এই প্রবন্ধটি JUMP ম্যাগাজিন আয়োজিত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে।
আজি পরীক্ষা জাতির, অথবা, জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল কাণ্ডারি হুঁশিয়ার!
~ কাজী নজরুল ইসলাম
প্রায় দুশো বছর ধরে চলে আসা মরণযুদ্ধ, অবশেষে ১৯৪৭ সালের রক্তিম সূর্যোদয়ের মাধ্যমে শেষ হয়েছিল।
এই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কিন্তু অতো সহজে আমাদের হস্তগত হয়নি, এরজন্যে অনেক রক্ত ঝরেছে, বহু মায়ের কোল শূন্য হয়ে গেছে, অশ্রু ঝরেছে কত না কত! কিন্তু আমারা থেমে থাকিনি, আমাদের ভাগ্যাকাশে অন্ধকার নেমে আসা সত্ত্বেও আমরা পিছু হটিনি, থেমে যায়নি। আমরা এগিয়েছি তাঁদের অনুসরন করে যারা আমাদের থামতে দেয়নি। তাঁরাই আমাদের শিখিয়েছেন দেশপ্রেম, সঠিক আদর্শ, দিয়েছেন বৈপ্লবিক শক্তি। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কিংবদন্তী, অপ্রতিরোধ্য, অসীম ক্ষমতা সম্পন্ন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু।
আজ এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা যেখানে চাঁদ থেকে মঙ্গল, গভীর সমুদ্র থেকে রহস্যাময় অঞ্চল, অতীত থেকে ভবিষ্যৎ পাড়ি দিয়ে জয়লাভ করছি, ঠিক এইসময়ে দাঁড়িয়ে কিন্তু আমাদের নেতাজি সম্পর্কে অনেক তথ্য সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা। আমরা এখনও নেতাজির মৃত্যুকে রহস্যময় বলে যাই, সঠিক ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনা।
তাহলে কি আমরা সুভাষ চন্দ্র বসুর অজানা তথ্য সম্পর্কে অবগত হতে পারবো না?
কেন পারবো না?
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৩শে জানুয়ারী, বর্তমান উড়িষ্যার কটক শহরে জন্মগ্রহণ করেন এক উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ ও শক্তিশালী নক্ষত্র, যার নাম সুভাষ চন্দ্র বসু। তাঁর পিতা ছিলেন কটকের স্বনামধন্য আইনজীবী জানকী নাথ বসু ও মাতা ছিলেন প্রভাবতি দেবী। জানকী নাথ বসু ও প্রভাবতি দেবীর চোদ্দ জন সন্তানের মধ্যে নবমতম ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু।
সুভাষ চন্দ্র বসু ছোটোবেলা থেকেই প্রখর মেধাবি ও বুদ্ধিমান ছিলেন।
প্রথমে তিনি একটি ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন। সেই স্কুলে বাংলা শেখানো হতনা, শুধু তাই নয় ভারতের ইতিহাস-ভুগোল পড়ানোর বদলে ইংল্যান্ডের ইতিহাস-ভুগোল পড়ানো হত। এতে বিরক্তবোধ করে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার জন্য নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, সেখানে বাংলা না জানার জন্য তাকে সমবয়সি ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে সমালোচনার সম্মুখিন হতে হয়েছিলো। তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বাংলা তাকে শিখতেই হবে। যেমন বলা তেমন কাজ, তিনি সেই বছর পরীক্ষায় বাংলাতেই সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন।
ছাত্র সুভাষের বাবা ম্যাট্রিক পাশ করানোর পর তাকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় পাঠালেন।
সুভাষ যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এ অনার্সের ছাত্র, তখন একদিন হঠাৎ খবর পেলেন যে জনৈক ইংরেজ অধ্যাপক, তাদের ক্লাসের একটি ছেলেকে অত্যন্ত প্রহার করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তাদের শ্রেণির কিছু ছেলে ওটেন সাহেবের ঘরের বাইরে পায়চারি করছিলো এতে তিনি বিরক্ত হয়ে কিছুজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। ক্লাসের প্রতিনিধি হিসাবে, সুভাষচন্দ্র অধ্যক্ষের কাছে গিয়ে এর নালিশ করেছিলেন এবং বলেন যাদের সাথে মিস্টার ওটেন দুর্ব্যবহার করেছেন, তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। পরেরদিন ছাত্ররা ধর্মঘট করাতে, ওটেন সাহেব ছাত্রদের সাথে তৎকালীন মিটমাট করে নেন। কিন্তু মাসখানেক পর আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, এরপর ছাত্ররা সুভাষের নেতৃত্বে ওটেন সাহেবকে একদিন মারাত্মকভাবে জখম করেন। কর্তৃপক্ষ পরে বুঝতে পারেন যে এই ঘটনার পেছনে সুভাষের হাত আছে, ফলস্বরুপ তাঁকে কলেজ থেকে বহিস্কার করা হয়।
বি.এ পাশ করার পর ICS (INDIAN CIVIL SERVICE) পরীক্ষার জন্য সুভাষ বিলেত যাত্রা করলেন। সুভাষ ছিলেন প্রথম ভারতীয় যিনি ICS পরীক্ষায় চতুর্থ স্থানাধীকারী হয়েছিলেন। তাও মাত্র ৮ মাস পড়াশোনা করে। সাধারণত ICS পাশ করতে হলে ৪ বছর পড়াশোনা করতে হতো, কিন্তু সুভাষ চন্দ্র বসু মাত্র ৮ মাসেই সফলতা অর্জন করেছিলেন। এরপর যখন তিনি জানতে পারলেন যে তাকে কালেক্টার হতে হবে, ভারতের সম্পদ লুট করে তা ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিতে হবে, তখন তিনি ১৯২১ সালে ICS থেকে ইস্তফা নিয়ে নেন।
এর দুবছর পর অর্থাৎ ১৯২৩ সালে তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে ‘All India Youth Congress’-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতার মেয়র পদে নিযুক্ত হন।
সুভাষ চন্দ্র বসু দুইবার ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু গান্ধীজীর সাথে আদর্শগত মতভেদ হওয়ায় তিনি জাতিয় কংগ্রেস ত্যাগ করেন। তিনি মনে করতেন গান্ধীজীর অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে যথেষ্ট নয়। তিনি ১৯২১-৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি প্রায় ১১ বার কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিয়োজিত করে দিয়েছিলেন।
একবার সুভাষ চন্দ্র বসুকে এক ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের সাথে বৈঠকে আমন্ত্রন করা হয়েছিলো।
স্বভাবতই তিনি গিয়েছিলেন, তাঁর সাথে তিনি একটি ছাতা নিয়ে গিয়েছিলেন। যখন সুভাষ চন্দ্র বৈঠকখানায় প্রবেশ করেছিলেন, তখন তাকে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল বললেন যে, “এখানে ছাতা নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ”। কিন্তু সুভাষ চন্দ্র বিন্দুমাত্র ভীত না হয়ে ছাতার হাতল দিয়ে তার ঘাড় টেনে বললেন, “এটা আমার দেশ, আমি কি ব্যাবহার করবো কি না করবো, সেটা সম্পূর্ণ আমার বিষয়। আমি কোনো বিদেশির মতে পরিচালিত হব না।“
হলওয়েল মনুমেন্ট হটানোর উদ্যোগে সুভাষ চন্দ্র বসুকে ব্রিটিশরা গৃহবন্দি করেছিলো। কিন্তু সুভাষ চন্দ্র বসু ১৭ই জানুয়ারী ১৯৪১ সালে পাঠানের রুপে মহম্মদ জিয়াউদ্দিন নামে কলকাতা থেকে পেশোয়ার চলে যান। সেখান থকে আফগানিস্থান, রাশিয়া, ইতালি হয়ে জার্মানি পোঁছেছিলেন। সেখানে তিনি হিটলারের সাথে দেখা করলেন ও এক নিজস্ব সেনাবাহিনী তৈরি করার আবেদন করেন।
কিন্তু তিনি সন্দেহপূর্ণভাবে, জার্মানির, কিছু ঘটনায় সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন যে, জার্মানি তাকে সাহায্য করবে না। অবশেষে গোপনে সাবমেরিনে তিনি জাপানে পৌঁছলেন। সেখানে বিখ্যাত বিপ্লবী রাসবিহারী বসু ১৯৪৩ সালে সিঙ্গাপুরে এক সভার মাধ্যমে INA(Indian National Army) এর দায়িত্ব সুভাষ চন্দ্রের হাতে তুলে দেন। INA এর প্রধান সেনাপতি ছিলেন মোহন সিং।
এই INA-তে নেতাজী এক পৃথক মহিলা সেনাবাহিনী নির্মাণ করেন, যার প্রধান ছিলেন লক্ষ্মী স্বামীনাথান। সেই সময়ে নেতাজী এতই সম্মানীয় ছিলেন যে অনেক সাধারণ মানুষও INA-তে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তীরে এসে তরী ডুবে গেল। মনিপুরের, ইম্ফলে এসে INA জাপানের পুরো সমর্থন হারিয়ে ফেলেছিল।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের সম্পর্কে Axel Dorren Beach নামক জার্মান নেভি হিস্টোরিয়ান এক গোপন বৈঠক এর কথা বলেছিলেন। তিনি জানান যে ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ সালে জাপানের Maleaya বন্দরে নেতাজী জার্মানির অফিসারের সাথে গোপন চুক্তি করে ছিলেন। কিন্তু সেই চুক্তি এর বিষয় এখনো পর্যন্ত অজানা, রহস্যময়।
নেতাজির মৃত্যুরহস্য
নেতাজীর জীবন ছিল এক কথায় অনুপ্রেরণামূলক ও রহস্যময়। তার মৃত্যুর রহস্য এখনো অন্ধকারে ঢাকা। তবুও ঐতিহাসিকদের মত অনুযায়ী যে তত্ত্ব তৈরি হয়েছিলো যা অনেকে The theory of mysterious death of Subhash Chandra Bose বলে থাকে, তা হল কিছুটা এইরূপঃ
১৫ই আগস্ট ১৯৪৬ সালে হিরহিটো জাপানের ন্যাশানাল রেডিওতে ঘোষণা করল যে, তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করছে।
এর ঠিক পরের দিনে সুভাষ চন্দ্র বসু INA এর headquarter থেকে বেরিয়ে পড়েন। তিনি সাইগন ভিয়েতনাম থেকে ১৭ই আগস্ট ১৯৪৬ সালে জাপান কর্তক পরিচালিত প্লেন থেকে মানচুরিয়ার পথে যাত্রা করে ছিলেন। প্লেনে ছিলেন সুনামাসা সেডাই, জিনি কাওতাং আর্মির ভাইস প্রেসিডেন্ট। হঠাৎ তাইপতে যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য বিমানটি ক্রাশ করে ও দুজনেই মারা যান। কিন্তু তৎকালীন মানুষও ঐতিহাসিক ত্রুটি মানতে পারেননি।
আবার, ভিন্ন একটি মতে, নেতাজী ১৭ই ও ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫ সালে সাইগনেই ছিলেন।
তাঁর মৃত্যু রহস্যময় হলেও নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, আজীবন ভারতের মানুষের মনে অমর হয়ে থাকবে। ‘নেতাজী’ নাম সর্বদা আমাদের হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তথ্যসূত্র
- ‘নেতাজীর জীবনী’ – মনোরঞ্জন চৌধুরী
- ‘সুভাষচন্দ্র’ – নীলাঞ্জন মৈত্র
- ইন্টারনেট
লেখক পরিচিতি
দিপাংশু হালদার একজন দশম শ্রেণির ছাত্র। বর্তমানে সে উত্তরপাড়া অমরেন্দ্র বিদ্যাপিঠ-এ পড়াশোনা করছে । এই প্রবন্ধটি JUMP ম্যাগাজিন আয়োজিত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা