পদার্থবিদ্যা – একাদশ শ্রেণি – ভৌত রাশির মাত্রা
ভৌত রাশির মাত্রা কী?
কোনো লব্ধ ভৌত রাশির, মূল রাশিগুলির উপর নির্ভরতা যে রাশিমালা দ্বারা প্রকাশ করা হয়, তাকে ঐ ভৌত রাশির মাত্রা বলা হয়।
অর্থাৎ মাত্রা জানা থাকলেই যে কোনো লব্ধ এককের সাথে মূল এককের সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়।
মাত্রার ধারণা
আমরা কোনো রাশির মাত্রা মূলত [ ] বন্ধনী দ্বারা চিহ্নিত করে থাকি। যেমন, দৈর্ঘ্য, ভর, সময় এই তিনটি এককের মাত্রা [L], [M], [T] এগুলি দ্বারা প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
তবে মনে রাখতে হবে যে, মাত্রা কোন রাশির এককের প্রকৃতি বোঝায়, মান বোঝায় না। মাত্রা ব্যবহার ক্ষেত্রে প্রথমেই জানতে হবে প্রাথমিক কী কী রাশি আমরা মাত্রা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিবেচনা করে থাকি এবং তাদেরকে প্রকাশ করি কীভাবে।
মূল রাশির মাত্রা
আমরা সাতটি মূল রাশির কথা বলব।
নীচের সারণিতে মূল রাশিগুলির মাত্রা দেওয়া হল।
এই সাতটি মূল রাশি ছাড়াও আরও দুটি সংযোজিত রাশি বহু প্রচলিত। যা হল, সমতলিক কোণ এবং ঘনকোণ যা যথাক্রমে radian (rad) ও স্টেরেডিয়ান (Sr) একক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। তবে এই নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।
একাদশ শ্রেনি থেকে → অর্থনীতি | ভূগোল
মাত্রা নির্ণয়ের পদ্ধতি
ব্যাপারটা একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝা যাক। যেমন, ক্ষেত্রফল বলতে দুটি দৈর্ঘ্যের গুণফল বোঝায়। তাই ক্ষেত্রফলের মাত্রা ।
অর্থাৎ বলা যায় ক্ষেত্রফল দৈর্ঘ্যের দ্বিমাত্রিক, তবে এটা
ভর, সময় বা অন্য কোন প্রাথমিক রাশির মাত্রার উপর নির্ভর করে না।
তাই পুরোপুরি প্রকাশ করলে ক্ষেত্রফলের মাত্রা হবে । সেরকমই আয়তনের মাত্রা তবে মাত্রা শূন্য হলে সেটা আর উল্লেখ করবার প্রয়োজন হয় না। তাই ক্ষেত্রফল বা আয়তনের মাত্রা যথাক্রমে বা দিয়ে প্রকাশ করলেই ঐ লব্ধ রাশির মাত্রার সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়।
আবার, কোনো কোনো ভৌতরাশিকে দুটি সমমাত্রিক ভৌতরাশির অনুপাত হিসাবে নির্দেশ করা হয়। যেমন, কোণ = বৃত্তচাপ/ব্যাসার্ধ।
বৃত্তচাপ ও ব্যাসার্ধ দুটির [L]
∴ কোণের মাত্রা = 1
মাত্রাহীন ভৌতরাশি কাকে বলে?
কোনো ভৌত রাশির মাত্রা 1 হলে তাকে মাত্রাহীন ভৌতরাশি বলা হয়। (কারণ বিশুদ্ধ সংখ্যার একক নেই)।
কোণের মতো আরও কয়েকটি মাত্রাহীন রাশি হল— অনুদৈর্ঘ্য বিকৃতি, পয়সন অনুপাত, ঘনকোণ, আপেক্ষিক গুরুত্ব ইত্যাদি।
কোনো ভৌতরাশি মাত্রাহীন হলেও তার কি একক থাকতে পারে?
হ্যাঁ, কোনো ভৌতরাশি মাত্রাহীন হলেও তার একক থাকতে পারে। যেমন- কোণ, ঘনকোণ।
কোণ মাত্রাহীন রাশি হলেও তার মানকে প্রকাশ করতে রেডিয়ান একক ব্যবহার করা হয়। তবে কোণকে যখন ডিগ্রি বা গ্র্যাডিয়েন্টে প্রকাশ করা হয়, তখন তাকে মাত্রাহীন রাশি বলা যায় না।
আপেক্ষিক গুরুত্ব মাত্রাহীন রাশি হলেও এটি এককবিহীন রাশি।
রাশির মাত্রা সূত্র কাকে বলে?
আমরা আগেই জেনেছি, কোনো ভৌতরাশির মাত্রা সূত্র বলতে আমরা এমন রাশিমালা বুঝি যা ঐ প্রাকৃতিক রাশির একক গঠনে কোন্ কোন্ প্রাথমিক একক কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তা প্রকাশ করে।
নীচে কয়েকটি অতি প্রয়োজনীয় রাশির মাত্রা সূত্র জেনে নেব।
মাত্রা সমীকরণ কাকে বলে?
কোনো রাশির মাত্রা নির্ধারণ করে তাকে সমীকরণের আকারে প্রকাশ করলে, তাকে মাত্রা সমীকরণ বলে।
যেমন, বলের মাত্রা
∴ হল বলের মাত্রার সমীকরণ।
একাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি
মাত্রা বিশ্লেষণ
এটি একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, প্রাথমিক রাশিগুলির ওপর কোনো ভৌত রাশির নির্ভরতা অনুসন্ধান করাই হল মাত্রা বিশ্লেষণ।
মাত্রা বিশ্লেষণ ও মাত্রা সমীকরণের কয়েকটা উপযোগিতা
1) কোনো ভৌত রাশির মান এক পদ্ধতির একক থেকে অন্য পদ্ধতির এককে রূপান্তর।
2) সমীকরণ নির্ভুল কিনা পরীক্ষা।
3) বিভিন্ন ভৌতরাশির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়।
এইগুলি সম্পর্কে নীচে আমরা বিস্তারিত জেনে নেব।
1. কোনো ভৌত রাশির মান এক পদ্ধতির একক থেকে অন্য পদ্ধতির এককে রূপান্তর
যদি কোনো ভৌত রাশির মান একটি পদ্ধতিতে (CGS ধরি) জানা থাকে, তবে মাত্রার সমীকরণ ব্যবহার করে আমরা অন্য একটি একক পদ্ধতিতে (ধরি SI তে) রাশিটার মান নির্ণয় করতে পারি।
ধরি, A রাশির মাত্রা সমীকরণ:
ধরি, কোনো পদ্ধতিতে রাশিটির মান অন্য পদ্ধতিতে মান
∴
∴
এই অনুপাতগুলি যথাক্রমে দৈর্ঘ্য ও ভরের রূপান্তর গুণক।
একটি সহজ উদাহরণ, কার্যের মাত্রার ও এককের সম্পর্ক নির্ণয় করব।
কার্যের মাত্রা
1 joule = n erg
∴
∴ 1 joule erg
2. সমীকরণের নির্ভুলতা
কোনো সমীকরণ গঠন করলে তা ত্রুটিহীন কিনা মাত্রা বিশ্লেষণের সাহায্যে আমরা জানতে পারি। আমরা এটা জানি যে, ভিন্ন রাশির মধ্যে তুলনা সম্ভব নয় অর্থাৎ ভরের সাথে সময়ের বা গতির সাথে তাপের তুলনা করা নিছকই অর্থহীন। যদি সমপ্রকৃতির দুই বা ততোধিক রাশি থাকে তবে তাদের যোগ বা বিয়োগ সম্ভব। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে সমমাত্রিক নীতির উল্লেখ প্রয়োজন।
সমমাত্রিক নীতির মূল কথা হল একই ধরনের ভৌত রাশির মধ্যে তুলনা সম্ভব। কোনো লব্ধ সমীকরণের বামদিকের মাত্রাসূত্র যদি ডান দিকের মাত্রাসূত্রের সমান হয়, তবে সমীকরণটি নির্ভুল অন্যথায় এটি ত্রুটিপূর্ণ।
ধরা যাক 5 gm ভরের সাথে 5 cm যোগ করা যায় না। একটা উদাহরণ নিই, যেমন, গতিবিজ্ঞানের সূত্র সমীকরণটি নির্ভুল কী না যাচাই করা যাক।
বামদিকের মাত্রা ∴
∴ মাত্রার দিক থেকে সমীকরণটি নির্ভুল।
3. বিভিন্ন ভৌতরাশির পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয়
সমমাত্রিক নীতির সাহায্যে বিভিন্ন ভৌত রাশির মধ্যে যথাযথ না হলেও একটা প্রাথমিক সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়। কোনো ভৌত রাশি কোন কোন রাশির উপর কীভাবে নির্ভরশীল, তাহলে সেগুলিকে যদি একটি সমীকরণের আকারে প্রকাশ করতে পারি, তারপর সেই সমীকরণের উভয় দিকের মাত্রা সমান করে একটি সম্পর্ক পেতে পারি। এখানে একটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটি প্রকাশ করা হল।
ধরলাম, আমি একটি সরল দোলকের দোলনকালের সম্পর্ক নির্ণয় করতে চাই।
পরীক্ষাগারে এই পরীক্ষা করার সময়, একটা ছোটো ভারী পিন্ডকে একটি নগণ্য ভরের অপ্রসার্য সুতো দিয়ে কোনো আলম্ব বিন্দু থেকে ঝোলালে একটি সরল দোলক তৈরি হয়।
দোলকের দোলনকাল কাকে বলে?
একটি সম্পূর্ণ দোলনের জন্য যে সময় লাগে, তাকে দোলকের দোলনকাল বলে। ধরে নিলাম, দোলনকাল (T), পিন্ডের ভর (m), দোলকের দৈর্ঘ্য (l), অভিকর্ষজ ত্বরণ (g) র উপর নির্ভর করে।
ধরলাম, — (1)
k মাত্রাহীন ধ্রুবক, [k] = 1
[T] = [T]; [l] = [L]
[m] = [M] [g] = [LT-2]
∴ (1) নং সমীকরণটি হল
∴ x = 0
∴ y + z = 0
বা, y = -z
-2z = 1
বা,
∴
∴
এক্ষেত্রে k ধ্রুবকের মান এই সমীকরণ থেকে জানা যায় না, তবে এটা বলা যায় যে দোলকের দোলনকাল ভরের উপর কোনো ভাবেই নির্ভরশীল নয়। কিন্তু, ;
একাদশ শ্রেণি থেকে → Physics | Chemistry | Biology | Computer
মাত্রা বিশ্লেষণ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা
একটু আগেই দেখলাম যে এক পদ্ধতি থেকে অন্য পদ্ধতির এককে রূপান্তর বা সমীকরণের নির্ভুলতা যাচাই করার ক্ষেত্রে মাত্রা বিশ্লেষণ পদ্ধতি অতুলনীয়, কিন্তু আগের উদাহরণেই দেখলাম যে বিভিন্ন রাশির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত সমীকরণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে মাত্রা বিশ্লেষণ পদ্ধতি পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ এই পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এখন সেগুলো নিয়েই আমরা আলোচনা করব।
a) কোনো সম্পর্কের মধ্যে থাকা ধ্রুবকের মান নির্ণয় সম্ভব নয়। আগের উদাহরণে দেখেছি, এখানে k একটি মাত্রাহীন ধ্রুবক কিন্তু এখানে মাত্রা বিশ্লেষণের সাহায্যে k র মান নির্ণয় করা যায় না। k আসলে 2π, অর্থাৎ যেটা সরল দোলকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
b) কোনো সম্পর্কে মাত্রাসহ ধ্রুবক থাকলে সেই সম্পর্কটি নির্ণয় করা যায় না। যেমন, মহাকর্ষের ক্ষেত্রে মহাকর্ষীয় ধ্রুবক G : মাত্রাযুক্ত রাশি। এই কারণে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রে F এর সাথে ভরের বা দূরত্বের সম্পর্ক মাত্রা বিশ্লেষণের সাহায্যে নির্ণয় সম্ভব নয়।
c) কোনো সম্পর্কে মাত্রাহীন রাশি থাকলে, বাকি রাশির সাথে মাত্রাহীন রাশিটি কীভাবে যুক্ত তা জানা সম্ভব নয়।
যেমন, কার্য (w) = বল (F) × সরণ (d)
= Fdws θ
θ : বল ও সরণের মধ্যবর্তী কোণ, এর সাথে বাকি রাশির সম্পর্ক নির্ণয় করা যায় না কারণ এটি মাত্রাহীন রাশি।
d) কোনো রাশির অন্য রাশির ত্রিকোণমিতিয় বা exponential অপেক্ষক হয় তবে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় না। এটি শুধুমাত্র ঘাত (power) অপেক্ষকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
লেখিকা পরিচিতি
প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয় এবং IIT খড়গপুরের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তনী স্বধীতি মাঝি। পদার্থবিদ্যা চর্চার পাশাপাশি ছবি আঁকা, গান গাওয়া এবং বই পড়ায় সমান উৎসাহী স্বধীতি।