পদার্থবিদ্যা – একাদশ শ্রেণি – পৃষ্ঠটান (অধ্যায়- পদার্থের ধর্মসমূহ)
তরলের পৃষ্ঠটান
সকল তরল পদার্থের একটি বিশেষ ধর্ম বর্তমান- সেটি হল তরলপৃষ্ঠ সর্বদা সংকুচিত হতে চায় যাতে তরলপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল যতটা সম্ভব কম হয় বা বলা যায় তরল পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল সর্বনিম্ন হতে চায়। সাধারণভাবে বলতে গেলে তরলপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল সংকোচনের প্রবণতাকে তরলের পৃষ্ঠটান বলা হয়।
জলকণার স্বাভাবিক প্রবণতা হল গোলাকার ধারণ করা কারণ সমান আয়তনের বিভিন্ন আকৃতি বিশিষ্ট বস্তুর মধ্যে গোলকের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল সর্বনিম্ন হয়। তাই জলকণা গোলাকাকার ধারণ করে পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল কমাতে চায়। দৈনন্দিন জীবনে এরকম কিছু উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়।
যেমন- বৃষ্টির ফোঁটা সবসময় গোলাকার হয়। আবার টেবিলের উপর পারদ পড়ে গেলে সেটি সবসময় গোলোক আকার ধারণ করে। বাইরে থেকে অন্য কোন বল প্রয়োগ করা না হলে অল্প পরিমাণ তরল সর্বদা গোল আকার নেবার চেষ্টা করে।
পৃষ্ঠটান সম্পর্কিত কয়েকটি দৈনন্দিন ঘটনা
1) একটি লোহার সূচক আড়াআড়িভাবে সাবধানে জলের পৃষ্ঠে শুইয়ে দিলে সূচকটি জলে না ডুবে ভাসতে থাকে। এর কারণ হল জলের পৃষ্ঠটান।
যেখানে সূচটা ভাসে সেখানকার জলতল কিছুটা অবনমিত হয়। এজন্য সূচ ও জলের বিভেদতলে ক্রিয়াশীল পৃষ্ঠটান ঊর্ধ্বমুখে ক্রিয়া করে যা সূচের ওজনকে (mg) প্রতিমিত করে। এই কারণেই সূচটা জলে ভাসতে থাকে।
2) বিশুদ্ধ জলের পৃষ্ঠটান তৈলাক্ত জলের পৃষ্ঠটানের চেয়ে অনেক বেশী তাই তেলের উপর একটি বল কাজ করে, এই টানের জন্যই সমুদ্রের জলের উপর তেল ছড়িয়ে দিলে ঢেউ-এর সাথে হাওয়ার গতির অভিমুখে তেল ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
পিছনের দিকে বিশুদ্ধ জল পড়ে থাকে। তেলের জন্য ঢেউ এর সামনের দিকের পৃষ্ঠটান পিছনের দিকের চেয়ে অনেকটাই কম হয়। ফলে পিছনের উচ্চ পৃষ্ঠটানযুক্ত জল সামনের নিম্ন পৃষ্ঠটানযুক্ত জলকে পিছনের দিকে টানতে থাকে। ঢেউ-এর উচ্চতা এর জন্য অনেকটাই কমে যায়। এই জন্যই উত্তাল সমুদ্রের উপর তেল ছড়িয়ে দেওয়া হলে বড় বড় ঢেউ অনেকটা থেমে যায়।
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
3) পৃষ্ঠটানের জন্যই জলে এক টুকরো কর্পূরের নড়াচড়া লক্ষ্য করা যায়।
এই ঘটনাটাই একটু বিস্তারিতভাবে বলা যাক। কর্পূর জলে দ্রবণীয়। জলে এক টুকরো কর্পূর ফেলে দিলে কর্পূর খণ্ডটির কোনো কোনো জায়গা অন্য জায়গার চেয়ে বেশী দ্রবীভূত হয়ে যায়। যে জায়গায় বেশী দ্রবীভূত হয় সেখানকার পৃষ্ঠটান অন্য জায়গার চেয়ে বেশী কম হয়ে যায়। পৃষ্ঠটানের তারতম্যের জন্য অসম বল কর্পূর খণ্ডটির উপর কাজ করে ফলে কর্পূর খণ্ডটিকে এলোমেলোভাবে কিছুটা নড়াচড়া করতে দেখা যায়।
আলোচনার শুরুতেই বলেছি যে তরলের মুক্তপৃষ্ঠে সর্বদা একটি টান কাজ করে এবং তরলপৃষ্ঠে টানটান করে রাখা রবারের পাতের উপর কিছু রাখলে সেটা কিছুটা নেমে যায়। তেমনি মশা, মাকড়সা ইত্যাদি ছোট ছোট কীটপতঙ্গ জলের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা যায়, যেখানে তাদের পা পড়ে সেখানে জলের পৃষ্ঠতল কিছুটা নেমে যায়। যেন মনে হয় জলতল রবারের পাতের মতো টানটান অবস্থায় আছে।
তরলের পৃষ্ঠটানের সংজ্ঞা
কোনো তরলের মুক্তপৃষ্ঠের উপর একটি রেখা কল্পনা করা হল। এই রেখার সাথে লম্বভাবে এবং পৃষ্ঠতলের সঙ্গে স্পর্শকীয়ভাবে রেখাটির প্রতি একক দৈর্ঘ্যের উপর কোনো একদিকে যে বল ক্রিয়া করে তাকে ঐ তরলের পৃষ্ঠটান বলা হয়ে থাকে।
তরলপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল সংকোচন প্রবণতার জন্য এই রেখার একপাশের অণুগুলি অপর পাশের অনুগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে যেতে চায়।
পৃষ্ঠটানের মাত্রা = বলের মাত্রা/ দৈর্ঘ্যের মাত্রা
পৃষ্ঠটানের একক: ডাইন/ সেমি (CGS পদ্ধতিতে)
নিউটন/ মিটার (SI পদ্ধতিতে)
পাউন্ডাল/ ফুট (FPS পদ্ধতিতে)
তরলের পৃষ্ঠশক্তি
তরলের পৃষ্ঠটানের জন্য তরলের মুক্তপৃষ্ঠে পৃষ্ঠতল সংকোচনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই অবস্থায় তরলের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল বাড়ানোর জন্য বাইরে থেকে বল প্রয়োগ করতে হয়।
তরলের মুক্ত পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল বাড়াতে কোনো বহিস্থ এজেন্ট যে কাজ করে সেটি তরলপৃষ্ঠে স্থিতিশক্তি হিসাবে সঞ্চিত হয়।
তরলের পৃষ্ঠশক্তির সংজ্ঞা
তরলপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল একক পরিমাণ বৃদ্ধি করতে যে কার্য করা হয় তাই হল তরলের স্থিতিশক্তির পরিমাপ।
পৃষ্ঠশক্তির একক ও মাত্রা: পৃষ্ঠশক্তি আসলে শক্তির অনুরূপ তাই এর মাত্রা এবং একক উভয়ই শক্তির সাথে অভিন্ন।
পৃষ্ঠশক্তির মাত্রা
পৃষ্ঠশক্তির একক: আর্গ/ সেমি 2 (CGS পদ্ধতিতে)
জুল/ মিটার 2 (SI পদ্ধতিতে)
পৃষ্ঠটান ও পৃষ্ঠশক্তির মধ্যে সম্পর্ক
একটি সরু তারের চৌকো ফ্রেম PQRS নেওয়া হল। AB তারটি অনুভূমিকভাবে PQ এবং SR বরাবর চলাচল করতে পারে।
ফ্রেমটি সাবান জলে ডুবিয়ে তুলে আনা হলে AQRB জায়গায় সাবান জলের একটি পাতলা স্তর তৈরি হয়। এক্ষেত্রে AB তারের ওপর লম্বভাবে এবং সরের পৃষ্ঠের সঙ্গে স্পর্শকীয়ভাবে ভিতরের দিকে পৃষ্ঠটান বল কাজ করে। এই পৃষ্ঠটানই সাবান জলের পাতলা সর পৃষ্ঠকে সংকুচিত করতে চাইবে। AB তারের অংশটি QB অংশের দিকে চলতে চেষ্টা করবে। AB তারটিকে তার পূর্বের অবস্থানেই রাখতে চাইলে বিপরীত দিকে এর সমান আরেকটি বল প্রয়োগ করতে হবে।
ধরি, AB তারটির দৈর্ঘ্য হল l, তরলের পৃষ্ঠটান হল T
একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
পাতলা স্তরটির দুপাশে দুটি পৃষ্ঠ থাকে এবং উভয়দিকে একই পরিমাণ পৃষ্ঠটান T কাজ করে।
∴ AB তারের উপর ফ্রেমের QR অংশের দিকে ক্রিয়াশীল মোট বল
∴ AB তারকে স্থিরভাবে রাখতে হলে বিপরীতদিকে একই বল প্রয়োগ করতে হবে
∴ বল
এখন F বল প্রয়োগ করে AB তারকে দূরত্ব সরিয়ে A´B´ স্থানে আনতে পৃষ্ঠটানের বিরুদ্ধে যে কার্য করতে হবে তা হল,
বল × সরণ
সরের পৃষ্ঠতলের মোট ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি
পৃষ্ঠটানের বিরুদ্ধে একক ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি করতে কৃতকার্য
এই কার্য তরল পৃষ্ঠে স্থিতিশক্তি রূপে সঞ্চিত থাকে। তবে উল্লেখ্য যে এক্ষেত্রে তাপমাত্রা স্থির আছে বলেই ধরে নেওয়া হয়।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, “প্রতি একক ক্ষেত্রফলে পৃষ্ঠশক্তি বা স্থিতিশক্তি সংখ্যাগতভাবে তরলের পৃষ্ঠটানের সমান হয়।”
এখান থেকে পৃষ্ঠটানের বিকল্প সংজ্ঞা দেওয়া হায়, তাপমাত্রা স্থির থেকে তরলপৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল একক পরিমাণ বৃদ্ধি করতে যে কার্য করা হয় তাকে ঐ তাপমাত্রায় তরলের পৃষ্ঠটান বলা হয়।
∴ পৃষ্ঠটান = কার্য/ ক্ষেত্রফল।
সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখিকা পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয় এবং IIT খড়গপুরের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তনী স্বধীতি মাঝি। পদার্থবিদ্যা চর্চার পাশাপাশি ছবি আঁকা, গান গাওয়া এবং বই পড়ায় সমান উৎসাহী স্বধীতি।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
XI_P_7.3a