ouponibeshik-bharater-rajoswo-bybostha
WB-Class-8

ঔপনিবেশিক ভারতের রাজস্ব ব্যবস্থা

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: ইতিহাস । অধ্যায় – ঔপনিবেশিক অর্থনীতির চরিত্র (চতুর্থ অধ্যায়)

বাংলায় পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের শাসনভার গ্রহণের পরিকল্পনা শুরু করেছিল। তারা জানত শাসন ব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ হল মজবুত অর্থনীতি। তাই অর্থনীতির মূল ভিত্তি রাজস্ব ব্যবস্থাকে তারা সঠিকভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছিল। তবে তা একদিনে হয়নি বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তা গড়ে উঠেছিল। চলো, জেনে নেওয়া যাক সেই ইতিহাস।

এই রাজস্ব ব্যবস্থার ভিত্তি গোটা দেশ জুড়ে মূলত তিনভাবে হয়েছিল,
• চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
• রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত
• মহলওয়ারি ব্যবস্থা


ভিডিও ক্লাসের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের রাজস্ব ব্যবস্থা বুঝে নাও ↓


চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

1770 সালের ভয়ংকর মন্বন্তরের পরে, কোম্পানি রাজস্ব ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিল। তাই প্রথমে ওয়ারেন হেস্টিংস 1772 সালে রাজস্ব আদায়ের জন্য ইজারাদারি ব্যবস্থা এবং পরে 1793 খ্রিঃ লর্ড কর্নওয়ালিশ বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রেক্ষাপট

• কৃষক সমাজকে শোষণ করে খাজনা আদায় দেশীয় অর্থনীতির প্রচুর ক্ষতি করেছিল।
• কৃষি উৎপাদনের এই সংকট রপ্তানিতে চরম প্রভাব ফেলে। কার্পাস, রেশম ইত্যাদি বহু কৃষিজ দ্রব্যের রপ্তানি কমে গিয়েছিল।
এই অবস্থায় কৃষক, জমিদার, কোম্পানি সকলেই একটি চিরস্থায়ী সমাধান চাইছিল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি?

1793 সালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার জমিদারদের সাথে ব্রিটিশ কোম্পানি খাজনা বিষয়ক একটি বন্দোবস্ত হয়, এই বন্দোবস্ত অনুযায়ী প্রতি জমির নির্দিষ্ট কর ধার্য করা হয়। এখন ঐ জমির জমিদার নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর ঐ কর কোম্পানিকে দিলেই জমিদারীত্ব বহাল থাকত।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার প্রচলন করার মাধ্যমে কর্ণওয়ালিশ রাজস্ব ব্যবস্থার ওপর আরো নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন।
• প্রথমত, কৃষকের সংখ্যা বেশি তুলনায় জমিদার কম, তাই রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে কৃষক অপেক্ষা জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ করা অনেক বেশি সহজ।
• দ্বিতীয়ত, এই বন্দোবস্ত শুধুমাত্র রাজস্ব আদায়ের পরিমাণই ঠিক করবেনা, একইসাথে ব্রিটিশদের অনুগামি একটি সম্প্রদায় গঠন করবে। যা কোম্পানির শাসনকে দীর্ঘস্থায়ী করতে সাহায্য করবে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বৈশিষ্ট্য

• এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমির উপর জমিদারদের মালিকানা হত বংশানুক্রমিক।
জমিদাররা জমি বিক্রি বা মালিকানার পরিবর্তনও করতে পারতেন।
• জমির খাজনা প্রদত্ত সময়ের মধ্যে না দিতে পারলে, জমির মালিকানা কোম্পানি খারিজ করত।
• মালিকানা খারিজ হলে, জমি নিলাম করে নতুন জমির মালিক নির্বাচন করা হত।


আরো পড়ো → গাছের কথা বিষয়বস্তু

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও কৃষক সমাজ

এই বন্দোবস্ত কৃষক সমাজের কোনো উন্নতি করতে পারেনি, পূর্বে তাও কৃষকদের জমির উপর দখলি স্বত্ব ছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থায় জমিদাররাই হয়ে ওঠে সর্বেসর্বা। কৃষকরা হয়ে যায় প্রজা।
উচ্চহারে কর, বেআইনি বিভিন্ন কর, প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও কর মুকুব না করা, সময় মত খাজনা দিতে না পারলে জমি বাজেয়াপ্ত করা ইত্যাদি কৃষকদের জীবনের নিত্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু, কৃষকদের অবস্থা সঙ্গিন হলেও, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কোম্পানির আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছিল।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব বা জমির খাজনা আদায়ের যে ব্যবস্থা শুরু হয়েছিল তাকে রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত বলা হয়।

রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত গড়ে ওঠার কারণ

• প্রথমত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিভিন্ন ত্রুটির কারণে অনেক প্রশাসকেরই এর উপর থেকে ভরসা উঠে গিয়েছিল।
• দ্বিতীয়ত মাদ্রাজ বা সংলগ্ন অঞ্চলে বড় মাপের জমিদার ছিলনা।
• চিরস্থায়ী ব্যবস্থায় কৃষকদের যে সঙ্গিন অবস্থা হয়েছিল, তার প্রধান কারণই ছিল জমিদার শ্রেণী বা মধ্যস্বত্বভোগী। তাই কোম্পানি এই অবস্থার পরিবর্তন চেয়ে সরাসরি কৃষকদের সাথে সম্পর্ক তৈরি করেছিল।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান | ভূগোল

রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত ও কৃষক সমাজ

রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় আদপে কৃষকের সমস্যার সুরাহা বিশেষ হয়নি। তারা জমিতে ভাড়াটের মতই গুরুত্ব পেতেন। সময় মত রাজস্ব দিতে না পারলে তাদের নির্দয়ভাবে জমি থেকে উৎখাত করা হত। শুল্কের হার ছিল অত্যন্ত বেশি। প্রায় উৎপাদনের 45-55%, এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগেও খাজনার হার অপরিবর্তিত থাকত।

মহলওয়ারি ব্যবস্থা

‘মহল’ শব্দের অর্থ গ্রাম। উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে যে গ্রামভিত্তিক রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তা মহলওয়ারি ব্যবস্থা নামে খ্যাত। এই ব্যবস্থায় কোম্পানি গ্রামের প্রধানের সাথে খাজনা সংক্রান্ত চুক্তিতে আবদ্ধ হত। সেই চুক্তি অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোম্পানিকে রাজস্ব প্রদান করতে হত।
এই ব্যবস্থাতেও কৃষকের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। উচ্চহারে কর, সেই কর প্রদানের জন্য ঋণ গ্রহণ, সেই ঋণ শোধ করার জন্য পুনরায় ঋণ, এই ভাবে কৃষকরা এক অর্থনৈতিক ফাঁদে আটকে যেত।

ভারতীয় সমাজে ব্রিটিশ রাজস্ব নীতির প্রভাব

এতক্ষণ আমরা জানলাম ব্রিটিশ কোম্পানি ভারতে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাজস্ব নীতিতে যে পরিবর্তন এনেছিল তা মূলত তিন প্রকার, চিরস্থায়ী ব্যবস্থা, রায়তওয়ারী ব্যবস্থা, মহলওয়ারী ব্যবস্থা। কিন্তু এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই গরীব কৃষকেরই দুর্দশা বেড়েছিল। ব্রিটিশ শাসকেরা উত্তরোত্তর তাদের রাজস্ব বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল যারফলে জমিদারদের মত মধ্যস্বত্বভোগী ও ইংরেজরা লাভবান হলেও, কৃষক সমাজের অবস্থা হয়ে উঠেছিল ভয়াবহ। অনাহার, অত্যাচার, জমি থেকে উচ্ছেদ, ঋণের বোঝা এসব হয়ে উঠেছিল তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।

তবে এই রাজস্ব ব্যবস্থাই যে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি মজবুত করেছিল তা অনস্বীকার্য।

পর্ব সমাপ্ত।

লেখিকা পরিচিতিঃ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

VIII_His_4a