প্রবন্ধ বিভাগ
বাংলা বলি আমরা সকলেই, আমরা বাঙালি।
কিন্তু ভেবে দেখো বন্ধুরা যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমরা কতটা সঠিকভাবে বলি বা লিখি?
আমাদের ধারণা যত পরিষ্কার, আমাদের বলা-লেখা ততই সঠিক।
অনেকক্ষেত্রেই তোমাদের বাংলা বর্ণমালাগুলির ঠিক ঠিক ব্যবহার গুলিয়ে যায় আর তার সবথেকে বড়ো দৃষ্টান্ত এই ‘র-ড়-ঢ়’ সমস্যা। বলার সময় উচ্চারণ তো আমরা সঠিকভাবে করতে পারি না সবক্ষেত্রে। তাই লেখার সময়েও এর প্রভাব পড়ে বানান ভুল হয়ে যায়। এই নিবন্ধে এই বিষয় নিয়ে আলকপাত করার চেষ্টা করবো।
আমরা জানি বাংলায় তিনটি ‘র’ আছে। এই তিনটি ‘র’ উচ্চারণেও যেমন আলাদা, দেখতেও আলাদা। একই জায়গায় সবকটি বসতে পারে না।
‘র’ উচ্চারণ করতে গেলে জিভকে দাঁতের নীচের দিকে স্পর্শ করতে হয় আর ‘ড়’ উচ্চারণের সময় জিভ খুব দ্রুত মূর্ধাকে স্পর্শ করে আসে।
কোন অংশটাকে মূর্ধা বলে তাও জেনে নাও এখানেই। আমাদের মুখের ভিতরে উপরের দিকে দাঁতের পিছনের প্রথম অংশটিই হল মূর্ধা, পরের ভাগটি তালু। তাই ব্যাকরণের ভাষায় ‘র’ কে বলে দন্তমূলীয় ধ্বনি আর ‘ড়’ হল তাড়নজাত মূর্ধন্য ধ্বনি। তাড়নজাত মানে হল ধাক্কা দিয়ে উচ্চারণ করা।
দেখবে র-এর থেকে ড় উচ্চারণের সময় বেশি বায়ু নিঃসৃত হয় মুখ থেকে। আবার ঢ় উচ্চারণের ক্ষেত্রে ড়-এর থেকেও বেশি বায়ু নিঃসৃত হয় এবং এর গাম্ভীর্যও বেশি।
একটা টিপস দিতে পারি তোমাদের সঠিকভাবে উচ্চারণ করার জন্য।
ড় উচ্চারণের সময় জিভ সামান্য উল্টিয়ে উচ্চারণ করতে হবে তাহলেই ঠিকঠাক উচ্চারণ করা যাবে। র-এর ক্ষেত্রে তা আর করতে হবে না। আমরা সাধারণত ‘গুড়’ নয়, ‘গুর’ বলি। আবার বলি দাঁরা, ন্যারা। কিন্তু আসলে উচ্চারণ হওয়া উচিত এরকম – ‘ন্যাড়া’, ‘দাঁড়া’।
এবারে চলে আসি বানানের কথায়।
‘র’ আর ‘ড়’ নিয়ে বানানে এ যেন এক ভোজবাজি। কখন যে র হবে আর কখন ড় বসবে কি করে বুঝবে বলোতো? অপেক্ষা করো বন্ধুরা। এর জন্য শব্দের মানে বুঝে প্রয়োগ করা দরকার। তাহলেই আর ভুল হবে না। নীচে পরপর বাক্য সাজিয়ে কোথায় র হবে আর কোথায় ড় হবে তা তালিকার মাধ্যমে সাধ্যমতো তুলে দেওয়া হল। আশা করি এর মাধ্যমে তোমাদের সব দ্বন্দ্ব কেটে যাবে।
ক. গোরুগুলি মাঠে চরছে। (ঘাস খাওয়া, ঘোরা)
গোরুগুলি মাঠে চড়ছে। (কোনোকিছুতে ওঠা)
খ. পাহাড়ে চরতে আমার খুব ভালো লাগে। (ঘোরা)
পাহাড়ে চড়তে আমার খুব ভালো লাগে। (ওঠা)
গ. তেলের দাম এখন চড়া। (বেশি)
তেলের দাম এখন চরা। (নদীর মাঝে স্থলভাগ)
ঘ. গত দুদিন ধরে বিতানের জ্বর। (যাবৎ)
গত দুদিন ধড়ে বিতানের জ্বর। (দেহে)
ঙ. যাক বাবা! ধড়ে প্রাণ এলো। (দেহে)
যাক বাবা! ধরে প্রাণ এলো। (অর্থহীন)
চ. অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলাম। (বাইরে আসা)
অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে এলাম। (ঘুরে আসা)
ছ. কী শাড়ি পরেছ? (পরিধান করা)
কী শাড়ি পড়েছ? (পাঠ করা)
জ. কী বই পড়ছো? (পাঠ করা)
কী বই পরছো? (পরিধান করা)
ঝ. ওরা কাজ করে। (সর্বনাম)
ওড়া কাজ করে। (আকাশে ওড়া, এখানে অর্থহীন)
ঞ. ঘুড়ি ওড়ানো আমার নেশা। (আকাশে ওড়া)
ঘুড়ি ওরানো আমার নেশা। (অর্থহীন)
ট. এক ঘন্টা পরে ফোন করবে। (কিছুক্ষণ অন্তর)
এক ঘন্টা পড়ে ফোন করবে। (পাঠ করে)
ঠ. আমরা কাজ করি আনন্দে। (সর্বনাম)
আমড়া কাজ করি আনন্দে। (ফলবিশেষ)
উপরের তালিকায় লাল রঙে চিহ্নিত শব্দগুলি ভুলভাবে প্রযুক্ত হয়েছে বাক্যে, সঠিকটি চিহ্নিত হয়েছে সবুজ রঙ দিয়ে।
আরো পড়ুন: প্রবন্ধ বিভাগ | বিজ্ঞানের ইতিহাস বিভাগ | প্রযুক্তি বিভাগ | কেরিয়ার বিভাগ
এখন আরো কিছু এমন শব্দের তালিকা দেবো যেগুলিতে এই র এবং ড় খুবই ভুল হয় বাক্যের মধ্যে। শব্দগুলির প্রকৃত অর্থ মনে থাকলে আর এই ভুল হবে না। শব্দগুলি অনেকটা ব্যাকরণের সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের মতো।
ক. অসার – নিরর্থক, অপ্রয়োজনীয়
অসাড় – অনুভূতি নেই এমন
খ. আর – এবং / ও
আড় – তেরছা
গ. পার – পার হওয়া / সীমানা
পাড় – নদী বা পুকুরের ধার
ঘ. পারা – সক্ষমতা
পাড়া – এলাকা / কিছু টেনে নামানো
ঙ. মোড় – রাস্তার সংযোগস্থল
মোর – আমার
মোটামুটিভাবে এই তালিকায় চোখ বোলালে পরিস্কার হয়ে যাবে কোথায় র বসবে আর কোথায় ড় বসবে। তবে এই তালিকাই কিন্তু সম্পূর্ণ নয়, এর বাইরে আরো বহু প্রয়োগ থাকতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস আজকের আলোচিত ধারণাগুলি কাজে লাগিয়ে তোমরা সেগুলি সহজেই আয়ত্ত করে নিতে পারবে।
লেখক পরিচিতিঃ
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – সাপ্তাহিক ইমেইল আপডেট
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা