Madhyamik

নদীর কাজের ধারণা ও সৃষ্ট ভূমিরূপ

দশম শ্রেণি | বিষয়: ভূগোল । অধ্যায়:বহির্জাত প্রক্রিয়া ও সৃষ্ট ভূমিরূপ (পর্ব -২)

আগের পর্বে আমরা নদীর গতিপথ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই পর্বে নদীর কাজের ধারণা নিয়ে আলোচনা করবো।

নদী তার জীবনচক্রে তিনটি মুখ্য কাজ সম্পন্ন করে থাকে। সেগুলো হল যথাক্রমে ক্ষয়, বহন ও সঞ্চয়। 

নদীর ক্ষয়কাজ

নদীর উচ্চগতি বা পার্বত্য প্রবাহে ভূমির ঢাল অত্যন্ত বেশি ও ভূমিরূপের বন্ধুরতার জন্য নদীর জলরাশির বেগ খুব তীব্র হয়। এর ফলে নদী তার গতিপথের যে কোনো বাধাকেই সহজে চূর্ণ বিচূর্ণ করে স্থানচ্যুত করে ফেলতে পারে।

নদীর দ্বারা ক্ষয় কাজ দুই ভাবে সম্পন্ন হয়, যথা নিম্ন ক্ষয় ও পার্শ্ব ক্ষয়।

মনে রাখতে হবে যে, নদী তার সব গতিতেই কিছু না কিছু ক্ষয় কার্য করে। নদী পার্বত্য প্রবাহে নিম্ন ক্ষয় কাজ ও মধ্যগতিতে পার্শ্ব ক্ষয় সব থেকে বেশি করে থাকে। নিম্নগতিতে ক্ষয় কাজের পরিমাণ নগণ্য।

jump magazine smart note book

নদী দ্বারা এই ক্ষয় কাজ কতগুলি পদ্ধতি দ্বারা হয়ে থাকে। সেগুলো হল –

জলপ্রপাত ক্ষয়

জলের প্রচন্ড আঘাতে নদী খাত বা নদীর পাড়ের দুর্বল শিলা আলগা হয়ে স্থানচ্যুত হয়।

অবঘর্ষ ক্ষয়

নদী খাতের তলদেশ নদী দ্বারা বাহিত নুড়ি, বোল্ডার ও পাথরের আঘাতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

ঘর্ষণ ক্ষয়

নদী বাহিত বড়ো বড়ো বোল্ডারের নুড়ি জলের স্রোতে পরস্পরের আঘাতে ও ঘর্ষণে আস্তে আস্তে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কাঁকর, বালি ও পরবর্তীতে সূক্ষ্ম পলিকনায় পরিণত হয়।

সংঘর্ষ ক্ষয়

নদীর দ্বারা বাহিত বড়ো বড়ো বোল্ডার নদীখাত এ অবস্থিত বিশালাকৃতির শিলা খন্ডগুলিকে সজোরে আঘাত করে ক্ষয় ও চূর্ণ বিচূর্ণ করে।

jump magazine smart note book

বুদবুদ ক্ষয়

নদী গর্ভে শিলা খন্ডগুলি জল ও বাতাস দ্বারা সৃষ্ট বুদবুদ এর বিস্ফোরণ এর ফলে চূর্ণবিচূর্ণ হয়।

দ্রবণ ক্ষয়

নদীর জলের সাথে শিলায় উপস্থিত খনিজ (যেমন – লবণ) রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রবীভূত হয়ে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়।

নদীর বহন কাজ

আমরা নদীর ক্ষয় কার্য সম্পর্কে জানলাম, খুব স্বাভাবিক ভাবে এই ক্ষয় কার্যের ফলে স্থানচ্যুত উপাদান যথা পাথর, নুড়ি, কাঁকর, বালি, কাদা নদীর জলস্রোতের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়, এটিই নদীর বহন কাজ রূপে পরিচিত।  নদীর বহন কাজ নদীর জলের স্রোতের বেগ ও নদীর জলরাশির পরিমাণ এর উপর নির্ভরশীল। যেমন – বন্যা বা হড়পা বানের সময় নদীর বহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

নদীর বহন কাজকে আবার বেশ কিছু ভাগে ভাগ করা যায়।

ভাসমান বহন

ক্ষুদ্র পলিকনা ও কাদা জলে থিতিয়ে না পড়ে জলস্রোতের সাথে ভেসে বহুদূরে স্থানান্তরিত হয়।

লম্ফদান বহন

অপেক্ষাকৃত বড় শিলাখন্ড নদীর তলদেশে জলস্রোতের প্রভাবে লাফাতে লাফাতে সামনের দিকে স্থানান্তরিত হয়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

গড়ানো প্রক্রিয়ায় বহন

ছোট নুড়ি, কাঁকর প্রধানত নদীর স্রোতের টানে নদী খাতের তলদেশে গড়াতে গড়াতে স্থানান্তরিত হয়।

দ্রবণ বহন

নদীর দ্রবণ ক্ষয়ের ফলে উৎপন্ন উপাদান যেমন লবণ, চুনাপাথর নদীর জল এর সাথে দ্রবীভূত অবস্থায় স্থানান্তরিত হয়।

jump magazine smart note book

নদীর সঞ্চয় কাজ

ভূমির ঢাল হ্রাস এবং জলরাশির পরিমাণ হ্রাস পাবার কারণে নদীর বহন ক্ষমতা হ্রাস পায়, ফলে বাহিত উপাদানগুলি নদীর তলদেশ এবং উপত্যকার বিভিন্ন স্থানে সঞ্চিত হয়। এই প্রক্রিয়াকেই সঞ্চয় বা অবক্ষেপণ বলা হয়। নদীর নিম্ন ও মধ্য গতিতেই নদী মূলত সঞ্চয় কার্য করে থাকে।


নদীর কাজের ধারণার পাঠ শুনুন এই ভিডিও থেকে ↓

নদীর কাজের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ

আমরা নদীর বিভিন্ন কাজের সম্পর্কে পরিচিত হলাম, নদীর এই সকল কাজের ফলে নানান ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। আমরা একে একে এগুলি সম্পর্কে পরিচিতি লাভ করবো।

উচ্চ গতি বা পার্বত্য প্রবাহে সৃষ্ট ভূমিরূপ

V আকৃতির উপত্যকা

আমরা আগে নদীর ক্ষয় কার্যের কথা জেনেছি, নদীর পার্বত্য প্রবাহে নদীর বেগ অত্যন্ত বেশি থাকায় নদীর সম্পূর্ণ শক্তি মূলত নিম্নক্ষয় করতেই খরচ করে, পার্শ্ব ক্ষয় খুব কম হয়। নদী খাতের পার্শ্ব ক্ষয় অপেক্ষা নিম্ন ক্ষয় অনেক বেশি হওয়ায় ইংরেজি v অক্ষরের মতো নদী উপত্যকার সৃষ্টি হয়।

V-আকৃতির ভূমিরূপের সৃষ্টি

মনে রাখতে হবে, অতি খরস্রোতা নদী, পুঞ্জ ক্ষয়, খাঁড়া ভূমি ঢাল V আকৃতির উপত্যকা তৈরির সহায়ক।

গিরিখাত ও ক্যানিয়ন

পার্বত্য অঞ্চলে নদীর অত্যধিক নিম্ন ক্ষয়ের ফলে যে অতি গভীর এবং সংকীর্ণ নদী উপত্যকা তৈরি হয় তাকে গিরিখাত বলা হয়। পৃথিবীর গভীরতম গিরিখাত হলো নেপাল এর কালিগণ্ডকী বা অন্ধা গলচি (5571 মি:)।

কালিগণ্ডকী নদী

সাধারণ শুষ্ক অঞ্চলে নদীর জলরাশির পরিমাণ কম হওয়ার দরুন নদী শুধু নিম্নক্ষয় করতেই সক্ষম হয়। পার্শ্ব ক্ষয় হয়না বললেই চলে ফলে সেক্ষেত্রে ইংরেজির ‘I’ আকৃতির মত সুগভীর ও সংকীর্ণ নদী উপত্যকার সৃষ্টি হয়, যাকে ক্যানিয়ন বলা হয়।

I আকৃতির ভূমিরূপ

প্রধানত চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলেই ক্যানিয়ন সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো নদীর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ( 446 কিমি দীর্ঘ ও 1.6 কিমি চওড়া) হলো পৃথিবীর দীর্ঘতম ক্যানিয়ন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

গিরিখাত ও ক্যানিয়ন সৃষ্টির পদ্ধতি একই হলেও এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য বিদ্যমান।

  • গিরিখাত এর আকৃতি অত্যন্ত সংকীর্ণ, গভীর ও ‘v’ আকৃতির হয়।
  • অন্যদিকে ক্যানিয়ন অপেক্ষাকৃত চওড়া, গভীর ও ‘I’ আকৃতির হয়।
  • গিরিখাত মূলত নিম্নক্ষয় ও স্বল্প পরিমাণ পার্শ্ব ক্ষয় এর মিলিত কার্যের ফলে সৃষ্টি হয়। কিন্তু, ক্যানিয়ন প্রধানত নিম্নক্ষয়ের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়।
  • গিরিখাত পার্বত্য ভূমিরূপে খরস্রোতা নদী ও অধিক বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চলে গঠিত হয়। চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চল চিরপ্রবাহী নদী দ্বারা সৃষ্টি হয়।

দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

জলপ্রপাত

নদীতে প্রবাহপথে হঠাৎ ভূমিরূপের ঢাল হ্রাস পেলে জলরাশি প্রবল বেগে উপর থেকে নিচে পতিত হয়ে জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে।

জলপ্রপাত সৃষ্টির শর্তগুলি হল –

  • প্রবাহ পথে কোমল ও কঠিন শিলা অনুভূমিকভাবে অবস্থান, কোমল শিলার দ্রুত ক্ষয়ের মাধ্যমে ভূমি ঢালের পরিবর্তন।
  • প্রবাহ পথে আড়াআড়িভাবে চ্যুতি থাকলেও জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। যেমন – নর্মদা নদীর উপর কপিলধারা, ইন্দ্রাবতি নদীর উপর চিত্রকোট, ধুঁয়াধর ইত্যাদি।
  • হঠাৎ ভূমি ঢালের পরিবর্তন অর্থাৎ কোনো উচ্চ ভূমি ও নিম্নভূমি খাড়াভাবে মিলিত হলে জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়। যেমন – কর্ণাটকের সরাবতি নদীর উপর গেরোসপ্পা বা যোগ জলপ্রপাত (253 মি:)।
  • হিমবাহের ক্ষয়কার্যের ফলে উৎপন্ন ঝুলন্ত উপত্যকা থেকে নিচে বরফগলা জল পতিত হয়ে জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে থাকে।
  • নদীর নিক বিন্দু অর্থাৎ পুরানো ও নতুন ঢালের মিলনস্থলেও জলপ্রপাত সৃষ্টি হয়। সুবর্ণরেখা নদীর জনা ও দশম জলপ্রপাত হল এই প্রকারের জলপ্রপাত।

জলপ্রপাতের পশ্চাৎ অপসরণ

জলপ্রপাতের উৎসের দিকে সরে যাওয়াকে জলপ্রপাতের পশ্চাৎ অপসরণ বলা হয়। জলপ্রপাতের উপরের দিকের অংশে কঠিন শিলা এবং নিচে কোমল শিলা থাকে। স্বাভাবিক ভাবেই কোমল শিলা, কঠিন শিলা অপেক্ষা দ্রুত ক্ষয়ে যায়। এর ফলে উপরে একটা ঝুলে থাকা অংশ সৃষ্টি হয়। সময়ের সাথে ঐ কঠিন শিলা ভেঙে পড়ে এবং জলপ্রপাত উৎসের দিকে সরে যায়।

জলপ্রপাত

প্রপাতকূপ বা প্লাঞ্জপুল

জলপ্রপাতের নিচে জলের ক্রমাগত চাপ এবং জলের সাথে বয়ে আসা নুড়ি ও পাথরের ঘর্ষণের ফলে নিচু গর্তের মত অংশকে প্রপাত কূপ বলা হয়।

উদাহরণ: চেরাপুঞ্জির নহকালিকাই জলপ্রপাত এ প্লাঞ্জপুল দেখা যায়।

চেরাপুঞ্জি

খরস্রোত

নদীর প্রবাহ পথে কোমল শিলা ও কঠিন শীলা উল্লম্বভাবে অবস্থান করলে কোমল শিলা বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সিড়ির ধাপের মত ভূমিরূপ সৃষ্টি করলে নদীর জল ধাপে ধাপে নেমে এসে খরস্রোত সৃষ্টি করে।

উদাহরণ: আফ্রিকার নীল নদ এর প্রবাহ পথে এরকম অনেকগুলি খরস্রোত সৃষ্টি হয়েছে।

মিশরের নীল নদ

অনেকগুলি খরস্রোত একসাথে পাশাপাশি অবস্থান করলে, তাকে ক্যাসকেড বলে। উদাহরণ: কর্ণাটকের ভারহি নদীর উপর কুঞ্চিকল ক্যাসকেড।

আবদ্ধ বা শৃঙ্খলিত শৈলশিরা

নদীর পার্বত্য প্রবাহে নদী তার গতিপথে অবস্থিত পাহাড় বা শৈলশিরা এড়াতে এঁকে-বেঁকে প্রবাহিত হয়, এর ফলে দূর থেকে দেখলে মনে হয়, শৈলশিরাগুলি শৃঙ্খলের মত অবস্থান করছে। একেই শৃঙ্খলিত শৈলশিরা বলা হয়। হিমালয় পর্বতমালার তিস্তা, তোর্সা নদীর গতিপথে এরকম অনেক আবদ্ধ শৈলশিরা দেখা যায়।

তিস্তা নদী

মন্থকূপ বা পটহোল

নদীর গতিপথে কোমল শিলা থাকার ফলে নদীর জলস্রোতের বয়ে আনা নুড়ি-পাথরের ক্রমাগত ঘর্ষণ ও পাক খাওয়ার এর ফলে নদী গর্ভে গোলাকার গর্তের সৃষ্টি হয় যাকে মন্থ কূপ বা পটহোল বলা হয়। অনেকগুলি মন্থকুপ একসাথে পাশাপাশি অবস্থান করলে, তাকে পটহোল কলোনি বলা হয়।

উদাহরণ: ঘাটশিলাতে সুবর্ণরেখা নদীতে এরকম অনেক মন্থকূপ দেখা যায়।

দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব – মধ্য গতি ও নিম্ন গতিতে সৃষ্ট ভূমিরূপ


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখিকা পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তনী শ্রেয়সী বিশ্বাস। পড়াশোনা এবং লেখালিখির পাশাপাশি, ছবি আঁকা এবং বাগান পরিচর্যাতেও শ্রেয়সী সমান উৎসাহী।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-Geo-1b