bangla-east-india-companir-somporko
WB-Class-8

বাংলা ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: ইতিহাস । অধ্যায় – আঞ্চলিক শক্তির উত্থান (দ্বিতীয় অধ্যায়)


আগের পর্ব মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ও আঞ্চলিক শক্তির উত্থান

বন্ধুরা কেমন আছো? আবার চলে এসেছি। তোমাদের সামনে। হ্যাঁ, আগের দিন যেন কোথায় শেষ করেছিলাম? হ্যাঁ সেই সিরাজ আর ব্রিটিশদের মধ্যে বিবাদের শুরু হচ্ছে, সেইখানে তাই তো। আজ বাকি গল্প জানার পালা।

সিরাজের সাথে কেন হঠাৎ ব্রিটিশদের বিরোধ শুরু হল সেটা জানার জন্য একটু পিছিয়ে যেতে হবে। মুর্শিদকুলি খান-এর সময় থেকেই কিন্তু ভারতে বা বিশেষ করে বাংলায় বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তিদের যাতায়াত শুরু হয়ে গিয়েছিল। এদের মধ্যে ব্রিটিশ, ফরাসী, ওলন্দাজ ইত্যাদি জাতিগুলির মধ্যে ব্রিটিশদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল অত্যন্ত উন্নত।

এখন মুর্শিদকুলি খানের সাথে এদের তেমন প্রত্যক্ষ সমস্যা ছিল না। মূলত 1717 সালে “ফারুখশিয়ারের ফরমান”এর উপর ভিত্তি করেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় ক্রমশ ব্যবসায়ী থেকে শাসক হতে শুরু করে।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | ভূগোল

[জানো কি, ফারুখশিয়ারের ফরমানে কি কি সুযোগ সুবিধা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছিল?
বার্ষিক মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য চালাতে পারবে।
কলকাতার নিকটে ৩৮ টা গ্রামের জমিদারী কেনার অধিকার দেওয়া হয়।
মুর্শিদাবাদের ট্যাঁকশাল ও তারা প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে পারবে।
বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অনুমতি ইত্যাদি ছিল মূল বিষয়।]

এর থেকেই বুঝতে পারছো, বাংলায় কিভাবে ব্রিটিশ শক্তি প্রবেশ করে।

মুর্শিদকুলি খান মুঘল শাসকের অধীনস্থ ছিলেন, তাই এই ফরমানের সাথে সহমত না হলেও, তিনি সম্পূর্ণ ফরমানকে স্বীকার করেননি। বহুক্ষেত্রেই তিনি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। যেমন বিনাশুল্কে বাণিজ্যের সীমা সমুদ্রের মধ্যেই বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। তিনি মুর্শিদাবাদের ট্যাঁকশাল ব্যবহারেও ব্রিটিশদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন।

পরবর্তী শাসক আলিবর্দী খানও মুর্শিদকুলি খানের মতই ইংরেজদের ক্ষমতা ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যেই সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন। তবে তাদের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ কোনো বিবাদ ছিলনা। বাংলার আর্থিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধির বিষয়ে তাদের প্রয়োজনীয়তা তিনি স্বীকার করতেন। তবে কোনো রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা কোনো ইউরোপীয় জাতি পাক, তা তিনিও চাইতেন না। তাই তাঁর শাসনকালে ফরাসী ও ইংরেজদের মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ বিবাদ হয়নি। দুটি জাতিকেই তিনি বাংলায় দুর্গ নির্মাণ করার অনুমতি দেননি।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – গণিত | বিজ্ঞান | ইতিহাস

1744 সালে মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করতে আলিবর্দি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে প্রায় 30 লক্ষ টাকা দাবী করেছিলেন। কিন্তু, তাতে তিনি প্রত্যাখ্যাত হলে বাংলার মসনদ (সিংহাসন) এর সাথে ব্রিটিশদের সম্পর্কের অবনতি হয়। এর পরবর্তী সময়ে আর্মেনীয় জাহাজ অযৌক্তিক কারণে ব্রিটিশরা আটক করায় নবাব আলিবর্দি খান অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং কড়া হাতে তা দমন করেন।

সিরাজ-উদ-দৌলা ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি

আলিবর্দি খানের উত্তরাধিকার হিসাবে বাংলার মসনদে তাঁর দৌহিত্র (নাতি) সিরাজ-উদ-দৌলা বসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই সিদ্ধান্ত অধিকাংশেরই সমর্থন পায়নি। সিরাজ তাঁর নিজের পরিবার থেকে শুরু করে প্রধান সেনাপতি মীরজাফর এমনকি ব্রিটিশদেরও অপছন্দের পাত্র ছিলেন। এদের মধ্যে ব্রিটিশদের শত্রুতা ক্রমশ বাড়ে।

স্বাধীনচেতা তরুণ নবাব সিরাজ তাঁর দাদু আলিবর্দি খানের মত ব্রিটিশদের সাথে সহাবস্থান করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন ব্রিটিশ কোম্পানির ক্ষমতা খর্ব করতে। যদিও এর যথেষ্ট কারণ ছিল, ঔদ্ধত্য পূর্ণ ইংরেজরা ক্রমাগত নবাবকে অসম্মান, অবজ্ঞা প্রদর্শন করার মাত্রা বাড়িয়ে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। সব থেকে অপমানজনক ঘটনাটি ঘটে যখন সিরাজের অনুমতি ছাড়াই তারা কলকাতা দুর্গ নির্মাণ শুরু করে।
এই ঘটনায় সিরাজ ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বাহিনী নিয়ে 1756 খ্রিঃ 20 শে জুন, কলকাতার ফোর্ট আক্রমণ করেন, এবং সিরাজ এই স্থানের নাম দেন “আলিনগর”।

ব্রিটিশ কোম্পানির একজন কর্মী হলওয়েল প্রচার করেছিলেন সিরাজ প্রায় 146 জন ইংরেজ নরনারিকে একটি ছোট্ট ঘরে আটক করে নারকীয়ভাবে হত্যা করেছিলেন। যা ইতিহাসে “অন্ধকূপ” হত্যা নামে পরিচিত।

তবে বহু ঐতিহাসিকই এই ঘটনা সত্য বলে মনে করেন না।
খুব দ্রুতই ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এবং 1757 সালে ‘আলিনগরের সন্ধি’ স্বাক্ষরিত হয়।

এই সন্ধি ইংরেজদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, বলা চলে তাদের আধিপত্য বিস্তারের পথ চওড়া করে। তারা সমস্ত বাণিজ্যিক সুবিধা পুনরায় ফিরত পায়। তাদের নিজস্ব মুদ্রা বা সিক্কা তৈরির অধিকার পায়। এমনকি কোম্পানির ক্ষতিপূরণ করার দায়ও বর্তায় নবাব সিরাজের ওপর। এমন অপমানজনক সন্ধি নবাব ও কোম্পানির বিরোধ আরো বাড়িয়ে তোলে।

ব্রিটিশ কোম্পানি সিরাজের সাথে তাঁর সভাসদ ও পরিবারের সম্পর্ককে নষ্ট করে। এমতাবস্থায় সিরাজের মসনদ হারানো ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা।

পলাশির যুদ্ধ

অবশেষে 1757 সালে শুরু হয় পলাশির যুদ্ধ। একদিকে চতুর ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ ও ওয়াটসন এবং অন্যদিকে প্রায় একা সিরাজ। হ্যাঁ একা। কারণ মিরমদন ও মোহনলাল বাদে কেউই সিরাজের হয়ে সৎ-ভাবে যুদ্ধ করেনি। মীরজাফরসহ একাধিক ব্যাক্তির বিশ্বাসঘাতকতায় 23 শে জুন সিরাজের পরাজয় ঘটে।

এই যুদ্ধের পরে ব্রিটিশ কোম্পানি মীরজাফরকে নবাব হিসাবে নির্বাচিত করেন। কার্যত তাঁকে “পুতুল শাসক” বানিয়ে তাঁর কাছ থেকে প্রভূত সম্পদ, যুদ্ধ বাবদ ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি নিয়ে বাংলাকে তারা নিঃস্ব করে দেয়। জানা যায়, প্রায় 3 কোটি টাকার সম্পদ তারা মীরজাফরের থেকে আদায় করেছিল।

বহু ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে ‘পলাশির লুণ্ঠন’ বলে অভিহিত করেছেন।

1760 খ্রিঃ ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে কোম্পানি মীরজাফরকে সরিয়ে তাঁর জামাই মিরকাশিমকে নবাব পদে অধিষ্ঠিত করেন।

বক্সারের যুদ্ধ

মিরকাশিম নবাব পদে নিযুক্ত হওয়ার প্রথম দিকে ইংরেজদের বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম- এর জমিদারী প্রদান করলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা মানুষ। তাই তিনি ধীরে ধীরে প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে ব্রিটিশদের সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন, এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম পদক্ষেপ ছিল মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গের-এ রাজধানী স্থানান্তরিত করা। তিনি জগত শেঠ থেকে ব্রিটিশ প্রশাসক সকলের সাথেই দূরত্ব তৈরি করেন।

তিনি একটি আধুনিক সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন, কোম্পানির বেআইনি ব্যবসা এবং ক্রমাগত শুল্ক ফাঁকি দেওয়া এই দুইয়ের জোড়া চাপে বাংলার অর্থনীতি ভয়াবহ জায়গায় চলে যায়। উভয় পক্ষেই বিরোধিতা চরমে পৌছায়। যার জেরে উভয়পক্ষেই যুদ্ধ শুরু হয়। 1763 সালে ক্রমাগত ব্রিটিশ শক্তির কাছে মির কাশিম পরাজিত হতে শুরু করেন, একসময় বাংলা থেকে পালিয়ে তিনি অযোধ্যার শাসক সুজা-উদ-দৌলা এবং মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সাথে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোট গড়ে 1764 সালে ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধ ইতিহাসে ‘বক্সারের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
এই যুদ্ধে মিরকাশিমের পরাজয় ব্রিটিশদের শক্তিকে আরো বৃদ্ধি করে।

দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা

মাত্র 26 লক্ষ টাকার বিনিময়ে 1765 খ্রিঃ ব্রিটিশরা মুঘল সম্রাট শাহ আলমের থেকে বাংলা, বিহার উড়িষ্যার দিওয়ানি লাভ করে। এই ঘটনার পর থেকেই বাংলায় দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা শুরু হয়। যেখানে বাংলার পরবর্তী নবাব (নজম-উদ-দৌলা) হয়ে ওঠেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষার শাসক অন্যদিকে অর্থনৈতিক সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
অর্থাৎ বাংলার মসনদ একজন ক্ষমতাহীন ‘পুতুল’এর শাসনে চলতে থাকে।
এই জয়েতেই ব্রিটিশ আগ্রাসন থেমে যায়নি। ক্লাইভ চেয়েছিলেন দ্রুত তাদের আধিপত্য বাংলা থেকে দিল্লী পর্যন্ত বিস্তার করতে। 1765 সালে এলাহাবাদ চুক্তি সংগঠিত হয়। ক্রমে ক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের অন্যান্য প্রদেশে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে।

পর্ব সমাপ্ত। পর্ব সমাপ্ত → কোম্পানি শাসনের বিস্তার ও দেশীয় রাজ্য দখলের উদ্যোগ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতিঃ

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করতে ভুলো না।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

VIII_His_2b