জীবনবিজ্ঞান – দশম শ্রেণি – প্রাণীদের সাড়াপ্রদান ও ভৌত সমন্বয় (স্নায়ুতন্ত্র এবং প্রতিবর্ত ক্রিয়া)|
স্নায়বিক পথ
আমরা বাহ্যিক উদ্দীপনা মানে পরিবেশের কোনো পরিবর্তন হলে তাতে সাড়া দিই, যেমন- চোখে আলো লাগলে চোখ বন্ধ করি বা হাত দিয়ে চোখ আড়াল করি, আবার আভ্যন্তরীণ উদ্দীপনা যেমন- তৃষ্ণা অনুভব করলে জল পান করি। বাইরের জগতের সঙ্গে সমন্বয় সাধন বা দেহের আভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অংশের যোগাযোগ সাধিত হয় স্নায়ুতন্ত্র দ্বারা।
স্নায়ুতন্ত্রের এই কাজ সম্পাদনের জন্য একটি স্নায়বিক পথ অনুসৃত হয়। স্নায়বিক পথটি হল এই প্রকার ↓
উদ্দীপক → গ্রাহক বা রিসেপ্টর (যা দ্বারা উদ্দীপনা গৃহীত হয়) → সংজ্ঞাবহ স্নায়ু → স্নায়ুকেন্দ্র (মস্তিষ্ক বা সুষুম্নাকান্ড) → চেষ্টীয় স্নায়ু- কারক (যার দ্বারা সাড়া প্রদান সাধিত হয়)
উদাহরণ – আমদের যখন কেউ ডাকে, তখন আমরা তার ডাকে সাড়া দিই। এখানে গলার স্বর হল উদ্দীপক, গ্রাহক হল অন্তঃকর্ণে অবস্থিত অরগ্যান অফ কর্টি। গলার স্বর বা শব্দ তরঙ্গাকারে কর্ণপটহে আঘাত করে। মধ্যকর্ণের তিনটি অস্থি দ্বারা এই বিবর্ধিত এই তরঙ্গ পেরিলিম্ফের মাধ্যমে অন্তকর্ণের শ্রুতি গ্রাহকে (অরগ্যান অফ কর্টি) পৌছায়। সেখান থেকে সংজ্ঞাবহ অডিটরি স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের শ্রবণ কেন্দ্রে পৌছায়। আমরা শব্দ শুনতে পাই।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
নিউরোন বা স্নায়ু কোশের গঠন
স্নায়ুতন্ত্রের গঠন জানতে গেলে আগে আমাদের স্নায়ুকোশ বা নিউরোনের গঠন জানতে হবে, এটিই স্নায়ুতন্ত্রের গঠনগত ও কার্যগত একক।
এটি দুটি অংশ দিয়ে তৈরি একটি কোশদেহ, অপরটি প্রবর্ধক বা প্রসেস। নিউরোনের মধ্যে অন্য কোশের মতো কোশঝিল্লি, সাইটোপ্লাজম ও বিভিন্ন কোশ অঙ্গাণু ও নিউক্লিয়াস থাকে।
কোশদেহ
কোশদেহ গোলাকার, ডিম্বাকার বা নক্ষত্রাকার হয়, কোশদেহের চারপাশে একটি লাইপোপ্রোটিন নির্মিত ঝিল্লি থাকে। কোশদেহের সাইটোপ্লাজমে মাইটোকনড্রিয়া, সেন্ট্রোজোম, গলগিবডি থাকে। কোশদেহের সাইটোপ্লাজমকে নিউরোপ্লাজম বলে। স্নায়ুকোশের মাইটোকন্ড্রিয়া শক্তি উৎপাদন করে, যা স্নায়ুকোশের বিভিন্ন কাজে প্রয়োজন হয়, সেন্ট্রোজোম উন্নত না হওয়ার জন্য স্নায়ুকোশ বিভাজনে অক্ষম হয়। নিজলদানা স্নায়ুকোশের ডেনড্রন ও কোশদেহে থাকে, এটি রাইবোনিউক্লিও প্রোটিন দিয়ে তৈরী, যা কোশদেহে প্রোটিন সংশ্লেষে সাহায্য করে ।
কোশদেহের প্রবর্ধক
কোশদেহ থেকে কিছু সূত্রাকার অংশ বেরিয়ে আসে, তাদের প্রবর্ধক বা প্রসেস বলে।
ক) ডেনড্রন
কোশদেহ থেকে নির্গত ক্ষুদ্র শাখাপ্রশাখা যুক্ত প্রবর্ধককে ডেনড্রন বলে আর ডেনড্রনের শাখা প্রশাখাগুলিকে ডেনড্রাইট বলে। ডেনড্রন পূর্ববর্তী নিউরোন থেকে স্নায়ু-আবেগ গ্রহণ করে, ডেনড্রনের মধ্যেও নিউরোপ্লাজম, নিজলদানা সবই থাকে কোশদেহের মতো।
খ) অ্যাক্সন
কোশদেহ থেকে নির্গত দীর্ঘ প্রবর্ধককে অ্যাক্সন বলে, অ্যাক্সন স্নায়ু উদ্দীপনাকে কোশদেহ থেকে পরের নিউরোন বা কারকে নিয়ে যায়। কোশদেহের যে অংশ থেকে অ্যাক্সনের উৎপত্তি হয়, তাকে অ্যাক্সনহিলক বলে। অ্যাক্সনের সাইটোপ্লাজমকে অ্যাক্সোপ্লাজম বলে, এর মধ্যে মাইটোকনড্রিয়া, নিউরোফাইব্রিল থাকলেও নিজলদানা থাকে না।
স্নায়ুতন্ত্রের প্রকারভেদ
স্নায়ুতন্ত্রকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র।
- কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের আবার দুটি ভাগ মস্তিষ্ক এবং সুষুম্নাকান্ড।
- প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রের দুটি ভাগ করোটিক স্নায়ু এবং সুষুম্না স্নায়ু হল।
- স্বংয়ক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের আবার দুটি ভাগ সমবেদী ও পরাসমবেদী স্নায়ুতন্ত্র।
মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকান্ড
আমাদের আবেগ অনুভূতি, স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধি, এই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের মস্তিষ্ক। মানব দেহের উন্নত মস্তিষ্কই আমাদের বাকি প্রাণীদের থেকে আলাদা করে। আমাদের শরীরের বেশীরভাগ শক্তিই মস্তিষ্ক ব্যবহার করে। এই মস্তিষ্ক কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের একটি অংশ। এটি আমাদর শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, আমরা যেমন আমাদের মূল্যবান বস্তুকে বাক্সের মধ্যে যত্নে রাখি, সেরকমই মস্তিষ্কটি করোটির মধ্যে সুরক্ষিত থাকে।
মস্তিষ্কের গঠন
মস্তিষ্কের তিনটে মূল ভাগ- অগ্র মস্তিষ্ক, মধ্য মস্তিষ্ক ও পশ্চাৎ মস্তিষ্ক।
- অগ্র মস্তিষ্কের তিনটি অংশ গুরুমস্তিষ্ক (সেরিব্রাল কর্টেক্স), থ্যালামাস ও হাইপোথ্যালামাস।
- মধ্য মস্তিষ্ক, টেকটাম ও সেরিব্রাল পেডাঙ্কল নিয়ে তৈরি।
- পশ্চাদ মস্তিষ্কের তিনটি ভাগ যোজক বা পনস্, লঘুমস্তিষ্ক (সেরিবেলাম), সুষুম্নাশীর্ষক বা মেডুলা অবলংগাটা।
সুষুম্নাকাণ্ড
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের আরেকটি অংশ- সুষুম্নাকান্ড (স্পাইনাল কর্ড)। সুষুম্নাকান্ড বিভিন্ন সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, এটি বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। এই অংশটি সুষুম্নাশীর্ষকের পশ্চাদভাগ থেকে শুরু করে প্রথম লাম্বার কশেরুকা অবধি বিস্তৃত থাকে। এই অংশকে রক্ষা করার জন্য মস্তিষ্কের মত ত্রিস্তরীয় মেনিনজেসের আবরণ থাকে। এছাড়াও সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড সুষুম্নাকান্ডকে বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে। এই অংশেও মস্তিষ্কের মত ধূসর বস্তু ও শ্বেত বস্তু থাকে। তবে মস্তিষ্ক ও সুষুম্নাকান্ড দুটির ক্ষেত্রে ধূসর বস্তু ও শ্বেত বস্তুর অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন, এখানে ধূসর বস্তু ভেতরে থাকে আর শ্বেত বস্তু বাইরে থাকে।
প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র
প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে 12 জোড়া করোটিক স্নায়ু ও 31 জোড়া সুষুম্নাস্নায়ু থাকে।
করোটিক স্নায়ু
করোটিক স্নায়ু মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই স্নায়ুগুলি মস্তিষ্ককে দেহের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের সঙ্গে যোগ করে এবং সেগুলির কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
সুষুম্না স্নায়ু
31 জোড়া সুষুম্না স্নায়ু বা স্পাইনাল নার্ভ, সুষুম্নাকান্ডের সঙ্গে দেহের বিভিন্ন অঙ্গকে যোগ করে এবং তাদের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে।
স্বয়ংক্রীয় স্নায়ুতন্ত্র
সংজ্ঞা- কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে নির্গত যে, স্নায়ুসমুহের দ্বারা দেহের বিভিন্ন আন্তরযন্ত্রের (যেমন- হৃৎপিণ্ড) ক্রিয়া, বিভিন্ন ঐচ্ছিক পেশীর (যেমন- পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্তের বিচলন) ক্রিয়া, বিভিন্ন গ্রন্থির সক্রিয়তা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয়। তাকে স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র বলে।
স্বয়ংক্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের দুটি ভাগ হল সমবেদী ও পরাসমবেদী স্নায়ুতন্ত্র।
দশম শ্রেণির অন্যান্য বিভাগগুলি পড়ুন –ভৌতবিজ্ঞান | গণিত | জীবনবিজ্ঞান
প্রতিবর্ত ক্রিয়া
কোনো গরম বস্তুতে হাত লাগলে আমরা তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে নিই, চোখে আলো লাগলে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায় এই সমস্ত কার্যগুলিকে বিজ্ঞানের ভাষায় প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদাহরণ শুনে বুঝতেই পারছো যে এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত, তাৎক্ষনিক ক্রিয়া। প্রাণীদেহে নির্দিষ্ট উদ্দীপনার প্রভাবে যে স্বতঃস্ফূর্ত তাৎক্ষনিক ও অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তাকে প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে।
প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদাহরণ
নাকে কোনো ধূলোবালি ঢুকলে হাঁচি হয়, আবার খাবার খাওয়ার সময় বিষম খেলে আমাদের কাশি হয়, এই সব কাজের জন্য আমাদের কোনো অনুশীলন বা অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। আবার হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা, সাইকেল চালানো এগুলো শেখার জন্য অনুশীলন প্রয়োজন হয়। উপরিউক্ত সব উদাহরণগুলোই প্রতিবর্ত ক্রিয়ার। যে সব প্রতিবর্ত ক্রিয়ার জন্য কোন অনুশীলনের দরকার হয় না, যা পূর্বপুরুষ থেকে অর্জিত, তাদের জন্মগত বা শর্তনিরপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে এবং যেগুলোর জন্য বারবার অনুশীলন প্রয়োজন হয়, যেগুলি নির্দিষ্ট শর্তের অধীন, তাকে অর্জিত বা শর্ত সাপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে।
প্রতিবর্ত ক্রিয়ার প্রকারভেদ
প্রতিবর্ত ক্রিয়া প্রধানত দু প্রকার। যথা – সহজাত বা অভ্যাস নিরপেক্ষ প্রতিবর্ত ক্রিয়া ও অর্জিত বা অভ্যাস নির্ভর প্রতিবর্ত ক্রিয়া।
সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়া
যেসব প্রতিবর্ত ক্রিয়া সহজাত বা জন্মগত, স্থায়ী, কোনো শর্তের অধীন নয় এবং অভ্যাস নির্ভর নয়, তাদের সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ- একটি শিশু জন্মের পর মায়ের স্তন্যদুগ্ধ পান করে কিন্তু এই কাজ তাকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। আবার আমরা যদি ভুলবশত কোনো গরম পাত্রে কিংবা উত্তপ্ত জিনিসে হাত দিয়ে ফেলি তখন তৎক্ষণাৎ হাত সেখান থেকে সরিয়ে ফেলি, চোখে তীব্র আলো পড়লে চোখ বন্ধ করে ফেলি। এর বেশিরভাগই সুষুম্নাকাণ্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
অর্জিত প্রতিবর্ত ক্রিয়া
যেসব প্রতিবর্ত ক্রিয়া সহজাত বা জন্মগত নয়, শর্তসাপেক্ষ, যেগুলি বারবার অভ্যাস বা অনুশীলনের দ্বারা প্রাপ্ত হয় তাদের অর্জিত প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে।
উদাহরণ- বিভিন্ন প্রকার বাদ্যযন্ত্র বাজানো, সাইকেল চালানো, আবৃত্তি করা, গান করা কিংবা মা বাবা ও চারপাশের মানুষদের দেখে শিশুর কথা বলতে শেখা বা হাঁটতে শেখা এই সবই হল অর্জিত প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উদাহরণ। এইগুলি অভ্যাসের দ্বারা গড়ে ওঠে। এক্ষেত্রে গুরুমস্তিষ্কের সহায়তার প্রয়োজন হয়।
স্নায়ুতন্ত্র সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → চোখ
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X-Lsc-1D