উচ্চ মাধ্যমিকে সর্বাধিক আলোচিত বিষয় হলো বিজ্ঞান বিভাগ। কেউ উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো করতে পারুক অথবা না পারুক, সে বিজ্ঞানের ছাত্র অথবা ছাত্রী, এটাই সাধারণ মানুষের সম্ভ্রম আদায় করে নেয় । বাস্তব ব্যাপারটি কিন্তু একটু অন্যরকম। বহু ছাত্রছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিকে অথবা তার পরে কেরিয়ারে বিজ্ঞানের দিশা গুলি না ভেবেই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে। এর ফলে পরবর্তী সময়ে তাদের যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই পর্বে আমরা আলোচনা করবো মাধ্যমিকের পর বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গেলে কি কি বিষয় মাথায় রাখা উচিৎ।
[আরো পড়ুন – উচ্চ মাধ্যমিকে কলা বিভাগ]
বিজ্ঞান কেন পড়ব?
সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষের মনে তার চারপাশে চলে আসা বিভিন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন কৌতূহলরূপে উঁকি মেরে চলেছে। পৃথিবীটা কিভাবে চলে, প্রকৃতির কোন নিয়মের বশে, কিসের খেয়ালে বিভিন্ন পরিবর্তনগুলি সাধিত হয়ে থাকে সেই সবেরই উত্তর দেয় বিজ্ঞান। মানুষের ব্যবহারিক জীবনের প্রশ্নের বা সমস্যার উত্তর দেয় বিজ্ঞান। তুমি যদি কৌতূহলী হও, চারপাশে বিভিন্ন ব্যবহারিক সমস্যা দেখছো (যেমন হিংশ্র পশুর খাদ্য হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে আগুনের ব্যবহার, বা কোনো ভারী বস্তু টেনে নিয়ে যেতে চাকার ব্যবহার) যেগুলোর সমাধান করতে আগ্রহী, যন্ত্রপাতিতে বা প্রকৃতির নিয়ম খুঁজতে, তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ছন্দের আনন্দ নিতে তোমার বিশেষ ঝোঁক থাকে তবে তোমার জন্যই বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান পড়ে কি হবে?
অনেকের মনে একটা ধারণা রয়েছে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া বিজ্ঞান পড়ে দ্রুত প্রতিষ্ঠা পাওয়া অসম্ভব। তার বাস্তব কারণটা হচ্ছে আমাদের দেশের জনসংখ্যাপিছু ডাক্তারের অভাব এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে ক্যাম্পাসিং। সাধারণত মনে করা হয় যদি কেউ সাধারণ বিষয় নিয়ে পড়ে তবে তাদের জন্য স্কুলে শিক্ষকতা করা ছাড়া বা সরকারি চাকরিতে যোগদান ছাড়া প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সব রাস্তা বন্ধ। কিন্তু এছাড়াও দেশের সার্বিক বিকাশে আরো অনেকরকম ভাবে বিজ্ঞানে শিক্ষিত ছাত্রছাত্রীর প্রয়োজন।
এমন কিছু পেশা যেগুলির ভারতে চাহিদা আছে কিন্তু সেরকম মানবসম্পদের যোগান নেই: রসায়নবিদ, মানচিত্রকার, পরিসংখ্যানবিদ, প্যারামেডিকাল, কৃষিবিজ্ঞানী, ভূনিরীক্ষক ইত্যাদি। এই সকল কর্মক্ষেত্রের কথা এই সিরিজের পরবর্তী পর্বগুলোতে বিশদে আলোচনা করা হবে।
বিজ্ঞানে কি কি আছে?
বিজ্ঞানের অনেকগুলি দিক আছে। খুব সরল ভাবে বললে, বিজ্ঞানের বহুমুখতাকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।
- মৌলিক বিজ্ঞান (Fundamental Science)
- ব্যবহারিক বা প্রয়োগমূলক বিজ্ঞান (Applied Science)।
মৌলিক বিজ্ঞানে পদার্থবিদ্যা (Physics), রসায়ন (Chemistry), ভূতত্ত্ব (Geology), নৃতত্ত্ব (Archeology), উদ্ভিদবিদ্যা (Botany), প্রাণিবিদ্যা (Zoology), শারীরবৃত্তীয় বিদ্যা (Physiology), জ্যোতির্বিদ্যা (Astronomy), মহাকাশ বিজ্ঞান (Space Research) প্রভৃতি অন্তর্গত।
অপরদিকে ব্যবহারিক বিজ্ঞানে মনস্তত্ত্ব (Psychology), পুষ্টিবিদ্যা (Nutrition), বাস্তুবিদ্যা (Home science), স্থাপত্য (Archeology), পরিবেশবিদ্যা (Environmental Science and Ecology), জীব রসায়ন (Biochemistry), জীবাণুবিজ্ঞান (Microbiology), জেনেটিক্স (Genetics), আণবিক জীববিদ্যা (Molecular Biology), aeronotics, robotics, oceanography, forestry আরো অনেক আন্তর্বৈষয়িক বিষয়ের নাম ভাবা যেতে পারে। এছাড়া চিকিৎসাবিজ্ঞান (Medical Science) ও কারিগরিবিজ্ঞান (Engineering) ব্যবহারিক বিজ্ঞানেরই অঙ্গ।
গণিত (Mathematics), ভূগোল (Geography), অর্থনীতি (Economics), দর্শন (Philosophy) এই চারটি বিষয়কে কোনো বিশেষ তালিকা ভুক্ত না করা গেলেও গণিতের সাথে অর্থনীতি বা ভূগোল নিলে সেটিকে বিজ্ঞান বলে মান্যতা দেওয়া হয়। কিন্তু গণিতকে বিজ্ঞানের শস্ত্র (Tools) ও অর্থনীতি বা ভূগোলকে বিজ্ঞানের পেরিফেরাল বিষয় (Peripheral Subject) হিসাবে ধরা হয়। দর্শন সব বিষয়েরই অন্তর্নিহিত তত্ত্ব।
[আরো পড়ুন – উচ্চ মাধ্যমিকে বাণিজ্য বিভাগ]
বিজ্ঞান পড়তে কি লাগে?
বিজ্ঞান পড়ার প্রথম পূর্বশর্ত হলো যুক্তিবোধ। আমাদের দেশের পরীক্ষা ব্যবস্থা নিচু শ্রেণীতে যুক্তির থেকে স্মৃতিকে বেশি গুরুত্ত্ব আরোপ করে থাকে। কিন্তু একাদশ শ্রেণীতে ওঠার পরে এর চূড়ান্ত ব্যতিক্রম ধরা পড়ে। প্রশ্নের আদল বদলে গিয়ে কার্যকারণ সম্পর্কিত প্রশ্ন আসতে শুরু করে।
যারা মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভালো নাম্বার পেয়েছে মানে নেই যে উচ্চমাধ্যমিকে তারাই ভালো করবে। সুতরাং এখানে ভালো নম্বর নয়, ভালো যুক্তিবোধ উচ্চমাধ্যমিকে সাফল্য এনে দিতে পারে। মুখস্থ করে বা সাজেশনভিত্তিক পরীক্ষামুখী প্রস্তুতি ক্রমশঃ অবলুপ্ত হয়ে পড়ছে, পরীক্ষার নিয়ামক বোর্ডগুলিও ধীরে ধীরে এরকম প্রশ্ন থেকে বিরত থাকছে। এমন প্রশ্ন করা হচ্ছে যেগুলি কেবলমাত্র জানলে তবেই পারা যাবে। যুক্তিভিত্তিক প্রশ্নের অনুপাত ক্রমবর্ধমান।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে বিষয় বোঝার দক্ষতা। বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে কোনো ছাত্রছাত্রী যে বিষয়টি নিজের মতো করে বুঝতে পারে তাদের সেই বিষয়ে দক্ষতা চূড়ান্ত হয়। মৌলিক চিন্তা করার ও নিজের ভাবকে পরিষ্কার করে ফুটিয়ে তুলতে কোনো বিষয়কে নিজে বোঝার থেকে ভালো কিছু নেই। নোটবন্দি প্রশ্নোত্তর অনেকটা লটারির মতো, সেখানে নিজের ভাষা ও ভাবের অভাব থেকে যায়, আর জানা অংশ থেকে প্রশ্ন আসলেও না বুঝতে পারার কারণে প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও সম্ভব হয় না।
এখানেই কোনো বিষয়ের সম্পর্কে তথ্য জানা ও সেই বিষয়টিকে বুঝে তথ্যটির আত্মস্থ করার মধ্যে তফাৎ। জয়েন্ট বা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরীক্ষায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের এখানেই অসুবিধে হয়। আমাদের একটি দোষ হচ্ছে আমরা পরের শ্রেণীতে উঠে আগের শ্রেণী ভুলে যাই। উচ্চমাধ্যমিকের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে। কারণ অধিকাংশ যুক্তিমূলক প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে থাকে আগের শ্রেণির ভিত্তিমূলক জ্ঞানের মধ্যে।
বিজ্ঞান কিভাবে পড়ব?
তাহলে এই দু বছর বিজ্ঞান পড়বো কিরকম করে? এখানে তোমার কি কি বিষয় combination আছে সেটি দেখতে হবে। তবে মোটামুটি একটা আইডিয়া করে চলা যেতে পারে। বছরের প্রথম থেকে study plan থাকা আবশ্যক। কোন বিষয়ের কোন চ্যাপ্টারের কোনখান থেকে কতটা কোন কোন সপ্তাহে পর্বে তার সম্বন্ধে প্রথমেই একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। আমাদের ম্যাগাজিনের পাতায় চোখ রাখলে কয়েকদিনের মধ্যেই কয়েকটি নমুনা study plan পেতে পারো। সেই study plan এ প্রত্যেকটি চ্যাপ্টারের শেষে পরীক্ষা দিয়ে সেই চ্যাপ্টার থেকে কি কি ধরণের প্রশ্ন আসতে পারে তার সম্বন্ধে ধারণা তৈরী করতে হবে।
প্রত্যেকটি বিষয়ের মূল ধারণা গুলি বুঝে নিয়ে নিজেকে বার বার সেটি ব্যাখ্যা করতে হবে. Derivation ও reaction, graph ও map অভ্যাস করতে হবে। সর্বোপরি ভয় পেলে চলবে না, নম্বর এর দিকে ছোটা প্রথম থেকে চলবে না। ফাইনাল পরীক্ষার সব প্রশ্ন এমনিতেই পারার মতো আসে। সুতরাং শেষ পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার চিন্তা না করলেও চলবে। কিন্তু নিজেকে এমন ভাবে তৈরী করতে হবে যাতে বিষয় গুলি পরবর্তীজীবনে প্রয়োগ করার জায়গায় থাকে। মনে রাখার চেষ্টা ভুলে যাওয়ার কারণ। মনে রাখার চেষ্টা না করে যুক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধানের approach ই জায়গায় বসে বিজ্ঞানের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আসল চাবিকাঠি।
এই ধারাবাহিক রচনাটি সমাপ্ত হল।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা