“আপনার কি মনে হয়? ‘বোস’ কি তার যোগ্য সম্মান পাননি?”
“আপনি বলবেন হ্যাঁ অবশ্যই, ওনার তো মনে হয় অন্তত একটা নোবেল প্রাপ্য ছিল!”
“কিন্তু আপনি কি জানেন যে উনি তো তার থেকেও বড়ো সম্মান পেয়েছেন। পৃথিবীর অধিকাংশ কণাই ওনার কথা মেনে চলে“।
হ্যাঁ, ইনি অন্য বোস।
সুভাষ নয়, ঢাকার ছেলে সত্যেন্দ্রনাথ বোস। তার জন্ম কলকাতায় আর পড়াশোনাও সেখানেই। আচার্য্য জগদীশচন্দ্র বোস, আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র ছিলেন তাঁর শিক্ষক। কলকাতার হিন্দু স্কুল ও পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর পড়াশোনা (M. Sc. তে তিনি পান রেকর্ড নাম্বার; ৯২%, তৃতীয় পত্রে ১০০) প্রথম থেকেই সত্যেন ছিলেন অংকের অনুরাগী। মিশ্র গণিতেই ছিল তাঁর পান্ডিত্য। তা সত্ত্বেও সারা জীবন তিনি ফিজিক্সের উপর নিজের মন-প্রাণ ঢেলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সত্যিকারের শিক্ষার্থীকে কোনো বিষয়ের ধরা বাঁধা গন্ডিতে বেঁধে রাখা যায় না।
মেঘনাদ সাহার কথা এখানে না বললেই নয়।
পরবর্তীকালের ভারতসেরা বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা তার স্কুল জীবনের প্রায় প্রতি পরীক্ষাতেই দ্বিতীয় হতেন, পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও। কারণ তাঁর সহপাঠী ছিলেন সত্যেন। কথিত আছে যে মেঘনাদ সাহা একবার নাকি ১০০ তে ১০০ পেয়েছিলেন। তাতেও তিনি ক্লাসে দ্বিতীয় হন, কারণ সত্যেন ১০০ তে ১১০ পেয়ে বসে আছেন।
কিন্তু সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখনো তাঁদের সম্পর্ককে চিড় ধরাতে পারেনি।
তার সহযোগিতাতেই সত্যেন বোস, আইনস্টাইনের পাবলিশ করা জার্মান ও ফ্রেঞ্চ ভাষার পেপার গুলো সর্বপ্রথম ইংলিশে প্রকাশ করে গ্রন্থনা করেন। এই সময়েই সত্যেন ও মেঘনাদ প্রচুর গবেষণাপত্র (ফিজিক্সের ও বিশুদ্ধ গণিতের ওপর) যৌথভাবে প্রকাশ করেন। তার মধ্যে একটি পেপার ছিল ক্ল্যাসিকাল ফিজিক্সের নীতিকে অগ্রাহ্য করে প্ল্যাঙ্ক সাহেবের কোয়ান্টাম রেডিয়েশন সূত্রের ডেরিভেশন।
এতে বলা ছিল কিভাবে পরমাণুর ভেতরে থাকা আরো ছোট কণাগুলিকে গুনতে হবে। কিন্তু কোনো ইউরোপিয়ান জার্নালই তাঁর এই পেপার পাবলিশ করতে চাইছিলো না। কারণ ফিজিক্সের সকল স্তম্ভগুলিতে তিনি একসাথে আঘাত করেছিলেন। ভেঙে যাচ্ছিলো ম্যাক্সওয়েল ও বোলৎজম্যান সাহেবের কণাতত্ব, ভেঙে যাচ্ছিলো নিউটনের তত্ত্ব। লোকে তা ‘নেটিভ ইন্ডিয়ানের’ পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলো।
কিন্তু আরেকজন ‘পাগল’ ছিলেন যার কথা ইউরোপিয়ানরা শুনতেন।
তিনি আলবার্ট, আলবার্ট আইনস্টাইন। সত্যেন তাকে ‘তার নিজের খোঁজ’ সম্বন্ধে জানিয়ে এক বিখ্যাত চিঠি লেখেন। সাথে পাঠিয়ে দেন নিজের পেপারটি, যেটি কিনা আইনস্টাইনেরই জেনারেল ও স্পেশাল রিলেটিভিটির ওপর ভিত্তি করে লেখা। আইনস্টাইন বোসের পেপারটি পেয়ে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ছাপিয়ে দিলেন। সারা পৃথিবী ধন্য ধন্য করে উঠলো।
পৃথিবীর কাছে সত্যেন হয়ে উঠলেন ‘বোস’।
তিনি গণিত ও পদার্থবিদ্যার নতুন করে বিবাহ দিলেন। জন্ম নিলো বোস-আইনস্টাইন স্টাটিস্টিক্সের। যার কথা আজ অধিকাংশ কণা মেনে চলে। যাদেরকে তাঁর নাম অনুসারে ডাকা হয় ‘বোসন’ হিসেবে। শুধু তাই নয়, জন্ম নিলো পদার্থের নতুন এক অবস্থা: বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট।
পদ্মবিভূষণ সত্যেন্দ্র নাথ বসু কেবল মাত্র যে পদার্থবিদ হয়ে সীমিত ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন পলিগ্লট (polyglot – অর্থাৎ যিনি অনেকগুলো ভাষায় সমান ভাবে দক্ষ) এবং পলিম্যাথ (polymath – অর্থাৎ যিনি এনেকগুলি বিষয়ে সমান পারদর্শী)।
তিনি বাংলা ও ইংলিশের পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও সংষ্কৃতে সমান দক্ষ ছিলেন। তাঁর প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ছিল এস্রাজ। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার তিনি প্রবল পক্ষপাতী ছিলেন। এই নিয়ে বহু রচনাও তিনি করেছেন। পলিম্যাথ হিসেবে তিনি কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, আর্টস, ধাতুবিদ্যা, দর্শন, সাহিত্য ও সংগীতেও সমান দক্ষ ছিলেন।
ভাবুন আজকের সময়ে ছাত্রছাত্রীরা কোনো একটি বিষয়ে স্নাতক হতেই মাথা খারাপ করে ফেলে, আর সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সত্যেন বসু এতগুলি বিষয়ে সমান সাবলীল ছিলেন।
বলা হয় যে তিনি যদি পদার্থবিদ (বা গণিতবিদ, আপনি যেভাবে দেখবেন) না হতেন, তবে তিনি এগুলোর মধ্যে যে কোনো কিছু হতে পারতেন। তিনি পদার্থবিদ হয়েছেন, তাই বাকি ফিল্ডগুলো এক মনীষীকে হারিয়েছে, আর কিছু নয়। সত্যেন বোস দেখিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিভাকে কোনো বিষয়ের ধরাবাধা নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায় না, আর তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, ‘মাতৃভাষাই বিজ্ঞান চর্চার প্রকৃষ্ট উপায়।’
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা