বাংলা – দশম শ্রেণি – হারিয়ে যাওয়া কালি কলম(প্রবন্ধ) [Hariye jaoa kali kolom]
লেখক পরিচিতি
বাংলার অন্যতম খ্যাতনামা লেখক ও প্রবন্ধকার নিখিল সরকার তরুণ বয়স থেকেই সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল বাংলার জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের সাথে যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিক হিসাবে ভীষণভাবে সফল নিখিল সরকার তাঁর ছদ্মনাম শ্রীপান্থ নামেই বেশি পরিচিত।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি সামাজিক ইতিহাস নিয়ে তাঁর বহু উল্লেখযোগ্য গবেষণা আছে। তাঁর লিখিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল ‘শ্রীপন্থের কলকাতা’, ‘দেবদাসী’, ‘ঠগি’, ‘যখন ছাপাখানা এল’। ১৯৭৮ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৪ সালে এই জনপ্রিয় প্রাবন্ধিকের মৃত্যু হয়।
উৎস
বর্তমানে আলোচিত প্রবন্ধ ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধটি শ্রীপান্থ রচিত ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম ও মন’ গ্রন্থের অন্তর্গত।
বিষয়সংক্ষেপ
প্রবন্ধকার শ্রীপান্থ ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধের মাধ্যমে, কলমের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। কর্মসুত্রে শ্রীপান্থ একটি সাংবাদিকতার দপ্তরে (আনন্দবাজার পত্রিকা) কাজ করতেন। তিনি দুঃখপ্রকাশ করেছেন যে, তাঁর অফিসে যেখানে লেখালেখি করাই প্রধান কাজ সেখানে আজ কলমের প্রয়োজন খুবই সীমিত হয়ে পড়েছে। কলমের পরিবর্তে আজ তার স্থান নিয়েছে কম্পিউটার। লেখালিখি করতে আজ আর কালি কলমের প্রয়োজন পড়ে না, তার বদলে কি-বোর্ড দিয়েই লেখার কাজ করা হয়।
তাঁর অফিসে সবাই এই কম্পিউটার ব্যবহারে অভ্যস্ত হলেও, শ্রীপান্থ কিন্তু এই ব্যবস্থায় মোটেও খুশী নন। বরং লেখালিখির জন্য তাঁর পছন্দ কালির কলম। প্রবন্ধকার এই প্রবন্ধে কলমের বিবর্তন সম্পর্কে অনেক তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।
তিনি জানান যে তিনি গ্রামের ছেলে, ছোটবেলায় যখন আলাদা করে কলম পাওয়া যেত না, তখন মুখ-চেরা সরু বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কলাপাতার উপরে লেখার অভ্যাস চালু ছিল। কলমের কালিও বাড়িতেই বানানো দস্তুর ছিল, কড়াইয়ের নীচের কালি আলাদা করে নিয়ে তাতে জল দিয়ে, ও কিছু আলাদা উপকরণ মিশিয়ে ফুটিয়ে, ছেঁকে লেখার কালির ব্যবস্থা করা হত।
এতো গেল পঞ্চাশ – ষাট বছর আগেকার কথা। কিন্তু প্রাচীন সভ্যাতা যেমন মিশরীয়, সুমেরিয় বা ফিনিসিয় সভ্যতাতেও কলমের ব্যবহার হত, সেই সময় নল-খাগড়া, সুচালো কাঠ, পাখির পালক এমনকি হাড়কেও কলম হিসাবে ব্যবহার করা হত। কলম যে শুধুমাত্র লেখার কাজে ব্যবহার হত তা কিন্তু নয়, সময়ে সময়ে কলমকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করারও নিদর্শন ইতিহাসে আছে; রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার তাঁর ব্রোঞ্জের কলমের সাহায্যে কাসকাকে হত্যা করেছিলেন।
[আরো পড়ুন – অভিষেক কবিতার সারাংশ]
আজকাল ছাত্রছাত্রীরা কলম হিসাবে ‘খাগের কলম’ আর ব্যবহার করে না, শুধুমাত্র সরস্বতি পুজোর সময়ই দোয়াত-কলম দেখা যায়। আর পালকের কলম তো এখন ব্যবহারই হয় না। অথচ, ইংরেজ আমলে এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যেত। পালকের পোশাকি ইংরাজি নাম ‘কুইল’। তখনকার সাংবাদিকদের ইংরাজির ব্যবহার দেখে লর্ড কার্জন তাদের ‘বাবু কুইল ড্রাইভারস’ বলতেন।
আজকাল পালকের কলম তো দূর অস্ত, খাগের কলমই আর দেখা যায় না তার বদলে বাজার অধিকার করেছে সস্তার ডট পেন। এর ফলে প্রায় প্রত্যেকের কাছেই কলম এসেছে, কিন্তু এতে কলমের প্রকৃত মুল্য কমেছে। প্রবন্ধকারের ভাষায় এটি হল “বিস্ফোরণ, কলম বিস্ফোরণ”।
কলমের দুনিয়ায় বিপ্লব আনে লুইস ওয়াটারম্যান সাহেব আবিষ্কৃত ফাউন্টেন পেন। বাংলায় রবীন্দ্রনাথ এর নাম রেখেছিলেন ঝরনা কলম। এই ফাউন্টেন পেনের অফুরুন্ত প্রকারভেদ; পার্কার, শেফার্ড, সোয়ান এদের মধ্যে সবচেয়ে টেঁকসই ছিল জাপানী ‘পাইলট পেন’। শুধু যে পেনের বাহার ছিল তা নয়, কালিরও নানান প্রকারভেদ ছিল। ছোটবেলায় কালি জলে গুলে বানানোর অভ্যাস থাকলেও, প্রবন্ধকার জানান পরবর্তী সময় তিনি কালি ট্যাবলেট বা বড়ি গুলে কালি বানাতেন।
এছাড়াও নানান কোম্পানির দামি ও কমদামি নানান কালি বিক্রি হত। দোয়াতও হত নানান রকমের, যেমন কাঁচের, কাট – গ্লাসের, পোর্সেলিনের, শ্বেতপাথরের এমনকি সোনার দোয়াতও দেখা যেত। কালি, কলম ও দোয়াত ছাড়াও আরো একটি অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য ছিল ব্লটিং পেপার। অতিরিক্ত কালি মুছে দেবার জন্য ব্লটিং পেপার ব্যবহার করা হত, “সবমিলিয়ে লেখালিখি ছিল একটা ছোটখাট অনুষ্ঠান”।
কিন্তু আজ কম্পিউটারের যুগে কালির কলম বিপন্ন। যে কালি – কলম দিয়ে শেক্সপিয়ার, কালিদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র সবাই অসাধারণ রচনা করে পৃথিবীর মানুষদের তাক্ লাগিয়ে দিয়েছেন, আজ সেই কালি কলম অবলুপ্তির পথে।
কলম অবলুপ্ত হতে চললেও, ওস্তাদ কলমবাজদের স্থান কিন্তু ইতিহাসের পাতায় পাকা। যারা ওস্তাদ কলমবাজ ছিলেন তাদের বলা হত লিপি-কুশলী বা ক্যালিয়গ্রাফিস্ট। এরা মূলত পুথি নকল করতেন। এককালে সম্রাট, রাজা, জমিদাররা লিপি-কুশলীদের গুণী বলে সম্মান করতেন, তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতেন। আজও এদের লেখা লিপি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
কিন্তু এত পরিবর্তনের মধ্যেও প্রবন্ধকার যখন দেখেন যে কেউ এখনো কালির কলম ব্যবহার করছেন তখন তাঁর ভারি ভালো লাগে। তাঁর সমসায়িক অধিকাংশ লেখকই তখন কলমে লিখতেন, একমাত্র অন্নদাশংকর টাইপ রাইটারে লিখতেন। তবে ধীরে ধীরে সবাই টাইপরাইটারের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। কালি কলম ব্যবহারের ব্যপারে প্রবন্ধকার সত্যজিৎ রায়ের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে “সম্ভবত শেষ পর্যন্ত নিবের কলমের মান মর্যাদা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন একমাত্র সত্যজিৎ রায়”।
প্রাবন্ধিক উল্লেখ করেছেন যে তিনি কালি কলমের ভক্ত হতে পারেন কিন্তু ডট্ পেন বা ফাউন্টেন পেনের বিরোধী তিনি নন। কারণ মানসিক ভাবে ডট পেনকে মেনে নিতে না পারলেও, ডটপেনের ব্যবহারের সুবিধার জন্য অনেক আগেই প্রাবন্ধিক আত্মসমর্পণ করেছেন।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
মূলবক্তব্য
প্রবন্ধকার শ্রীপান্থ ‘হারিয়ে যাওয়া কালি কলম’ প্রবন্ধে কালি-কলমের ইতিহাস এবং কালি কলমের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ব্যক্ত করেছেন। একটি কলম একজন লেখকের ভাবনাকে পাতায় ফুটিয়ে তোলে, তাই একজন লেখকের কাছে তাঁর কলম একটি মূল্যবান সম্পদ। শ্রীপান্থ একজন লেখক, ছোটবেলা থেকে শুরু করে তাঁর দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর কলম একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তিনি তাঁর জীবনে বহু ধরণের কলমের সাক্ষী থেকেছেন। তাঁর সময়ে কালি, কলম, দোয়াত ও ব্লটিং পেপার এই সবকিছু মিলিয়ে লেখালিখি ছিল ছিল রীতিমত ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান।
সেই কালির কলম, ফাউন্টেন পেনের ব্যবহার কমেছে, তার বদলে বাজার দখল নিয়েছে সস্তার ডট পেন। এতে কলমের ব্যবহার ব্যপকতা লাভ করেছে, কিন্তু শুধুমাত্র ‘শিক্ষিত মানুষের চিহ্ন – কলম’ তাঁর গরিমা হারিয়েছে। শুধু তাই নয় আজ প্রযুক্তির দাপাদাপিতে লেখালিখির কাজে কলমের স্থান নিয়েছে কম্পিউটার। বহু মানুষ কলমের ব্যবহার ছেড়ে টাইপরাইটার বা কম্পিউটারে অভ্যস্ত হয়েছেন। এতে হয়তো কাজের সুবিধা বহুগুণে বেড়েছে, কিন্তু লেখার মাধুর্য বহুগুণে লুপ্ত হয়েছে।
হারিয়ে যাওয়া কালি কলম প্রবন্ধের সহজ আলোচনা
সময়কে অগ্রাহ্য করার সাধ্য প্রবন্ধকারের নেই। তাই তিনি ব্যাক্ত করেছেন যে তিনি কালি – কলমের ভক্ত হলেও ফাউন্টেন পেন বা বল পেনের সঙ্গে কোন বিবাদ তাঁর নেই। বরং তিনি বল পেনের সুবিধা ও উপযোগিতার কাছে আত্মসমর্পন করেছেন।
দশম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
হারিয়ে হাওয়া কালি কলম প্রবন্ধের নামকরণের সার্থকতা
হারিয়ে যাওয়া কালি কলম; প্রবন্ধের নামের প্রথম দুটি শব্দ আমাদের ইতিহাসকে মনে করায়। একটি সময় পরিবর্তিত হয়ে নতুন সময় আসে, পুরানো কাল হারিয়ে যায় ইতিহাসের পাতায়।
হারিয়ে যাওয়া কালি কলম প্রবন্ধে, প্রাবন্ধিক স্মৃতি তর্পণ করেছেন কালি ও কলমের। পাঠককে তিনি কলমের ইতিহাসের সফর করিয়েছেন, তিনি একাধারে যেমন আমাদের নিয়ে গিয়েছেন প্রাচীন মিশরে, যেখানে সুমেরীয় বা ফিনিসিয়রা নল-খাগড়া কিংবা হাড়কে কলম হিসাবে ব্যবহার করতেন। আবার অন্যদিকে তিনি আমাদের বলেছেন হালফিলের ঝর্না কলমের গল্প।
প্রাবন্ধিক কলম ভালোবাসেন, তাঁর কলমের প্রতি ভালোবাসা প্রবন্ধের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। প্রাবন্ধিক তাঁর ছোটবেলার গল্প শুনিয়েছেন, ‘যেখানে লেখালিখি ছিল এক ছোটখাট অনুষ্ঠান’। সময়ের হাত ধরে কালির কলম ব্যবহার করা ছেড়ে সবাই যখন ডট পেনে মন দিয়েছেন, প্রাবন্ধিক তাতে দুঃখ পেয়েছেন। কিন্তু কালের নিয়ম তিনিও অগ্রাহ্য করতে পারেননি, তাই ‘কালি খেকো কলমের ভক্ত’ প্রাবন্ধিক ডট পেনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।
তিনি এটাও জানেন যে কলমের দিনও একসময় ফুরোবে, তার স্থান নেবে যন্ত্র – কম্পিউটার। কিন্তু তাতে লেখা – লিখির মাধুর্য থাকবে কিনা, তাই নিয়ে সন্দিহান থেকে গেছেন।
সব মিলিয়ে, হারিয়ে যাওয়া কালি কলম প্রবন্ধটি যেন একপ্রকার কালি ও কলমের স্মৃতিচারনা। তাই আমরা বলতে পারি ‘হারিয়ে যাওয়া – কালি কলম’ নামটি সার্থক এবং যুক্তিসঙ্গত।
আরো পড়ো → বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রবন্ধের সহজে আলোচনা
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
X_Ben_Hariye-jaoya-kali