prani-hormon
Madhyamik

প্রাণী হরমোন

জীবনবিজ্ঞানদশম শ্রেণি – প্রাণীদের সাড়াপ্রদান ও রাসায়নিক সমন্বয় (প্রাণী হরমোন)|

এর আগের দুটি পর্বে আমরা উদ্ভিদের চলন এবং উদ্ভিদ হরমোন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা প্রাণী হরমোন নিয়ে আলোচনা করবো।

আমরা প্রথমেই জেনে নেব প্রাণী হরমোন কাকে বলে?

যে জৈব রাসায়নিক পদার্থ অনাল গ্রন্থি বা অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয়ে রক্ত দ্বারা বাহিত হয়ে লক্ষ্য অঙ্গে (Target organ) পৌঁছে যায়, কোশের রাসায়নিক বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কার্য শেষে ধ্বংস হয়ে যায়, তাকে হরমোন বলে।

এবার আমরা জানবো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি কাকে বলে?

যে সমস্ত গ্রন্থির কোনো নালী থাকে না, তাই গ্রন্থির ক্ষরণ সরাসরি রক্তে মেশে, সেই গ্রন্থিকে অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি বলে। অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষরণ (হরমোন) রক্ত দ্বারা বাহিত হয়ে লক্ষ্য কোশে পৌঁছোয়।

লক্ষ্য কোশ কী?

একটি নির্দিষ্ট হরমোন দেহের একটি নির্দিষ্ট অঙ্গের কোশের ওপর ক্রিয়াশীল হলে, তাকে লক্ষ্য কোশ বলে। যেমন- অগ্র পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত ACTH হরমোন অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির কর্টেক্স অঞ্চলকে উদ্দীপিত করে। এক্ষেত্রে ACTH-এর লক্ষ্য কোশ হল অ্যাড্রেনাল কর্টেক্সের কোশগুলি।


দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল

প্রাণী হরমোনের বৈশিষ্ট্য

  • অনাল গ্রন্থি থেকে সরাসরি রক্তে ক্ষরিত হয়।
  • রক্তের মাধ্যমে বাহিত হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্য কোশে পৌঁছোয়।
  • হরমোন যেখানে সংশ্লেষিত হয় সেই স্থানে সঞ্চিত থাকে না, থাকলেও খুব কম পরিমাণে সঞ্চিত থাকে।
  • সাধারণত হরমোন যে স্থানে ক্ষরিত সেই স্থানে কাজ করে না (ব্যতিক্রম- স্থানীয় হরমোন)।
  • হরমোন কাজের পর ধ্বংস হয়ে যায়।

হরমোনের শ্রেণীবিভাগ

উৎস অনুসারে হরমোনের শ্রেণীবিভাগ

ক) ট্রপিক হরমোন

যখন কোনো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন অন্য কোনো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে, তখন পূর্ববর্তী অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হরমোনটিকে ট্রপিক হরমোন বলে। যেমন – TSH।

খ) স্থানীয় বা লোকাল হরমোন

যে সব হরমোন উৎসস্থলে কাজ করে, তাদের স্থানীয় হরমোন বলে। যেমন – টেস্টোস্টেরন হরমোন শুক্রাশয়ের লেডিগ কোশ থেকে উৎপন্ন হয়ে সেমিনিফেরাস টিউবিউলে শুক্রাণু উৎপাদনে সাহায্য করে।

রাসায়নিক প্রকৃতি অনুসারে প্রাণী হরমোনের শ্রেনীবিভাগ

ক) প্রোটিনধর্মী – যে সমস্ত হরমোনে একাধিক পলিপেপটাইড শৃঙ্খল যুক্ত হয়ে প্রোটিন সৃষ্টির মাধ্যমে হরমোন গঠন করে, তাদের প্রোটিনধর্মী হরমোন বলে। যেমন- ইনসুলিন, প্রোল্যাক্টিন, গ্রোথ হরমোন ইত্যাদি।

খ) পেপটাইডধর্মী – 10 টির কম অ্যামাইনো আসিড সমন্বিত পেপটাইড দ্বারা যে হরমোন তৈরি হয়, তাকে পেপটাইডধর্মী হরমোন বলে। যেমন – অক্সিটোসিন, ভেসোপ্রেসিন।

গ) অ্যামাইনোধর্মী – একটি মাত্র অ্যামাইনো আসিড দ্বারা যে হরমোন তৈরি হয়, তাকে অ্যামাইনোধর্মী হরমোন বলে। যেমন- এপিনেফ্রিন, নরএপিনেফ্রিন।

ঘ) গ্লাইকোপ্রোটিনধর্মী – কার্বোহাইড্রেটযুক্ত প্রোটিন দ্বারা তৈরি হরমোনকে গ্লাইকোপ্রোটিনধর্মী হরমোন বলা হয়। যেমন – FSH, TSH, LH

ঙ) আয়োডিন যুক্ত হরমোন – ট্রাই-আয়ডো থাইরোনিন (T3), টেট্রা-আয়ডো থাইরোনিন (T4)

চ) স্টেরয়েডধর্মী হরমোন – টেস্টোস্টেরন, প্রোজেস্টেরন

ছ) লিপিডধর্মী হরমোন – লিপিড দ্বারা তৈরি হরমোন। যেমন – প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন

অন্তক্ষরাগ্রন্থি সমূহ

হাইপোথ্যালামাস

অগ্র মস্তিষ্কের ডায়েনসেফালন অংশে থ্যালামাসের নীচে ও পিটুইটারি গ্রন্থির ওপরে হাইপোথ্যালামাস অবস্থিত।

হাইপোথ্যালামাসে কিছু নিউরোসিক্রেটারি কোশ থাকে। হাইপোথ্যালামাসের ডরসাল মেডিয়াল, ভেন্ট্রাল মেডিয়াল এবং ইনফ্যান্ডিবুলার নিউক্লিয়াই-এর নিউরোসিক্রেটারি কোশ থেকে বিভিন্ন রিলিজিং ও ইনহিবিটং হরমোন নিঃসৃত হয়, যা অগ্র পিটুইটারি থেকে ক্ষরিত বিভিন্ন ট্রপিক হরমোন ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু হাইপোথ্যালামাস নিঃসৃত হরমোন প্রভু গ্রন্থি বা পিটুইটারি গ্রন্থির হরমোন ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে, তাই হাইপোথ্যালামাসকে ‘সুপ্রিম কমান্ডার’ বা প্রভু গ্রন্থির প্রভু বলে।

হাইপোথ্যালামাস এবং পিটুইটারি গ্রন্থি

পিটুইটারি

এটি একটি মটর দানার মতো আকৃতিবিশিষ্ট গ্রন্থি বিশেষ যা মস্তিষ্কের মূল দেশে (at the base of the brain) হাইপোথ্যালামাসের নীচে স্ফেনয়েড অস্থির সেলা টারসিকা প্রকোষ্ঠে অবস্থিত। পিটুইটারি গ্রন্থি হাইপোথ্যালামাসের সঙ্গে ইনফ্যান্ডিবুলাম নামক যোজক দ্বারা যুক্ত থাকে। পিটুইটারির অপর নাম হাইপোফাইসিস (গ্রীক শব্দ হাইপোফাইসিসের অর্থ তলায় বা Underlying)। যেহেতু পিটুইটারি গ্রন্থি অন্যান্য অন্তঃক্ষরা গ্রন্থির হরমোন ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে তাই পিটুইটারিকে প্রভু গ্রন্থি বা মাস্টার গ্ল্যান্ড-ও (Master Gland) বলে।

অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি

অগ্ন্যাশয় হল মিশ্রগ্রন্থি। কারণ এটি বহিঃক্ষরা ও অন্তঃক্ষরা উভয় প্রকার কোশ দিয়েই তৈরি। এর বহিঃক্ষরা অংশ থেকে পাচক রস ও অন্তঃক্ষরা অংশ (যাকে ‘ল্যাঙ্গারহ্যান্সের দ্বীপপুঞ্জ’ বা ‘আইলেটস অফ ল্যাঙ্গারহ্যান্স’ বলে) থেকে বিভিন্ন হরমোন ক্ষরিত হয়।

অগ্ন্যাশয়ের প্রধান অন্তঃক্ষরা কোশ ও তাদের নিঃসৃত হরমোন –

আলফা কোশ – গ্লুকাগন হরমোন ক্ষরণ করে।

বিটা কোশ – ইনসুলিন হরমোন ক্ষরণ করে ।

ডেল্টা কোশ – সোমাটোস্ট্যাটিন হরমোন ক্ষরণ করে।

অগ্নাশয় এবং থাইরয়েড গ্রন্থি

থাইরয়েড গ্রন্থি

মানুষের গ্রীবা অঞ্চলের সামনের দিকে ল্যারিংক্স বা স্বরযন্ত্রের নীচে শ্বাসনালীর দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ ট্র্যাকিয়াল রিং-এর দু-পাশে দুইটি খণ্ড যুক্ত অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিটি হল থাইরয়েড গ্রন্থি। থাইরয়েডের খণ্ড দুটি পরস্পর ইসথমাস নামক যোজক দ্বারা যুক্ত থাকে।

অনুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা যায় থাইরয়েড গ্রন্থিটি আবরণী কলা বেষ্টিত কোলয়েড পূর্ণ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র থলি দ্বারা গঠিত। এই ক্ষুদ্র থলিগুলিকে থাইরয়েড ফলিকল বলে এখানে থাইরয়েড হরমোন থাকে।

থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে তিনটি হরমোন ক্ষরিত হয়। যথা- থাইরক্সিন বা টেট্রা আয়োডো থাইরোনিন বা T4, ট্রাই আয়োডো থাইরোনিন বা T3 ও থাইরো ক্যালশিটোনিন।

অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি

প্রাণীদেহে প্রতিটি বৃক্কের শীর্ষে ত্রিকোণ আকৃতিবিশিষ্ট একটি করে মোট দুটি অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থাকে। বৃক্কের ওপর সংলগ্ন থাকায়, এই গ্রন্থিকে সুপ্রারেনাল গ্রন্থিও বলে। প্রতিটি অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি দুটি অংশে বিভক্ত, বাইরের অংশটি হল অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স ও ভিতরের অংশটি হল অ্যাড্রেনাল মেডালা।

অ্যাড্রেনাল কর্টেক্স থেকে ক্ষরিত হরমোন– গ্লুকোকর্টিকয়েড, মিনারেলোকর্টিকয়েড ও সেক্স স্টেরয়েড।

অ্যাড্রেনাল মেডালা থেকে ক্ষরিত হরমোন– অ্যাড্রেনালিন বা এপিনেফ্রিন এবং নর-অ্যাড্রেনালিন বা নর-এপিনেফ্রিন।


দশম শ্রেণির অন্যান্য বিভাগগুলি পড়ুন –ভৌতবিজ্ঞান | গণিত | জীবনবিজ্ঞান

জনন গ্রন্থি

মানুষের দু-রকমের জনন গ্রন্থি থাকে যথা – শুক্রাশয় (পুরুষের ক্ষেত্রে) এবং ডিম্বাশয় (স্ত্রীদের ক্ষেত্রে)। এখান থেকে কিছু বিশেষ হরমোন ক্ষরিত হওয়ায়, এগুলি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি রূপে কাজ করে।

ক) শুক্রাশয় – পুরুষের প্রধান জনন অঙ্গ হল দুটি শুক্রাশয় যা জন্মের দু মাস আগে পর্যন্ত শ্রোণী গহ্বরে থাকে এবং পরবর্তীকালে দেহের বাইরে স্ক্রোটাম নামক থলির মধ্যে অবস্থান করে। শুক্রাশয়ের লেডিগের আন্তঃকোশ থেকে ক্ষরিত হয় টেস্টোস্টেরন হরমোন, যা হল পুরুষের মুখ্য যৌন হরমোন।

খ) ডিম্বাশয়- স্ত্রীদেহের প্রধান জননাঙ্গ হল ডিম্বাশয়, যা স্ত্রীদেহের শ্রোণী গহ্বরে জরায়ুর দু-পাশে অবস্থিত। ডিম্বাশয় থেকে দুটি মুখ্য হরমোন নিঃসৃত হয়। যথা-ইস্ট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরন।

প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি

থাইরয়েডের পশ্চাৎ প্রান্তে চারটে প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি থাকে।

এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনগুলি হল –

ক) প্যারাথরমোন হরমোন (PTH)

খ) বৃক্ক থেকে ক্ষরিত হরমোন

প্রাণী হরমোনের অধিক্ষরণ ও অধঃক্ষরণ জনিত রোগ সমূহ

ক) থাইরয়েড হরমোনের স্বল্প ক্ষরণ এবং অধিক ক্ষরণে রোগ

হাইপোথাইরডিজম (Hypothyroidism)

থাইরয়েড হরমোনের স্বল্প ক্ষরণে শিশু বয়সে ক্রোটিনিজম এবং প্রাপ্তবয়সে মিক্সিডিমা রোগ হয়।

ক্রোটিনিজম – শৈশবে থাইরয়েড হরমোনের স্বল্প ক্ষরণে ক্রোটিনিজম রোগ হয়।

মিক্সিডিমা – প্রাপ্ত বয়স্কদের থাইরয়েড গ্রন্থির স্বল্প ক্ষরণে মিক্সিডিমা হয়। মিক্সিডিমার অপর নাম গাল-এর অসুখ (Gull’s Disease) হয়।

হাইপারথাইরোডিসম বা Hyperthyroidism

থাইরক্সিনের অধিক ক্ষরণ জনিত অস্বাভাবিক অবস্থায় গয়টার হয়।

খ) গ্রোথ হরমোনের স্বল্প ক্ষরণ এবং অধিক ক্ষরণে রোগ

বামনত্ব – গ্রোথ হরমোনের কম ক্ষরণে অল্পবয়সীদের উচ্চতা যদি 3 ফুটেরও কম হয় তবে তাকে বামন এবং এই ঘটনাকে বামনত্ব বলা হয়। এর ফলে দেহের বিভিন্ন অঙ্গও সঠিকভাবে বৃদ্ধি পায় না।

অতিকায়ত্ব – গ্রোথ হরমোনের অধিক ক্ষরণের ফলে অল্পবয়সীদের ক্ষেত্রে দেহের উচ্চতা বৃদ্ধি পায় এবং সমান অনুপাতে হাত, পা ইত্যাদির বৃদ্ধি হয়। যদি দেহের উচ্চতা 7 ফুটের বেশি হয়। তবে তাকে জাইগেনিজাম বা অতিকায়ত্ব বলা হয়।

গ) ACTH স্বল্প ক্ষরণ এবং অধিক ক্ষরণে রোগ

কুশিং সিনড্রোম

পিটুইটারি থেকে নির্গত ACTH অ্যাড্রিনালিন কর্টেক্সের উপর কার্য করে। ACTH এর অধিক ক্ষরণে অ্যাড্রিনালিন কর্টেক্সের কার্যকারিতা বেড়ে যায় যার ফলে মুখে, গ্রিবা, পেটে অতিরিক্ত মেদ জমে এবং ব্যাথা হয় কিন্তু হাতে পায়ে কোনো মেদ জমে না। দেহে রোমের আধিক্য দেখতে পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রীদেরও দাঁড়ি গোঁফ দেখতে পাওয়া যায়।

ঘ) ইনসুলিন হরমোনের স্বল্প ক্ষরণ এবং অধিক ক্ষরণে রোগ

হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা ডায়াবেটিস মেলিটাস

অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস্‌ অফ ল্যান্ডারহ্যানসের বিটা কোশ থেকে ইনসুলিন হরমোন কম ক্ষরিত হলে ডায়াবেটিস মেলিটাস রোগ দেখা যায়। এর ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়, ক্লান্তিভাব দেখা যায়।

হাইপোগ্লাইসেমিয়া

ইনসুলিনের অধিক ক্ষরণে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা হ্রাস পায় একে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বলে। এর ফলে রোগীর বার বার খিদে পায়, ঘাম হয়, খিটখিটে স্বভাব হয়ে যায়।

প্রাণী হরমোন সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → স্নায়ুতন্ত্র


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

X-Lsc-1C