podarther-vout-dhormo
WB-Class-8

পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম | পদার্থের প্রকৃতি

শ্রেণি – অষ্টম | বিষয়: বিজ্ঞান । অধ্যায়: পদার্থের প্রকৃতি (প্রথম পর্ব)

প্রত্যেক পদার্থের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা গুণ থাকে যা সেই পদার্থকে অন্যান্য পদার্থ থেকে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করে।

পদার্থের যেসব গুণ বা বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে পদার্থকে আলাদা করে চেনা সম্ভব হয় সেইসব বৈশিষ্ট্য বা গুণকে পদার্থের ধর্ম বলা হয়।

ধরো তোমার ছোট্টবেলার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুটি যমজ, একেবারে একই রকমের দেখতে তাদের দুজনকে। আচ্ছা বলতো তোমার কি তাকে চিনতে অসুবিধা হবে?

নিশ্চয়ই হবে।

কিন্তু তুমি দুজনের সাথে থাকলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারো কোনটি তোমার বন্ধু! হুম, এর পিছনে কিন্তু কিছু গল্প আছে। এখনি বলবনা। যত এগোব আমরা আমাদের আলোচনায় ততই এই যমজ বন্ধুর গল্পটির রহস্য একটু একটু করে প্রকাশ করবো।

পদার্থের ধর্ম

পদার্থের এই ধর্মগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—
ভৌত ধর্ম
রাসায়নিক ধর্ম।

ভৌত ধর্মের সংজ্ঞা

কোন পদার্থের যেসব ধর্মগুলি পদার্থের গাঠনিক কাঠামো পরিবর্তন না করেই পর্যবেক্ষণ ও পরিমাণ করা সম্ভব, সেই সব ধর্মগুলিকে ওই পদার্থের ভৌত ধর্ম বলে।

কোন পদার্থের বর্ণ, চাপ, দৈর্ঘ্য, গন্ধ, চৌম্বক ধর্ম, গলনাঙ্ক, দ্রাব্যতা, স্ফুটনাঙ্ক প্রভৃতি পদার্থের ভৌত ধর্মের অন্তর্গত।

আবার ফিরে আসি আমাদের যমজ বন্ধু চেনার উপায় গল্পে।

হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, বলতো তোমার সেই বন্ধু ও তার যমজ ভাইটির ছবি রাখলে কেন চিনতে অসুবিধা হয়?

হুম ঠিক বলেছ তাদের হুবুহু এক দেখতে তাই। আসলে তাদের বাইরের রূপটিতে (ভৌত ধর্ম) কোনো ফারাক যে নেই। অর্থাৎ এখান থেকে বলতে পারি তাদের দুজনের ভৌত ধর্ম (যা শরীরের গঠন এই উদাহরণে) অনেকটাই সদৃশ।

রাসায়নিক ধর্মের সংজ্ঞা

রাসায়নিক ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য বলতে কোন পদার্থের সেই সব ধর্ম বা বৈশিষ্ট্যগুলিকে বোঝায় যেগুলি পদার্থ কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশ নিলে বা পদার্থের কোন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটলে শুধুমাত্র তখনই পরিমাপ বা পর্যবেক্ষণ করা যায়।

কোন পদার্থের অন্য পদার্থের সাথে বিক্রিয়াশীলতা, দাহ্যতা, তেজস্ক্রিয়তা, অম্লত্ব, ক্ষারত্ব প্রভৃতি পদার্থের রাসায়নিক ধর্মের উদাহরণ।

আবার যদি আমরা আমাদের উদাহরণে ফিরে যাই তাহলে এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো, তোমার বন্ধুটির সাথে তার যমজ ভাইয়ের কিসে ফারাক আছে! হ্যাঁ ঠিক ধরেছ তাদের “রাসায়নিক ধর্ম” আলাদা। তাই তুমি তাদের সাথে বসে থাকলে খুব সহজেই তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে চিনে নিতে পারো। এক্ষেত্রে তাদের গলার স্বর, তাদের ব্যবহার, তাদের খ্যাদাভাস, তাদের মানসিকতা সবই যে আলাদা।

[উদাহরণ হিসাবে তোমাদের বোঝার সুবিধার্থে এই গল্পের উপস্থাপন। বাস্তবে সব যমজ ভাই বোনেদেরই এরম অমিল বা মিল থাকবে তা নাও হতে পারে। তাই সহজ ব্যাখার ব্যবহার আবার পরিক্ষায় করে এসোনা। তাহলে কিন্তু তোমার ছেলেবেলার যমজ বন্ধু নয়, তুমি পরীক্ষার খাতায় বেশ বড় সড় ‘রাজভোগ’ পাবে।]

ভৌত এবং রাসায়নিক ধর্মের প্রভাবে বিভিন্ন পদার্থের নানা রকম পরিবর্তন অনেক সময় ঘটে। আমাদের চারপাশে এরকম অনেক পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই।

ভৌত পরিবর্তনের সংজ্ঞা

যে পরিবর্তনের ফলে পদার্থের বাহ্যিক অবস্থার শুধুমাত্র পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু পদার্থের আণবিক গঠনের কোন রকম পরিবর্তন হয় না এমন পরিবর্তনকে পদার্থের ভৌত পরিবর্তন বলা হয়। বরফের গলন, জলের স্ফুটন প্রভৃতি পদার্থের ভৌত পরিবর্তনের উদাহরণ। পদার্থের ভৌত ধর্মের প্রভাবে এই ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে।

ভৌত পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্য

কোন ভৌত পরিবর্তনে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। সেগুলি হল-
1) ভৌত পরিবর্তনে কোন নতুন পদার্থ উৎপন্ন হয় না।
2) পদার্থের অণুর গঠনগত কোন পরিবর্তন হয় না, শুধুমাত্র ভৌত অবস্থার পরিবর্তন হয়।
3) ভৌত পরিবর্তন অস্থায়ী। পরিবর্তনের কারণ সরিয়ে নিয়ে গেলে পদার্থটি আবার তার আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
4) ভৌত পরিবর্তন ঘটার ফলে তাপের উদ্ভব বা শোষণ ঘটতেও পারে, আবার নাও ঘটতে পারে।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগ – বাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান | ভূগোল

তাপের প্রভাবে পদার্থের ভৌত অবস্থার পরিবর্তন

তাপের প্রভাবে পদার্থের ভৌত অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। তাপ প্রয়োগ করলে কোন কঠিন পদার্থ তরলে পরিণত হয়। আবার কোন তরল পদার্থ তাপ প্রয়োগে গ্যাসীয় অবস্থায় পরিণত হয়। উল্টোদিকে কোন গ্যাসীয় পদার্থ থেকে তাপ সরিয়ে নিলে অর্থাৎ ঠাণ্ডা করলে গ্যাসীয় পদার্থ তরলে পরিণত হয়। এই পরিবর্তনে রাসায়নিক ধর্মের কোন পরিবর্তন হয় না, শুধুমাত্র ভৌত অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।

এসো একটা উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝেনি।

আমাদের আশেপাশে এরকম কিন্তু প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। আমরা তাদের মধ্যে থেকে একটা ঘটনার কথা এখানে বলবো।

ফ্রিজ খুলে বরফ বের করে একটা বাটিতে প্রথমে রাখো।

এবার একটা বাতি জ্বালিয়ে (নিজেকে আর তোমার চারপাশকে সাবধানে রেখেই কিন্তু ‘গবেষণা’ করো) ঐ বাটিটিকে গরম করো।

তাপ প্রয়োগ করলে একসময় দেখতে পাবে যে বরফ গলে জলে পরিণত হতে শুরু করছে। যতক্ষণ না সমস্ত বরফ গলে যাবে ততক্ষণ পাত্রের উষ্ণতা অপরিবর্তিত থাকবে। সমস্ত বরফ গলে জল হবার পরে তাপের প্রভাবে ওই জলের উষ্ণতা বাড়তে থাকবে এবং একসময় দেখা যাবে যে পাত্রের জল ফুটতে শুরু করেছে এবং বাষ্প উৎপন্ন হচ্ছে।

এই বরফ, জল এবং জলীয় বাষ্প হল একই পদার্থের তিনটি ভিন্ন রূপ। তাপ প্রয়োগের ফলে এদের ভৌত অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে মাত্র, কিন্তু কোন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটেনি।

বলতো গলনাঙ্ক কাকে বলে?

নির্দিষ্ট চাপে কোন বিশুদ্ধ কঠিন পদার্থ যে নির্দিষ্ট উষ্ণতায় তরলে পরিণত হতে শুরু করে সেই উষ্ণতাকে ওই পদার্থের গলনাঙ্ক বলা হয়। সমস্ত পদার্থ কঠিন থেকে তরল অবস্থায় পরিবর্তিত না হয় পদার্থের উষ্ণতা অপরিবর্তিত থাকে।

স্ফুটনাংক

আচ্ছা তাহলে স্ফুটনাঙ্ক কাকে বলে?

নির্দিষ্ট চাপে কোন বিশুদ্ধ তরল পদার্থ যে নির্দিষ্ট উষ্ণতায় বাষ্পে পরিণত হতে শুরু করে তাকে ওই তরলের স্ফুটনাঙ্ক বলা হয়।

আবার, নির্দিষ্ট চাপে কোন বিশুদ্ধ তরল যে উষ্ণতায় জমে কঠিনে পরিণত হতে শুরু করে তাকে ওই তরলের হিমাঙ্ক বলা হয়।


আরো পড়ুন → An April Day কবিতার আলোচনা | পল্লীসমাজ কবিতার আলোচনা

আচ্ছা, তাহলে গলনাঙ্ক আর স্ফুটনাঙ্ক কি কি বিষয়ের উপর নির্ভরশীল?

কোন বিশুদ্ধ পদার্থের নির্দিষ্ট গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক থাকে। এই গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক পদার্থের উপরস্থ চাপের উপর নির্ভরশীল। কোন তরলের উপরিস্থ চাপ বৃদ্ধি করা হলে তার স্ফুটনাঙ্ক বৃদ্ধি পায়। আবার চাপ হ্রাস পেলে স্ফুটনাঙ্ক হ্রাস পায়। উঁচু পাহাড়ের মাথায় বায়ুর চাপ সমতল অপেক্ষা কম হয়, এই কারণে উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে জলের স্ফুটনাঙ্ক কম হয় অর্থাৎ জল অপেক্ষাকৃত কম উষ্ণতায় বাষ্পীভূত হয়।

প্রমাণ বায়ুমণ্ডলীয় চাপে বিশুদ্ধ জলের হিমাঙ্ক 0℃ ও স্ফুটনাঙ্ক 100℃।

পদার্থের ভৌত অবস্থার পরিবর্তনের প্রাকৃতিক উদাহরণ

তাপের প্রভাবে পদার্থের এই ভৌত অবস্থা পরিবর্তনের ঘটনা প্রাকৃতিক ভাবেও দেখতে পাওয়া যায়। সূর্যের তাপে বিভিন্ন উঁচু পর্বতে অবস্থিত হিমবাহ গলে তার জলধারা নদী সৃষ্টি করে। আবার বিভিন্ন নদী, পুকুর, সমুদ্রের জল সূর্যের তাপে বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ সৃষ্টি করে (একেই বলে জলচক্র) । এগুলি প্রাকৃতিক ভৌত পরিবর্তনের উদাহরণ।

জলচক্র

তাপ প্রয়োগে অবস্থার পরিবর্তনের ব্যাতিক্রম

আমরা জানি যে কঠিন পদার্থ তাপ প্রয়োগের ফলে তরলে পরিণত হয়, আর তরলকে তাপ প্রয়োগ করে বাষ্প বা গ্যাসে পরিণত করা হয়। অর্থাৎ পদার্থের তিনটি অবস্থা— কঠিন, তরল ও গ্যাসীয়

কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা এর ব্যতিক্রম দেখতে পাই।

কর্পূর, ন্যাপথলিন বা আয়োডিনকে গরম করলে সরাসরি গ্যাসীয় অবস্থায় পরিবর্তিত হয়, তরল হয় না। অর্থাৎ এই পদার্থগুলির কোন তরল অবস্থা নেই।

শুধুমাত্র কঠিন ও গ্যাসীয় অবস্থা আছে।

তাপগ্রাহী ও তাপমোচী বিক্রিয়া

ভৌত পরিবর্তনের ফলে তাপের উদ্ভব বা শোষণ হতে পারে। জলে অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড দ্রবীভূত করলে দেখা যায় যে জলের তাপমাত্রা হ্রাস পেয়েছে। এটি একটি endothermic বা তাপগ্রাহী বিক্রিয়া।

আবার জলে সালফিউরিক অ্যাসিড যোগ করলে আমরা দেখতে পাই এই মিশ্রণের তাপমাত্রা খুব বেড়ে যায়, কারণ এটি একটি exothermic বা তাপমোচী বিক্রিয়া।

তাই লঘু সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরীর সময় কখনও গাঢ় সালফিউরিক অ্যাসিডে জল যোগ করা উচিত নয়। কারণ অ্যাসিডে জল যোগ করলে উৎপন্ন তাপের প্রভাবে ওই জল বাষ্পীভূত হয় এবং বিস্ফোরণ ঘটার সম্ভবনা থাকে।
জলের মধ্যে ধীরে ধীরে অল্প পরিমাণ সালফিউরিক অ্যাসিড যোগ করতে হয়।

ধর্মের সাহায্যে বস্তুর শনাক্তকরণ

বিভিন্ন পদার্থের গন্ধ, বর্ণ, চৌম্বক ধর্ম, দ্রাব্যতা প্রভৃতি ভৌত ধর্মগুলি আমাদের শনাক্তকরণে সাহায্য করে।

যেমন- লোহা, নিকেল, কোবাল্ট প্রভৃতি ধাতুগুলি চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয়। জলে চিনি বা নুন দ্রবীভূত হয়, কিন্তু চকের গুঁড়ো বা সালফার জলে দ্রাব্য নয়। কার্বন ডাই সালফাইড কিন্তু সালফারকে দ্রবীভূত করতে পারে, যদিও তা চিনি বা নুনকে দ্রবীভূত করতে পারেনা।

হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস পচা ডিমের গন্ধযুক্ত, অ্যামোনিয়া গ্যাসের গন্ধ ঝাঁঝালো। এই ভাবে গন্ধ দ্বারাও বিভিন্ন পদার্থ আমরা শনাক্ত করতে পারি।

পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → রাসায়নিক পরিবর্তনের সাহায্যে পদার্থের শনাক্তকরণ

লেখিকা পরিচিতিঃ

বিজ্ঞান স্নাতক এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষিতা নন্দিতা বসুর পেশা শিক্ষকতা।তিনি বই পড়তে বড় ভালোবাসেন। কাজের ফাঁকে, অবসরে, বাসে ট্রামে তো বটেই, শোনা যায় তিনি নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বই পড়তে পারেন।



এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

VIII_Science_5a