূচালো C নলের মধ্যে দিয়ে বায়ুপ্রবাহ চালনা করা হয়। এখন C নলের সূচালো মুখ O দিয়ে বায়ু বেরোবার সময় বায়ুর বেগ বেশি হয় ফলে চাপ কমে যায়। O বিন্দুতে চাপ কমে যাওয়ায় B নল দিয়ে তরল পাত্র থেকে উপরে উঠে আসে এবং C নলের বায়ুপ্রবাহের সামনে পড়ে সূক্ষ্ম কণার আকারে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রচণ্ড ঝড়ের সময় টিনের চাল উড়ে যায়-ব্যাখা
চালের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ুর বেগ খুব বেশি থাকায় উপরে বায়ুর চাপ কমে যায়। এবার ঘরের ভিতরের বায়ু নিশ্চল হওয়ার জন্য চালের নীচের বাতাসের উচ্চ চাপ ওপরের দিকে ঘরের চালকে ছিটকে দেয় যা বায়ুপ্রবাহের ফলে উড়ে যায়।
তরলের নির্গমন বেগ, টরিসেলীর উপপাদ্য
তরল পাত্রের গায়ে কোনো ছিদ্র থাকলে ওই ছিদ্রপথে বায়ু বেগে নির্গত হয়, তাকে তরলের নির্গমন বেগ বলা হয়।
ধরি তরলের মুক্তপৃষ্ঠ থেকে h গভীরতায় একটি ছিদ্র রয়েছে। যেমন-
পাশের চিত্রে দেখতে পাচ্ছি।
এখানে
A এবং B উভয় বিন্দুতে একই বায়ুর চাপ p কাজ করে। তরলের মুক্তপৃষ্ঠে তরলের বেগ শূন্য হিসাবে ধরা হয়।
এবার প্রবাহী নলের কথা চিন্তা করে প্রবাহী নলে বার্নোলির উপপাদ্য প্রয়োগ করলে দেখা যায়,
এখানে v হল B বিন্দুতে তরলের নির্গমনের বেগ। এইভাবে বার্নোলির উপপাদ্য থেকে দেখা যায়, তরলের নির্গমন বেগ, h উচ্চতা থেকে পতনশীল বস্তুর বেগের সাথে সমান।
তরলের নির্গমন বেগ সংক্রান্ত এই সূত্রটিই আসলে টরিসেলির সূত্র।
একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
এই উপপাদ্যের মূল রূপটি হল নিম্নরূপ-
কোনো ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে তরলের নির্গমন বেগ ওই তরলের মুক্তপৃষ্ঠ থেকে ছিদ্রের তল পর্যন্ত কোনো বস্তু অবাধে অবতরণ করলে যে বেগ অর্জন করে তার সাথে সমান হয়।
তবে এটা সবসময় মনে রাখা দরকার, ব্যবহারিক দিক থেকে কোনো তরলের পক্ষেই আদর্শ বেগ লাভ করা সম্ভব নয় কারণ তরলের নিজস্ব সান্দ্রতা বর্তমান কিন্তু বার্নোলির সূত্র আলোচনার সময় তরলের সান্দ্রতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে।
সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখিকা পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয় এবং IIT খড়গপুরের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তনী স্বধীতি মাঝি। পদার্থবিদ্যা চর্চার পাশাপাশি ছবি আঁকা, গান গাওয়া এবং বই পড়ায় সমান উৎসাহী স্বধীতি।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI_P_7.4a