odolbodol
Madhyamik

অদল বদল গল্পের বিষয়সংক্ষেপ ও আলোচনা

বাংলাদশম শ্রেণি – অদল বদল

অদল বদল গল্পের লেখক পরিচিতি

আলোচ্য পাঠ্যাংশের লেখক পান্নালাল প্যাটেল হলেন গুজরাটি সাহিত্যের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব। গুজরাটি সাহিত্যে ছোটগল্পের সূত্রপাতের সময় থেকে গ্রাম্য জীবনকে উপজীব্য করে লেখা বহু রচনা আমরা লক্ষ করে থাকবো যেগুলির রচয়িতা কিন্তু শহুরে শিক্ষিত লেখকরা। গুজরাটি সাহিত্যিক সুন্দরমের লেখা ‘মানে খোলে’ কিংবা উমাশঙ্কর যোশীর ‘শ্রাবণী মেলো’-র মতো গল্পে গ্রাম্য জীবনের কলস্বর শোনা গেলেও গ্রামীণ পরিবেশ ও জীবনের সম্যক পরিচয় আন্তরিকতার সঙ্গে প্রথম প্রকাশিত হতে দেখা যায় পান্নালাল প্যাটেলের গল্পে।

তাঁর গল্পের চরিত্রদের মানসিক অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং ঘাত-প্রতিঘাতের পাশাপাশি ফুটে ওঠে গ্রাম্য জীবনের পরিবেশ। রাজস্থানের দুঙ্গারপুরের মাণ্ডলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯১২ সালের ৭ মে। গুজরাটের ইদারে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত তাঁর পড়াশোনা। সেই বিদ্যালয়ে উমাশংকর যোশী ছিলেন তার সহপাঠী। পড়াশোনা বেশি দূর এগোয়নি তার। পড়াশোনা স্থগিত রেখে দুঙ্গারপুরের একটি মদ্য-উৎপাদক কারখানায় তিনি কাজ করতেন ম্যানেজারের পদে। এরপর কর্মসূত্রে তাঁকে থাকতে হয়েছে আমেদাবাদেও। এই আমেদাবাদে থাকার সময়েই তাঁর প্রথম উপন্যাস লেখা।

উনিশ শতকের গুজরাটের যে পল্লীজীবন তার নিপুণ বর্ণনা ও প্রভাব পান্নালাল প্যাটেলের লেখায় ধরা পড়ে। গুজরাটি সাহিত্যে উপন্যাস ও অন্যান্য রচনার মতো ছোটগল্পেও পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রাচীন গুজরাটি সাহিত্যে লোককথা, নীতিকথা, পৌরাণিক চরিত্র ইত্যাদির প্রয়োগ দেখা যেতো কিন্তু আধুনিক ছোটগল্পে কিংবদন্তী কিংবা পৌরাণিক চরিত্র নির্ভরতা দেখা যায় না।

তাঁর লেখা গুরুত্বপূর্ণ কিছু রচনা হল – ‘মানবীনি ভবাই’, মলেনা জীব (ভিন্ন দেহ এক মন), কোই দেশি কোই পরদেশি, বলামনা (বিদায়), আসমানি নজর, জিন্দেগি কা খেল, রামে সিতানে মারিয়ান বো, কচ-দেবযানি, জিন্দেগি সঞ্জীবনী ইত্যাদি।

১৯৮৫ সালে তিনি তাঁর লেখা ‘মানবীনি ভবাই’ (এই জীবনের রঙ্গমঞ্চে) উপন্যাসের জন্য ভারতের সাহিত্যসাধনার শ্রেষ্ঠ সম্মান ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরষ্কার লাভ করেন। তিনি নাটক এবং ছোটোগল্পও লিখেছেন। বাত্রকনে কাঁধে (বাত্রকের তীরে), সুখ দুখনা সাথী ইত্যাদি গল্পগুচ্ছ তাঁর লেখা অন্যতম রচনা। ‘অলপ ঝলপ’ নামে তাঁর আত্মকথাও প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৫০ সালে পান্নালাল প্যাটেল পান ‘রঞ্জিৎরাম সুবর্ণ চন্দ্রক’ পুরস্কার। গুজরাটি ভাষার এই মহান সাহিত্যিক ১৯৮৯ সালের ৬ এপ্রিল মারা যান।

বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য আলোচ্য গুজরাটি ছোটগল্প হিসেবে ‘অদল বদল’ গল্পটি আমাদের পড়া দরকার।

অদল বদল গল্পের উৎস

পান্নালাল প্যাটেলের লেখা ‘অদল বদল’ গল্পটি গুজরাটি ভাষা থেকে প্রথমে ইংরাজি ভাষায় ‘The Exchange’ নামে অনুবাদ করেন এস. সুন্দর। সেই ইংরাজি অনুবাদটি সংকলিত হয় ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত ‘Stories for Kids’ নামক গল্প সংকলনে। সেখান থেকেই গল্পটি নিয়ে বাংলাতে অনুবাদ করেছেন অর্ঘ্যকুসুম দত্তগুপ্ত। আমাদের পাঠ্যাংশটি আসলে এই বাংলা অনুবাদটি।


অদল বদল গল্পের বিস্তারিত আলোচনা↓


অদল বদল গল্পের বিষয়সংক্ষেপ

এই গল্পের দুই চরিত্র অমৃত আর ইসাব।
হোলির দিন পড়ন্ত বিকেলে নিম গাছের নীচে একদল ছেলে যখন ধুলো ছোঁড়াছুঁড়ি করে খেলছিল, দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু অমৃত আর ইসাব একইরকম পোশাক পরে এসে শান-বাঁধানো ফুটপাথে এসে বসে। উভয়ের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য। দুজনে একই স্কুলে পড়েও, দুজনের বাবাই পেশায় কৃষক। তাদের দুজনের জমির পরিমাণও সমান সমান। এমনকি দুজনের বাবাই প্রয়োজন পড়লে মহাজনের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করেন। রাস্তার মোড়ে মুখোমুখি তাদের বাড়ি।

একটাই মাত্র পার্থক্য হল অমৃতের বাড়িতে আছেন বাবা-মা আর তিন ভাই, অন্যদিকে ইসাবের রয়েছে শুধু বাবা।

রাস্তায় বসে থাকা অমৃত আর ইসাবের একইরকম জামা দেখে একটি ছেলে শক্তি পরীক্ষার জন্য ওদের কুস্তি লড়ার জন্য প্ররোচিত করে। অমৃত ওর নিজের বন্ধুর সঙ্গে কুস্তি লড়তে একেবারেই রাজি ছিল না। নিজেকে পালোয়ান প্রমাণ করার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। এছাড়াও তার ভয় ছিল নতুন জামা ছিঁড়ে গেলে বা ময়লা হলে তার পরিণতি খুব খারাপ হতে পারে।

স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল অমৃত, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে ইসাবের বাবার গোয়ালে লুকিয়ে থেকে রীতিমত বাবা-মায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করে অমৃত একটি নতুন জামা আদায় করেছিল। এই জামাটি ঠিক ইসাবের মতোই। এই সময়ে দুষ্টু ছেলের দল থেকে কালিয়া নামের একটি ছেলে এসে অমৃতকে কুস্তির আহ্বান জানায়। অমৃত রাজি না হলেও তাকে জোর করে মাঠের মাঝখানে ধরে নিয়ে গিয়ে কালিয়া মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বন্ধুর সঙ্গে দূর্ব্যবহার করছে দেখে ইসাব রেগে গিয়ে কালিয়ার সঙ্গে কুস্তি লড়তে এগিয়ে আসে এবং মোক্ষম একটি ল্যাং মেরে তাকে ভূপতিত করে। কালিয়ার বাবার ভয়ে অমৃত আর ইসাব সকলের মতো দ্রুত পালিয়ে যায়। এই সময় অমৃত লক্ষ করে ইসাবের নতুন জামাটি ছিঁড়ে গেছে ধ্বস্তাধ্বস্তির ফলে।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলিগণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান

দুজনেই এই ঘটনার পরিণতির কথা ভেবে ভীত হয়!

কিন্তু অমৃত ছিল প্রত্যুৎপন্নমতি। সে তার বন্ধুকে আশু বিপদ থেকে বাঁচাতে নিজের নতুন জামাটি তাকে পরিয়ে দেয়। ইসাব তাকে মনে করিয়ে দেয় যে ছেঁড়া জামা পরে বাড়ি গেলে অমৃতকেও প্রচণ্ড মার খেতে হবে। তখন অমৃত জানায় যে মাকে সে খুব বিশ্বাস করে, মা ঠিক একটা ব্যবস্থা করে বাবার থেকে তাকে বাঁচিয়ে নেবেন।

এরপর তারা একে অপরের জামা বদলাবদলি করে নেয়।

অমৃত পরে নেয় ইসাবের ছেঁড়া জামা আর ইসাব গায়ে দেয় অমৃতর নতুন কেনা জামাটি। এই জামা অদল-বদলের ঘটনাটি দেখে ফেলে একটি ছেলে এবং সে সবাইকেই এই কথাটি বলে।

সকলে চিৎকার করে ওঠে – ‘অদল বদল! অদল বদল!’

এর মধ্যে অমৃতর মন থেকে দুশ্চিন্তা খানিকটা দূর হয়েছিল। সে নিশ্চিন্ত হয়েছিল এই ভেবে যে তার মা হোলির ধ্বস্তাধ্বস্তিতে জামা-ছেঁড়ার ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে মনে করে জামা রিফু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ছেলেদের চিৎকারে অমৃত আশঙ্কিত হয় এই ভেবে যে এতে তার মা হয়তো আসল সত্য জানতে পেরে যাবে। ফলে ভয় পেয়ে দুই বন্ধুই বাড়ির দিকে ছুটে পালায়।

কিন্তু ইসাবের বাবা হাসান এই ঘটনা সমস্তই প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং ছেলে দুটির কথোপকথন আড়াল থেকে শুনে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান। ‘বাহালি বৌদি’ অর্থাৎ অমৃতের মাকে তিনি ডেকে অমৃতের বন্ধুপ্রীতির এই উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্তের কথা বলেন। অমৃতকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি দিয়ে ইসাবের বাবা জানান যে তার মতো সন্তান পেলে তিনি একুশজনকেও লালন পালন করতে রাজি আছেন। অমৃত আর ইসাবের পারস্পরিক ভালোবাসার, বন্ধুত্ব রক্ষার এই মধুর কাহিনি বাড়িবাড়ি ঘুরে গ্রামপ্রধানের কানে যায়।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

তিনি ছেলেদের স্লোগান অনুসারে অমৃত আর ইসাবের নামকরণ করেন ‘অদল’ আর ‘বদল’।

সবশেষে উচ্ছ্বসিত ছেলের দল অদল-বদল, অদল-বদল রব তুলে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তোলে। এখানেই গল্পের সমাপ্তি ঘটেছে।

অদল বদল গল্পের বিষয়বস্তু

পান্নালাল প্যাটেলের এই গল্প আসলে সরল কাহিনির মোড়কে ভারতের সনাতন সুর ধর্মনিরপেক্ষতার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে। মহামানবের সাগরতীরে এক অখণ্ড ধর্মনিরপেক্ষ সুমহান ভারতবর্ষের একটি খণ্ডচিত্র যেন ফুটে উঠেছে এই গল্পে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র অমৃত হিন্দু এবং তার বন্ধু ইসাব মুসলমান। ভিন্ন ধর্মের হয়েও তারা অভিন্নহৃদয় বন্ধু।

সমস্ত সংকীর্ণ ধর্মীয় বিভাজনের উর্ধ্বে উঠে অমৃত আর ইসাব মানবিক উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। অন্যদিকে ইসাবের বাবা হাসান অমৃতকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি দেওয়ায় এক অনন্য মাত্রা পায় গল্পটি।

সমাপ্ত। আরো পড়ো → অস্ত্রের বিরুদ্ধে গান


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X_Beng_Odol_Bodol