ami-dekhi-bishode-alocona
Class-12

আমি দেখি বিশদে আলোচনা

বাংলাদ্বাদশ শ্রেণি – আমি দেখি (বিশদে আলোচনা)


এর আগে আমি দেখি কবিতার সারসংক্ষেপ সম্পর্কে আলোচনা করেছি, এই পর্বে আমরা আমি দেখি কবিতার বিশদে আলোচনা সম্পর্কে আলোচনা করবো।

প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে।

বিশ্ব উষ্ণায়ন সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত। সমস্ত তাবড় তাবড় উন্নয়নশীল দেশে পরিবেশ রক্ষা বিষয়ে নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দূষণ রোধ করা, গাছ না কাটা, বনসৃজন, বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখা ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়ে আপামর বিশ্ববাসীর একটা পরিবেশ সচেতন মানসিকতার প্রকাশ ঘটছে।

কিন্তু এরই বিপরীতে নগর সভ্যতা বেড়ে চলেছে, জনবিস্ফোরণের ভার সামলাতে না পেরে খাল-বিল-পুকুর বুজিয়ে বহুতল বাড়ি গড়ে তোলা হচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে শুধু ভারতেই কয়েক শতাংশ হারে বেড়ে গেছে পেট্রোল-ডিজেল চালিত গাড়ির সংখ্যা। ফলে দূষণও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে পারমাণবিক বর্জ্যের সমস্যা। সব মিলিয়ে সভ্যতা উন্নত হওয়ার পাশাপাশি আমাদের পৃথিবীকে ক্রমশই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ যত বেশি প্রকৃতির বিরোধিতা করে, প্রকৃতিকে নিজের হাতের মুঠোয় আনার চেষ্টা করছে, ততই পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে।

সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর কবিতায় বলেছিলেন, ‘পৃথিবীকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’।

কিন্তু বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা বাসযোগ্য করতে পারেনি। হিরোসিমা-নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলেছিল আমেরিকা, তারপর কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত সেখানকার প্রতিটি শিশু পৃথিবীর আলো দেখতো অজানা কোনো পঙ্গুত্ব নিয়ে।

এ কোন পৃথিবী? এ কোন সকাল! এ যে রাতের থেকেও অন্ধকার!

চাঁদে পৌঁছেছে মানুষ, মঙ্গলের মাটিতে পেয়েছে জলের সন্ধান। সৌরজগত নয়, বরং তারও বাইরে অসীম মহাকাশের অনন্ত রহস্য খুঁজে বের করছে মানুষ। কিন্তু এই সর্বংসহা বসুন্ধরা প্রতিদিন একটু একটু করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েই চলেছে। সবুজের সমারোহ কমছে। দিগন্তের দিকে তাকালে এখন শুধুই কংক্রিটের জঙ্গল। গাছই যে পৃথিবীর আদি প্রাণ। রবীন্দ্রনাথ ‘বনবাণী’ কাব্যের ‘বৃক্ষবন্দনা’য় তাই লিখেছিলেন –

‘অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ,
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-‘পরে; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।’

গাছই যে পৃথিবীর আদি প্রাণ সেকথা রবীন্দ্রনাথও স্বীকার করেছেন একবাক্যে। তাঁর বহু কবিতায় বারবার অরণ্য সংরক্ষণের কথা উঠে আসে। শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক পরিবেশে তাই তিনি গড়ে তোলেন ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয় যেখানে গাছের সুনিবিড় শান্ত ছায়ার মধ্যে চলতো পাঠদান। অরণ্যকে, বৃক্ষকে মানবজীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তোলাটাই তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাতেও আমরা সেই সুর, সেই বাণীই যেন প্রতিধ্বনিত হতে দেখি। গাছ আমাদের জীবনে নানা সময় বিচিত্র ভূমিকা পালন করে। গাছ শান্তি দেয়, গাছ বন্ধু হয়, গাছই আবার যন্ত্রণার প্রতিষেধ নিয়ে আসে দুর্দিনে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর অন্য একটা কবিতায় লিখছেন –

‘আসলে কেউ বড় হয় না, বড়োর মতো দেখায়
গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াও, দেখবে কত ছোটো
সোনার তাল তাংড়ে ধরে পেয়েছো ধূলিমুঠো।’

মানুষের মনের অহংকার যে আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে, গাছ তাকে নির্দেশ দেয়। গাছই সেই অহংকারের সামনে আয়না তুলে ধরে প্রশমিত করে। সে নত হতে শেখায়। ফলভারে আনত বৃক্ষ তো জ্ঞানী পুরুষেরই প্রতীক। জ্ঞান আনে নম্রতা, বিনয়। ‘আমি দেখি’ কবিতার শুরুতেই কবির স্পষ্ট উচ্চারণ আমরা শুনতে পাই। বাগানে গাছ তুলে এনে বসানোর কথা বলেন তিনি। তিনি দেখতে চান চোখ ভরে, সেইসব গাছেদের পাতার ক্লোরোফিলের জাদু বুঝে নিতে চান মানবীয় অনুভবে।

যে আদিম মানুষ একসময় অরণ্যবাসী ছিল, গুহাবাসী ছিল, গাছের কোটরেই যাদের দিন কাটতো, সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে সেই মানুষ ক্রমেই গাছের থেকে দূরে চলে গেছে। কংক্রিটের ঘরে আলোহীন-বায়ুহীন নিস্তেল আঁধারে সুখ আছে, শান্তি নেই। তাই তো মানুষ বাগান করে, বারান্দার নরম রোদে ঝুলিয়ে দেয় বোগেনভেলিয়া কিংবা মাধবীলতা। কবিও যেন সেই সুরে সুর মিলিয়ে বলে ওঠেন –

‘গাছগুলো তুলে আনো, বাগানে বসাও
আমার দরকার শুধু গাছ দেখা।
গাছ দেখে যাওয়া।’

বাগানে সাজানো গাছ দেখে কবি শান্তি পেতে চান। সেই গাছের সবুজ কবির চোখে মায়াকাজল পরায়, সেই গাছ কবিকে সুস্থতার বার্তা দিয়ে যায়। গাছের সেই সবুজ শরীরে দরকার আমাদের। সবুজ তারুণ্যের রঙ, সবুজ শ্যামলতার প্রতীক আবার একইসঙ্গে সবুজ স্বাবলম্বীতারও প্রতীক। রঙের বিজ্ঞানে সবুজকে শীতল রঙ বলা হয়।

চোখের সামনে সবুজ মাঠ, সবুজ জমি থাকলে তা চোখকে শান্তি দেয়। গাছ তার পাতার ক্লোরোফিলের মশলায় রেঁধে নেয় নিজের পুষ্টি, মানুষের শরীরে ক্লোরোফিল নেই। তাই তাকে গাছের উপরই নির্ভর করতে হয়।

আমাদের প্রকৃতির পঞ্চভূত অর্থাৎ বায়ু, মাটি, জল, আগুন ও আকাশ সব যেন মিশে আছে এই গাছে।

গাছের সবুজের মধ্যে দিয়ে মানুষ তাই প্রকৃতিকে পেতে চায়। মানুষের জীবনে আরোগ্য এনে দেয় গাছ। কবি তাই লেখেন –

‘আরোগ্যের জন্য ঐ সবুজের ভীষণ দরকার।’

নাগরিক জীবনের ব্যস্ততা, ক্লান্তি, একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তির জন্য কবি মনে করেন প্রকৃতির কাছে চলে যাওয়া দরকার। আধুনিক নগরজীবনের যে কৃত্রিমতা তা কবিকে ব্যথিত করে, সেটাই তাঁর অসুখের কারণ। জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন’। সেই গভীর অসুখ আসলে বৃক্ষছেদনে, সবুজের ধ্বংসে। তাই তাঁর চেতনাকে সজীব করে তুলতে প্রয়োজন হয় গাছেদের। প্রকৃতির বুকে নিজেকে মেলে ধরতে না পেরে কবির মনে হয়েছে বাগানে গাছ তুলে এনে বসানো দরকার।শহরের কৃত্রিম পরিবেশে শক্তি হাঁপিয়ে উঠেছেন। তাই এর থেকে মুক্ত হতে জঙ্গলে যেতে চেয়েছেন তিনি।

কবিতায় তিনি সোচ্চারেই বলেন, ‘বহুদিন জঙ্গলে কাটেনি দিন’।

অরণ্যের দিনরাত্রির মায়া কবি ভুলতে পারেন না। অরণ্য কবির কাছে এক নিভৃত পর্যটন। কিন্তু সেই জঙ্গলের সঙ্গেই কবির দীর্ঘ বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। বহুদিন শহরে আছেন তিনি, অরণ্যের গন্ধ আর তাঁর নাকে সাড়া জাগায় না। শহরে সবুজের অনটন ঘটে, তাই কবির তীব্র আক্ষেপ আমরা শুনতে পাই এই কবিতায়।

তারপরই আসে সেই অমোঘ পংক্তিটি –
‘শহরের অসুখ হাঁ কবে কেবল সবুজ খায়’

মুহূর্তের মধ্যে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক সর্বগ্রাসী নাগরিক মরুভূমির জিহ্বা যেন গিলে খেয়ে নিচ্ছে সমস্ত সবুজ। এই অসুখ আসলে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের অসুখ, এই অসুখ প্রকৃতিকে হাতের মুঠোয় আনার প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার অসুখ। সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে ততই মানুষ দূরে সরে গেছে প্রকৃতির থেকে, গাছেদের থেকে। যে গাছের কোটরে একদিন আদিম মানুষ বেঁধেছিল স্বপ্নের ঘর, সেই মানুষ আজ গাছ কেটে বানাচ্ছে বিশাল সড়ক।


দ্বাদশ শ্রেনি থেকে → বাংলা | ইংরাজি

গাছ কাটা হচ্ছে বহুতল বাড়ি নির্মাণের জন্য, গাছ কাটা হচ্ছে মন্দির, মসজিদ বানানোর জন্য। সবুজ ধ্বংসের এই অসুখ সভ্যতার শিকড়ও উপড়ে নেবে একদিন। প্রকৃতির প্রতিশোধ দেখা দেবে এই পৃথিবীতে একদিন। গাছের ফুল ফোটার মতো সৌন্দর্য ভুলে যাবে মানুষ। সেই ফুল ফোটার মধ্যে যে জীবনের ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে, সেই চিরন্তন এক চিত্রকল্প এই কবিতায় ব্যবহার করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। জীবনানন্দ যে গভীরতর অসুখের কথা বলেন, তার মূলে আছে মানুষের স্বার্থপরতা আর দ্বেষ। কবিও এর সঙ্গে সহমত। তিনি জানেন মানুষ পৃথিবীতে উন্নত প্রাণী হয়েও কেবলমাত্র দাম্ভিক পদচারণার তাগিদে এই পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করা তাগিদেই অরণ্য ধ্বংস করে চলেছে।

একটি মানুষের থেকে অন্য মানুষের মনের দূরত্ব বেড়ে গেছে অনেক। গাছ যে প্রশান্তি দেয়, গাছ যে ভরসা যোগায়, সেই গাছই যে সভ্যতার ধারক-বাহক তা আজ ভুলতে বসেছে মানুষ। শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্য আরেকটি কবিতায় লিখেছিলেন –

‘একটি চিঠি হতে অন্য চিঠির দূরত্ব বেড়েছে কেবল / একটি গাছ হতে অন্য গাছের দূরত্ব বাড়তে দেখিনি আমি’

সবুজ ধ্বংস আসলে মানুষের থেকে মানুষের ব্যবধানই বাড়িয়ে তোলে। ‘আমি দেখি’ কবিতাটি যেন সেই ইঙ্গিত তুলে ধরে আমাদের সামনে। এই কবিতাটি হয়ে ওঠে নাগরিক যন্ত্রণার বিরুদ্ধে এক নীরব সবুজ প্রতিবাদ।

সমাপ্ত।


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


লেখক পরিচিতি

প্রেসিডেন্সী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র সিমন রায়। সাহিত্যচর্চা ও লেখা-লিখির পাশাপাশি নাট্যচর্চাতেও সমান উৎসাহী সিমন।

এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –

XII_Beng_Ami_Dekhi_2