ইতিহাস – দশম শ্রেণি – বিশ শতকের ভারতে নারী, ছাত্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলনঃ বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ (পর্ব – ১)
আজকের পর্বে আমরা বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে জানবো।
ব্রিটিশ বিরোধী গণআন্দোলনে ভারতীয় নারী সমাজের ভূমিকা খুবই প্রাসঙ্গিক। ভারতীয় উপেক্ষিত, অবহেলিত নারীসমাজ উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ধীরে ধীরে জাগ্রত হতে শুরু করে।
তবে এর পিছনে রয়েছে কিছু আইন। 1829 এর সতীদাহ প্রথা বিরোধী আইন, 1856 এর বিধবা বিবাহ আইন, 1891 এর দশ বছরের নীচের বালিকাদের সহবাস সংক্রান্ত আইন পুরুষশাসিত সমাজের মধ্যে নারীর অস্ত্বিত্ব রক্ষায় প্রথম পদক্ষেপ রাখে।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
সেই সময়ে এর কার্যকারী আদেও হয়েছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় থাকলেও এই সকল আইনের লোকসমাজে চর্চাও নারীদের সংসারের কোণ থেকে বেরিয়ে আসার পথে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল।
এই সময় থেকেই নারীশিক্ষার উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি আরোপিত হয়। নারীশিক্ষার অগ্রগতির জন্য অনেক স্কুল,কলেজ তৈরি হয়েছিল। সমাজের ভয়ভীতিকে দূরে সরিয়েই ধীরে ধীরে নারীরা বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রবেশ করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক এবং ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বিনী গাঙ্গুলি কংগ্রেসের 1890 এর কলকাতা অধিবেশনে প্রবেশ করেন, তিনি ছাড়াও ছিলেন ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী ঘোষাল। নারীসমাজকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যেমন, ভারতী, সুপ্রভাত, বেণু উল্লেখযোগ্য।
[বিঃদ্রঃ এই সব পত্রিকাগুলি বেশিরভাগই বিভিন্ন বিদুষী নারী দ্বারা সম্পাদিত হত]
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীসমাজের ভূমিকা
1905 সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন থেকেই মূলত নারীরা জাতীয় আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হতে শুরু করে। রবি ঠাকুরের ডাকে সম্প্রীতির লক্ষ্যে রাখীবন্ধনই হোক আর বিশিষ্ট বৈজ্ঞ্যানিক রামেদ্র সুন্দর ত্রিবেদীর ডাকে অরন্ধন দিবসই হোক, উভয় ক্ষেত্রেই বঙ্গের নারীসমাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে অংশ নেয়। স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে সকলে সেইদিন রাস্তায় নেমেছিল। যা তৎকালীন সময়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল।
অসহযোগ আন্দোলনে নারীসমাজের ভূমিকা
সর্বভারতীয় স্তরে নারীদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে 1920 সালের অসহযোগ আন্দোলনের হাত ধরে। গান্ধীজী ছিলেন এমন একজন জননেতা যিনি নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত, উচ্চবর্ণ থেকে নিম্নবর্ণ, নারী থেকে পুরুষ সব ধরণের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তাই তার নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে নারীসমাজের এক বিরাট অংশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের প্রয়োজনে গহনা প্রদান করা থেকে শুরু করে, সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন বহু নারী। বহু মহিলা গ্রেপ্তারও হন। সেই সময় বাসন্তী দেবী ‘নারী সত্যাগ্রহ সমিতি’ ও ‘কর্ম মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বহু মহিলা বিদেশি শাড়ি বয়কট করে স্বদেশী শাড়ির ব্যবহার শুরু করেন। তার জন্য তারা গান্ধীজীর অনুপ্রেরণায় চরকা কেটে কাপড় প্রস্তুত করেছিলেন। সরোজিনী নাইডু, কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়, নেহেরু পরিবারের বহু মহিলার ভূমিকা আন্দোলনে অনস্বীকার্য।
আইন অমান্য আন্দোলন নারীসমাজের ভূমিকা
1930 সালে ডাণ্ডি অভিযানে গান্ধীজী প্রথমে মহিলাদের অংশ নিতে অনুমতি না দিলেও পরবর্তীকালে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। অভিযানে খুব কম সংখ্যক মহিলা অংশ নিলেও আন্দোলনে সমাজের বহু স্তরের বহু নারী অংশ নিয়েছিলেন। কৃষক থেকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের বহু নারী এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল (কিছু কিছু তথ্যানুসারে এই সংখ্যা প্রায় 10000)। সরোজিনী নাইডু ও কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা লবণ উৎপাদন কেন্দ্র আক্রমণ করে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এছাড়া অবন্তিকাবাই গোখলে, চম্পুতাই গোপিকা বাই, ধূলিবেন সোলাংকি উল্লেখযোগ্য।
ভারতছাড়ো আন্দোলনে নারীসমাজের ভূমিকা
স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে 1942 এর ভারতছাড়ো আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ শাসনের কফিনে শেষ পেরেক স্বরুপ। আর সেই আন্দোলনে প্রায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অংশ নিয়েছিল, নারীসমাজ ও তার ব্যাতিক্রম ছিলনা। এই আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের (সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে দলিত) মহিলারা অংশ নিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে বঙ্গের মাতঙ্গিনী হাজরার নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
72 বছর বয়সে তাঁর নেতৃত্বে তমলুক থানা আক্রমণ করা হয়েছিল এবং সেই সময়েই পুলিশের গুলিতে এই বীরাঙ্গনা নারী শহিদ হন।
ভারতছাড়ো আন্দোলনের সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসের একজন গুরুত্বপূর্ণ মহিলা নেত্রী ছিলেন অরুণা আসফ আলি। যাকে এই আন্দোলনের নায়িকা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। তাকে অনেকেই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাসের নায়িকা দেবী চৌধুরানীর উত্তরসূরি হিসাবে স্বীকৃত করেছেন। আন্দোলনের সূচনা পর্বে কংগ্রেসি নেতারা গ্রেফতার হলে অরুণা আসফ আলি ও সুচেতা কৃপালনি আত্মগোপন করে আন্দোলনের বিভিন্ন কার্যকলাপকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ও নারীসমাজ
চরমপন্থী ভাবধারারই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ এই সশস্ত্র বিপ্লব। পুরুষের সাথে মহিলারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই সশস্ত্র বিপ্লবে যুক্ত ছিল। সশস্ত্র বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া, বিপ্লবীদের সংকেত বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া, গোপনে অস্ত্র পাচার, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, বিভিন্ন পুরুষ বিপ্লবীদের অস্ত্রের যোগান দেওয়ার মত বিভিন্ন কাজ মূলত নারী নির্ভর ছিল।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
সরলা দেবী ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পটি চালু করেন, এই সংগঠনের আড়ালে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। বহু বিপ্লবী নারী অস্ত্র পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। দুকড়িবালা দেবী পিস্তল কার্তুজ লুকিয়ে রাখার অপরাধে জেল খেটেছিলেন।
[তিনি ছিলেন বিপ্লবী কাজে দণ্ডপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় মহিলা]
লীলা নাগ 1923 সালে ১২ জন সহকর্মীকে নিয়ে নারীর উন্নয়নের উদ্দ্যেশ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দীপালি সংঘ। এই দীপালি সংঘ সেই সময় ছাত্রীদের উন্নয়নে স্কুল, ছাত্রী আবাস, ছাত্রী সংগঠন, নারীকল্যাণমুখী পত্রিকা জয়শ্রীর প্রকাশনাসহ একাধিক কাজ করত। বিপ্লবী লীলা নাগ তাঁর গোটা জীবন তিনি নারীদের উন্নয়নে ব্যায়িত করেছিলেন।
বিশ শতকের ভারতে নারী আন্দোলনের চরিত্র নিয়ে আলোচনা শুনে নাও এই ভিডিও থেকে ↓
বিশ শতকে নারী আন্দোলনের কিছু বীরাঙ্গনা নারী
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিপ্লবী নারীদের মধ্যে যারা চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার অন্যতম। মাস্টারদা সূর্য সেনের অনুপ্রেরণায় এই তেজস্বিনী বিপ্লবীর নেতৃত্বে মাত্র ২১ বছর বয়সে, ৭ জন বিপ্লবীর একটি দল অসম-বেঙ্গল রেলওয়ের ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন।
পুলিশের সাথে গুলি বিনিময়ের সময় প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার আহত হন। কিন্তু সেই অবস্থাতেও তিনি তাঁর দলের বাকিদেরকে তাঁর নিজের পিস্তলটি দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন এবং দৃঢ়চেতা এই বীরাঙ্গনা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগেই পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
কল্পনা দত্ত
সেইসময়ের পিছিয়ে থাকা নারীসমাজে বিপ্লবী কল্পনা দত্তের নাম আজও চিরস্মরণীয়। যে সময়ে বিবাহ, সংসার প্রতিপালনই ছিল যেখানে মহিলাদের একমাত্র কাজ, সেই সময়ে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মিতে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পরিকল্পনায় তাঁর উপর দায়িত্ব পড়েছিল মাটির তলায় রাখা ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটানোর। কিন্তু শেষ অবধি তিনি ধরা পড়ে যাওয়ায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীকালে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয়েছিলেন।
পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → বিশ শতকের ভারতে ছাত্র আন্দোলনের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখিকা পরিচিতি
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত প্রত্যুষা মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন বিষয় চর্চার পাশাপাশি নাচ,গান, নাটকেও প্রত্যুষা সমান উৎসাহী।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_hist_7a