modhyojuge-bangla-10
Class-11

অন্নদামঙ্গল কাব্য । মধ্যযুগে বাংলার সমাজ সাহিত্য

বাংলাএকাদশ শ্রেণি – বাঙালির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি (তৃতীয় অধ্যায়)

এর আগে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা অন্নদামঙ্গল কাব্য সম্পর্কে আলোচনা করবো।

মনসামঙ্গল আর চণ্ডীমঙ্গল পড়া হয়ে যাওয়ার পরে ধীরে ধীরে আমরা অন্যান্য মঙ্গলকাব্যগুলির সম্পর্কেও জানবো। মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল আর অন্নদামঙ্গলই প্রধান। তবে প্রথম দুই কাব্যের তুলনায় অন্নদামঙ্গলের তাৎপর্য অনেকটাই আলাদা। মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য অনেকাংশে না মিললেও এখানে দেবী অন্নদার পূজা প্রচারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। যে কারণে এই কাব্যটি বিখ্যাত, তার প্রধান কারণ কাব্যটি লিখেছেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র – বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল কবি।

অনেকদিন আগে কোনো একটি ক্লাসে বলেছিলাম বন্ধুরা মনে পড়ছে যে ,বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পড়তে গেলে দুই দিকপাল ব্যক্তির মৃত্যু সাল জানাটা খুব জরুরি। একজন শ্রীচৈতন্যদেব আর অপরজন নিঃসন্দেহে ভারতচন্দ্র। উভয়ের মৃত্যুই এক যুগসন্ধি থেকে সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে নতুন এক অধ্যায়ের গণ্ডিতে নিয়ে ফেলেছিল।


একাদশ শ্রেনি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer

শ্রী চৈতন্যদেবের মৃত্যুর ফলে বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের এক নবতর অধ্যায় রচিত হয়, সাহিত্যের ধারার মধ্যে সৃষ্টি হয় মঙ্গলকাব্য ধারা এবং আরও অনেক গৌণ লৌকিক সাহিত্য, চৈতন্য জীবনী সাহিত্য ইত্যাদি। আর অন্যদিকে ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পরে বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগের দৈবী প্রাধান্যের যুগ ছেড়ে ক্রমে ক্রমে আরেকটু পরিণত হয়ে আধুনিক যুগে পদার্পণ করে। সেই ভারতচন্দ্রের লেখা ‘অন্নদামঙ্গল’ নিয়েই আমরা আজকের আলোচনা শুরু করবো।

‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ – এই কথাটা তো তোমরা অনেকের মুখে শুনেছো, অনেক জায়গায়, অনেক লেখায় পড়েছো। বাঙালি মায়ের এ এক চিরকালীন আর্তি যেন।

তোমরা শুনলে অবাক হবে, এই কাল্ট (Cult) হয়ে যাওয়া কথাটা কিন্তু ভারতচন্দ্রই লিখেছিলেন, আর তা ছিল এই অন্নদামঙ্গল কাব্যের মধ্যেই।


শুধু এটাই নয়, আরো অনেক প্রবাদ যা বাঙালি সমাজে বহু বহু যুগ ধরে প্রচলিত, সেই সব অন্নদামঙ্গল কাব্যেরই অন্তর্গত। কাব্যের কাহিনি অনেক বড়, আর তার থেকেও বৃহৎ কাহিনির তাৎপর্য। দেবী অন্নদার পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যেই এই কাব্যের কাহিনির অবতারণা।

তবে তাঁর কাব্যের কাহিনির মধ্যে তিনটি পর্ব বিভাগ রয়েছে –
১) অন্নদামঙ্গল বা অন্নদামাহাত্ম্য
২) বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল
৩) মানসিংহ বা অন্নপূর্ণামঙ্গল

এই তিনটি পর্বের কাহিনি তিন ধরনের। তার মধ্যে প্রথম পর্বের কাহিনিটি প্রামাণ্য কাহিনি হিসেবে ধরা হয়। এখানেই মূলত মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্যসমূহ ফুটে উঠেছে। সতীর দেহত্যাগ, শিব ও পার্বতীর বিবাহ ইত্যাদি পৌরাণিক ঘটনার বর্ণনার পাশাপাশি নরখণ্ডের কাহিনি সূচিত হয়েছে।


একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

স্বর্গের দেবতা নল-কুবের এবং বসুন্ধর মর্ত্যে জন্ম নেন হরিহোড় এবং ভবানন্দ মজুমদার রূপে। প্রথমে দেবী অন্নদা প্রবেশ করেন হরিহোড়ের ঘরে আর তারপর হরিহোড় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এবং অতঃপর দেবীও হরিহোড়ের গৃহত্যাগ করে ভবানন্দ মজুমদারের ঘরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সেই যাত্রাপথে নদী পেরোবার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ঈশ্বরী পাটনীর। এই ঈশ্বরী পাটনীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এক অলৌকিক ক্ষমতাবলে দেবী অন্নদা ঈশ্বরীর খেয়া নৌকার সেঁউতিতে পা দেওয়া মাত্র তা সোনায় পরিণত হয়।

এভাবেই দেবী অন্নদার মাহাত্ম্য প্রচারিত হয় এবং প্রথম খণ্ড সমাপ্ত হয়। দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয় বিদ্যা ও সুন্দরের প্রেম। এই অংশে ভারতচন্দ্র আদিরসের চটুল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন বলে সেকালের সমাজে তা অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট বলে চিহ্নিত হয়। এমনকি আধুনিক যুগের শুরুতেও বটতলা থেকে বহু বিদ্যাসুন্দরের কপি ছেপে বেরিয়েছিল আর এর আদিরসাত্মক কাহিনির টানে সেই সব কপি দেদার বিক্রি হয়েছিল। বিদ্যাসুন্দরের কাহিনি অবলম্বনে বহু নাটকও অভিনীত হয়েছে।

অন্যদিকে কাব্যের তৃতীয় তথা শেষ খণ্ড মানসিংহ-তে কবি ভারতচন্দ্র প্রাতাপাদিত্যের সেনাপতি মানসিংহের ঐতিহাসিক কিছু কাহিনি অবলম্বন করে ঘটনা সাজিয়েছেন।

চণ্ডীমঙ্গলে তোমরা দেখেছিলে বন্ধুরা প্রথমে দেবী চণ্ডী পূজা পান কালকেতু ও ফুল্লরার তথা সমাজের নিম্নবিত্ত সমাজে আর তারপরে দেবীর পূজা করে ধনপতি। এখানেও খানিকটা একইরকমভাবে অন্নদামঙ্গল অংশে সাধারণ হরিহোড় কিংবা ভবানন্দ মজুমদারের ঘরে দেবী অন্নদা পূজা পান এবং তৃতীয় খণ্ডে এসে দেখা যায় মানসিংহের জীবনের দেবীর অলৌকিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এই হল সংক্ষেপে অন্নদামঙ্গলের কাহিনি। এখন দেখে নেওয়া যাক বন্ধুরা, অন্নদামঙ্গলের কবি অর্থাৎ ভারতচন্দ্রের জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

কৃষ্ণনগরের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজসভাকবি ছিলেন ভারতচন্দ্র। তাঁর লেখা বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থটির নাম ‘অন্নদামঙ্গল’।

মোটামুটিভাবে ধরা হয় ১৭৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন ভারতচন্দ্র। বাংলা সাহিত্যে মঙ্গলকাব্যের অপ্রধান ধারার কাব্য হিসেবে বিবেচিত হয় এই অন্নদামঙ্গল। আনুমানিক ১৭১২ সালে হুগলির ভুরশুট পরগণার অধীন পেঁড়ো গ্রামে ভারতচন্দ্রের জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম নরেন্দ্রনারায়ণ রায় এবং মায়ের নাম ভবানী দেবী।

তাঁর বাবার সঙ্গে বর্ধমানের রাজার বিবাদের কারণে বালক ভারতচন্দ্রকে নিয়ে তাঁর বাবা সপরিবারে এসে ওঠেন ভারতচন্দ্রের মামার বাড়িতে। এই সময়েই সংস্কৃত ভাষা শিখে ফেলেন ভারতচন্দ্র। কিছুদিন পরে হুগলির দেবানন্দপুরে রামচন্দ্র মুন্সির কাছ থেকে ফারসি ভাষা শেখেন তিনি। অনেক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে ফরাসডাঙার দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বদান্যতায় কৃষ্ণনগরের রাজসভাকবি হিসেবে নিযুক্ত হন ভারতচন্দ্র। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে মুলাজোড় নামে একটি গ্রাম দানও করেছিলেন বলে জানা যায়। এই

অন্নদামঙ্গল কাব্যটি লেখার জন্য ভারতচন্দ্রকে তিনি ‘রায়গুণাকর’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

১৭৬০ সালে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ভারতচন্দ্র মারা যান। ভারতচন্দ্রকে অষ্টাদশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি মানা হয়। শুধুই অন্নদামঙ্গল কাব্য লেখেননি তিনি, তার পাশাপাশি ‘সত্যপীরের পাঁচালি’, ‘রসমঞ্জরী’, ‘নাগাষ্টক’, ‘চণ্ডীনাটক’ ইত্যাদিও তাঁরই লেখা। অন্নদামঙ্গল কাব্যকে মঙ্গলকাব্যের ধারার মধ্যে গণ্য করা হলেও এই কাব্যের যে কাঠামো বা গঠন কিংবা কাহিনি বিন্যাস তাতে মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যের কাঠামোর সঙ্গে এর খানিক অমিল রয়েছে। ‘গ্রন্থোৎপত্তির কারণ’ অংশে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা এবং কাব্য রচনায় তাঁর আদেশ দানের কথা স্বীকার করেছেন ভারতচন্দ্র।


একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল


আগে কোনো মঙ্গলকাব্যে সরাসরি মানুষের তথা রাজার আদেশের কথা উল্লেখ করা হয়নি। তার বদলে মঙ্গলকাব্যে দৈবী স্বপ্নাদেশের কাহিনিই আমরা পড়েছি বা জেনেছি। কিন্তু বন্ধুরা অদ্ভুত মুন্সিয়ানায় ভারতচন্দ্র তাঁর এই কাব্যে দৈবী মহিমার কথা বললেও তার তুলনায় মানুষের কথাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তাছাড়া শিব, অন্নপূর্ণা ইত্যাদি যে সকল চরিত্র এই কাব্যে রয়েছে তা তাঁদের নিজস্ব পৌরাণিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে পারেনি।

অন্যদিকে ভাষাশৈলীর কথা বলতে হলে তাঁর এই কাব্যে দেখা যায় অনায়াসে ফারসি, হিন্দি কিংবা দেশি শব্দ মিশে গিয়েছে তৎসম শব্দের সঙ্গে। এমনকি তাঁর কাব্যে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, কৌতুকের ছটাও দেখা যায় নানা স্থানে।

তার পাশাপাশি মধ্যযুগের রচনা হয়েও এই কাব্য অনেকাংশে আধুনিকতার বার্তা দেয়, নতুন যুগ-মানসিকতার ইঙ্গিত প্রথম এই কাব্যেই পাওয়া যায়।
পরবর্তীকালে যদি কখনো এই কাব্যটি নিবিড়ভাবে পড়ার ইচ্ছে হয় বা সুযোগ হয়, খেয়াল করে দেখবে এখানে কাহিনির অন্তরে অন্দরে একটা দুর্ভিক্ষগ্রস্ত সমাজের কথা বলা হচ্ছে। দেবী অন্নদা আসলে নিপীড়িত অনাহারী মানুষের স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। যিনি অন্ন দেন, তিনিই তো অন্নদা, তিনিই তো অন্নপূর্ণা।

বাংলার ইতিহাসে বিধ্বংসী ১১৭৬ বঙ্গাব্দের যে দুর্ভিক্ষ সাহিত্যের ইতিহাসকারদের মতে ভারতচন্দ্র তাঁর কাব্যে সেই দুর্ভিক্ষের কথাই বলেছেন।

তাই তো ঈশ্বরী পাটনী দেবীর কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তাঁর সন্তানের কোনো অন্ন-কষ্ট না হয়। গভীরভাবে বিচার করলে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল একটা ক্ষুধা-পীড়িত বাঙালি সমাজের পরিচয় দেয় এবং সেই বুভুক্ষু অবস্থা থেকে মুক্তি দেবেন যিনি তিনিই দেবী অন্নপূর্ণা কিংবা অন্নদা।
পর্ব সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

XI_Beng_modhyojug_Somaj_sahityo_10