শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: বাংলা। হাওয়ার গান (কবিতা)
কবি পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম পরিচিত নাম বুদ্ধদেব বসু। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই তিনি লেখনী তাঁর সুস্পষ্ট ছাপ রেখে গেছেন। তাঁর রচিত অন্যতম কাব্যগ্রন্থগুলি হল – বন্দীর বন্দনা, কঙ্কাবতী, দ্রৌপদীর শাড়ি ইত্যাদি। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারত সরকার দ্বারা ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে ভূষিত হন।
‘হাওয়ার গান’ কবিতার উৎস
বুদ্ধদেব বসু রচিত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থ থেকে ‘হাওয়ার গান’ কবিতাটি নেওয়া হয়েছে।
হাওয়ার গান কবিতার আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে↓
‘হাওয়ার গান’ কবিতার সরলার্থ
হাওয়াদের বাড়ি নেই, হাওয়াদের বাড়ি নেই,
নেই রে।
তারা শুধু কেঁদে মরে বাইরে।
সারা-দিন-রাত্রির বুক-চাপা কান্নায়
নিশ্বাস ব’য়ে যায় উত্তাল, অস্থির –
সে কোথায়, সে কোথায়, হায় রে
বলে তারা, পৃথিবীর সব জল, সব তীর
ছুঁয়ে গেছি বার – বার দুর্বার ইচ্ছায়,
তবু নেই, সে তো নেই, নেই রে।
হাওয়াদের কোন নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই, হাওয়ার দল যেন সারা দিন রাত বুক-চাপা দুঃখ নিয়ে, অশান্ত হৃদয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। তারা বার বার পৃথিবীর সব জল, স্থল সব কিছু ছুঁয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারা তাদের যে বাড়ি বা আশ্রয়স্থল খুঁজছে, তা তারা পাচ্ছে না।
সব জল, সব তীর পাহাড়ের গম্ভীর
বন্দর, বন্দর, নগরের ঘন ভিড়,
অরণ্য, প্রান্তর শূন্য তেপান্তর –
সব ঘুরেছি বৃথাই রে।
হাওয়ার দল পৃথিবীর সকল জল, পাহাড়, বন্দর, নগরের ঘন ভিড়, গহন অরণ্য, বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ নিস্ফল ভাবে ঘুরে বেড়িয়েছে।
পার্কের বেঞ্চিতে ঝরা পাতা ঝর্ঝর,
শার্সিতে কেঁপে – ওঠা দেওয়ালের পঞ্জর
চিমনির নিস্বনে, কাননের ক্রন্দনে
তার কথা কেবলই শুধাই রে।
বিভিন্ন বিষাদের মুহূর্তে যেমন পার্কের বেঞ্চিতে জমে থাকা ঝরা পাতায় সরে যাওয়ায়, হাওয়ার দাপটে কাঁচের শার্সির কেঁপে ওঠায়, চিমনির আর্তনাদে বা মাঠের মধ্যে দিয়ে কান্নার মতো স্বরে হাওয়া বয়ে যাওয়ায়, কেবলই হাওয়ার দল তাদের বাড়ি খুঁজে বেড়ায়।
তেমনি মিষ্টি ছেলে দোলনায় ঘুম যায়,
আবছায়া কারপেট কুকুরের তন্দ্রায়
ঘরে ঘরে জ্বলে যায় স্বপ্নের মৃদু মোম –
সে-ই শুধু নিয়েছে বিদায় রে।
ছোট ছেলেরা দোলনায় শান্তিতে ঘুমায়, এমনকি গৃহহীন অবলা জীব কুকুর-ও নিজের বিশ্রামের জন্য খুঁজে নেয় ছায়াচ্ছন্ন কার্পেট। নিজ গৃহে সবাই শান্তিতে ঘুমোয় – গলিত মোমের মত স্বপ্নেরা জড় হয় দুচোখে। কিন্তু হাওয়ার দলের সে সুযোগ নেই, তারা ছুটে বেড়ায়।
আঁধারে জাহাজ চলে, মাস্তুলে জ্বলে দীপ,
যাত্রীরা সিনেমায়, কেউ নাচে, গান গায়;
আমরা তরঙ্গের বুকে হানি প্রশ্নের
অবিরাম নর্তন, মত্ত আবর্তন –
সে কোথায়, সে কোথায়, হায় রে।
অন্ধকার ভেদ করে জাহাজ চলে। যাত্রীরা বিনোদনে সময় কাটায়। এদিকে হাওয়ার দল সমুদ্রের বুকে ঝড় সৃষ্টি করে, হাওয়ার বেগে তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড়ের। হাওয়ার দলের সন্ধান চলতে থাকে।
অবশেষে থামে সব, ডেক হয় নির্জন,
অকুল অন্ধকারে ফেটে পড়ে গর্জন,
সমুদ্র ওঠে দুলে, বাঁকা চাঁদ পড়ে ঝুলে –
আমাদের বিশ্রাম নেই, রে।
একসময় জাহাজের যাত্রীরা শান্ত হয়, ডেক নির্জন করে তারা ফিরে যান নিজ নিজ কামরায়। সময় অতিবাহিত হয়, রাত্রির নির্জনতায় শোনা যায় কেবল ঢেউ-এর গর্জন। একসময় রাতের চাঁদ অস্ত যায়, কিন্তু হাওয়ার দলের কোন বিরাম হয় না, অশান্ত হাওয়ার দলের শান্তি মেলে না।
আমাদের বাড়ি নেই, দেশ নেই,
কেঁদে – কেঁদে মরি, শুধু বাইরে,
বার – বার পারাপার যত করি, তবু তাঁর
নেই, নেই, দেখা নেই, নেই রে।
হাওয়ার দলের কোন বাড়ি নেই, দেশ নেই। তবু তারা শ্রান্ত হৃদয়ে, গৃহের আকাঙ্ক্ষায় বার বার ঘুরে বেড়ায়, তবু শান্তির খোঁজ পায় না।
সময় অন্তহীন, অফুরান সন্ধান,
বিশ্বের বুক ফেটে বয়ে যায় এই গান –
কোনখানে গেলে তারে পাই রে।
খুঁজে – খুঁজে ঘুরে ফিরি বাইরে,
সুরে – সুরে ব’লে যাই – নেই রে,
চিরকাল উত্তাল তাই রে।
সময় অন্তহীন, তাই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাওয়াদের সন্ধান চলতে থাকে। তাদের বুক ফাটা আর্তনাদ বিশ্বের বুকে বয়ে বেড়ায় তাদের নিঃসঙ্গতার কথা। এই অন্তহীন সন্ধান, তাদের অশান্ত করে তোলে। তাই তারা চিরকাল উত্তাল হয়ে পৃথিবীর বুকে ছুটে বেড়ায়।
অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান
হাওয়ার গান কবিতার বিষয়বস্তু
হাওয়ার গান একটি রূপকধর্মী কবিতা। এই কবিতায়, কবি বুদ্ধদেব বসু হাওয়াদের নিঃসঙ্গ জীবনের কথা বলেছেন। বাড়ি বা গৃহ কেবলমাত্র আমাদের বিশ্রামস্থল নয়, এটি হল আমাদের কাছে শান্তির কেন্দ্র। মানুষ, পশু – পাখি সারাদিনের কাজের পরে, তার গৃহে ফেরে। শ্রান্ত – অবসন্ন শরীর গৃহের বিশ্রামে তরতাজা হয়ে ওঠে। এইভাবে সে নতুন দিনে কাজের আনন্দ পায়।
কিন্তু হাওয়ার দল-এর সেই বিরাম নেই। যুগের পর যুগ ধরে হাওয়ার দল ছুটে চলেছে। তারা পৃথিবীর জল, স্থল, পাহাড়, ব্যস্ত নগরী, নির্জন প্রান্তর ছুঁয়ে যায়। তাদের হিমেল বাতাসের স্পর্শে কেঁপে ওঠে জানলার কাঁচ, প্রবল বেগে ছুটে চলা বাতাসের ক্রন্দনসম শব্দ ভেসে ওঠে। আবার, সেই বাতাসের স্পর্শে ছোট্ট ছেলে শান্তিতে ঘুমায়, এমনকি পথের কুকুর তার বিশ্রামের স্থান খুঁজে নেয়, কিন্তু বাতাসের কোন বাড়ি নেই, তার কোন বিশ্রামের অবকাশ নেই। সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজ চলে, যাত্রীরা মেতে ওঠে নানান বিনোদনে, একসময় কলরব থেমে যায়, সবাই নিজ কামরায় ফিরে যায়। বাতাসের দলের কোন ছুটি নেই, তার কাজ সে করে যায়। সময় অন্তহীন, তাই তাদের সন্ধানও সীমাহীন। হাওয়ার দল অক্লান্তভাবে তাদের বাড়ির সন্ধানে বিশ্বের বুকে ছুটে বেড়ায়, তাদের কান্নার – আর্তনাদের শব্দ ছড়িয়ে পড়ে ধরিত্রীময়। তাই তারা উত্তাল।
সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
VIII_beng_haowar_gan