পল্লীসমাজ
WB-Class-8

পল্লীসমাজ

শ্রেণিঃ অষ্টম | বিষয়: বাংলা। পল্লীসমাজ (গদ্য)

লেখক পরিচিতি

এখনও পর্যন্ত বাঙালি সাহিত্যিকদের মধ্যে সর্বাধিক পঠিত এবং সবথেকে বেশি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুরে শরৎচন্দ্রের জন্ম হয়। তাঁর পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। দেবানন্দপুরে আসলে শরৎচন্দ্রের মামারবাড়ি ছিল। ছোটোবেলায় তাঁর ডাকনাম ছিল ন্যাড়া। দারিদ্র্যের কারণে বিদ্যালয়ে পড়াশোনায় ছেদ পড়েছিল তাঁর। নানা কাজের জন্য ভাগ্যান্বেষণে তাঁকে বহু জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। স্কুলে পড়াকালীনই তিনি প্রথম গল্প লেখা শুরু করেন।

বর্মায় রেলস্টেশনের অস্থায়ী চাকরিতে থাকাকালীন তিনি ‘মন্দির’ নামে একটি সাময়িক পত্রিকায় গল্প লিখে কুন্তলীন পুরস্কার পান। তাঁর প্রকৃত সাহিত্যসাধনার বিকাশ ঘটে ভাগলপুরে। তাঁর ‘বড়দিদি’ গল্পটি ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী সুবর্ণপদক-এ সম্মানিত করে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বহু ছোটগল্প এবং উপন্যাস লিখেছেন তিনি যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – রামের সুমতি, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ ইত্যাদি সব অসামান্য গল্প। অন্যদিকে পরিণীতা, পল্লীসমাজ, বৈকুণ্ঠের উইল, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, দেবদাস, গৃহদাহ, পথের দাবীর মতো কালজয়ী জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রষ্টা শরৎচন্দ্র।

নিজের উপন্যাসের নাট্যরূপও দিয়েছিলেন তিনি যার মধ্যে ষোড়শী, বিজয়া, রমা অত্যন্ত উৎকর্ষময় এবং বহু অভিনীত। অনিলা দেবী ছদ্মনামে তিনি সাহিত্যরচনা করতেন। বাংলা ভাষায় লেখা তাঁর উপন্যাস-গল্পগুলি বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস-গল্পকে অবলম্বন করে। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি যকৃতের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। আজও বাংলার সাহিত্য-পাঠকদের কাছে শরৎচন্দ্র সমানভাবে জনপ্রিয়।

প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

‘পল্লী’ অধুনালুপ্ত এই শব্দটির সাথে আমরা অনেকেই অপরিচিত। ‘পল্লী’ কথার আক্ষরিক অর্থ বসতি। আগে যখন শহর বা মফস্বলের বাড়-বাড়ন্ত ছিল না, সেই সময় বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিল গ্রাম–গঞ্জ–গাঁ। এই ছোট জনবসতিগুলির দিনচর্চা, রীতিনীতি ছিল আজকের থেকে অনেকটাই আলাদা। শরৎচন্দ্র পল্লীসমাজ উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৯১৬ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ১০৫ বছর আগে। তাই পল্লীসমাজ পাঠ্যাংশটি সঠিকভাবে বোঝার জন্য, সেই সময়কার কিছু কথা আমাদের জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

বাংলার পল্লীসমাজ

বাংলার অর্থনীতি হল কৃষিনির্ভর, অর্থাৎ বাংলার মানুষ চাষ করার মাধ্যমেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। আগেকার সময়ে অধিকাংশ চাষের জমি থাকতো কিছু ভূস্বামীদের বা জমিদারদের হাতে, এরা ছিলেন সমাজের সম্ভ্রান্ত মানুষ। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তাদের জমিতে ভাগ চাষ করতেন, এবং সেই চাষ থেকে তাদের যে উপার্জন হত তা দিয়েই তারা সারা বছর কাটাতেন।

ভাগচাষের সিংহভাগ আয়, অন্যান্য চাষ, জমি রাজস্ব আদায়, চড়া সুদে ধার দেওয়ার কারণে তারা ছিলেন যথেষ্ট বিত্তশালী। যেহেতু সেই সময়কার বিচার ব্যবস্থা আজকের মত এতটা শক্তিশালী ছিল না, তাই বহুক্ষেত্রে গ্রামের জমিদারেরা তাদের নিজ নিজ বাহিনী রাখতেন; এদের পেয়াদা বলা হত। বলা যায় একটি গ্রামের বা জনপদের সমাজব্যাবস্থা এই সব সম্ভ্রান্ত মানুষের দ্বারাই পরিচালিত হত। মজার কথা হল, এই সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলির মধ্যে কার মর্যাদা বেশি তা জাহির করার লক্ষ্যে বিবাদ লেগেই থাকতো।


আরো পড়ুন → দাঁড়াও – শক্তি চট্টোপাধ্যায় | Clouds | বিপ্রতীপ কোণের ধারণা

পল্লীসমাজ উপন্যাসের প্রেক্ষাপট

‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসটি লেখা হয়েছে ‘কুঁয়াপুর’ নামক একটি জনপদের পৃষ্ঠভুমিতে।

এই জনপদের দুটি সম্ভ্রান্ত পরিবার হল ঘোষাল পরিবার এবং মুখুজ্জে পরিবার। এই দুটি বিত্তশালী পরিবারের কর্তাদের মধ্যে মনোমালিন্য থেকে বিবাদ শুরু হয় এবং ক্রমে তা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। আবার, শুধুই যে পরিবারের মধ্যে বিবাদ তা নয়,   মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলে আসছে। শুধু যে দুটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে তা নয়। নিজ পরিবারের ভাইদের মধ্যেও এই সমস্যা শাখা বিস্তার করেছে।

প্রধান তিন চরিত্র হলেন –

বেণী ঘোষালঃ যিনি বর্তমানে ঘোষাল পরিবারের বড়-কর্তা, পোড় খাওয়া জমিদার।

রমেশ ঘোষালঃ ঘোষাল পরিবারের ছোট সদস্য এবং উচ্চ শিক্ষিত। রমেশের জ্যাঠার সন্তান বেণী। রমেশের বাবার সাথে বেণীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। সেই শৈত্যের আঁচ তাদের দুজনের সম্পর্কে লক্ষ্য করা যায়।

রমাঃ মুখুজ্জ্যে পরিবারের সদস্য এবং তাদের জমিদারীর প্রধান কর্ত্রী।

পল্লীসমাজ গল্পের বিস্তারিত আলোচনা। ↓

পল্লীসমাজ গল্পের বিষয় সংক্ষেপ

দুইদিনের অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ফলে গ্রামের প্রধান চাষ জমিতে জল জমেছে। এই জল যদি দ্রুত বের না করে দেওয়া যায় সেক্ষেত্রে ফসল পচে যাবে এবং চাষিদের সারা বছরের পরিশ্রম নষ্ট হবে। মাঠের দুই প্রান্তে দুটি বাঁধ আছে, এই জল বের করার রাস্তা হল সেই বাঁধের কোন একটি কেটে দেওয়া। একটি বাঁধ পোক্ত এবং সরকারী, তাই তা কাটা সম্ভব নয়। অপর বাঁধটি যৌথভাবে মুখুজ্জ্যে এবং ঘোষালদের। জল বের করার একমাত্র রাস্তা ঐ বাঁধটি কেটে দেওয়া। কিন্তু, ঐ বাঁধের সাথে একটি জলা আছে যাতে মাছ চাষ করা হয় এবং তা থেকে ভালো উপার্জন হয় সম্ভ্রান্ত দুই পরিবারের। তাই বাঁধ কেটে আর্থিক লোকসানে আগ্রহী নয় তারা।

নিরুপায় চাষিরা সারাদিন বড় কর্তা বেনী ঘোষালের কাছে আর্তি জানিয়ে বিফল হয়ে, ছোট কর্তা রমেশ ঘোষালের কাছে বাঁধ কেটে তাদের ফসল রক্ষার আর্তি জানাচ্ছেন। বেণী ঘোষাল নির্দয় জমিদার হলেও, রমেশ ছিলেন জনদরদী। তিনি চাষিদের আর্তি মেনে দাদার সাথে অনুমতি নিয়ে বাঁধ কাটার ব্যবস্থা করতে চান।

রমেশ, বেণীকে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে তাদের দুশো টাকা লোকসান না করতে চাওয়ার ফলে চাষিদের পাঁচ–সাত হাজার টাকা ক্ষতি হবে, প্রকৃত পক্ষে তারা সারা বছর বিপুল অর্থসংকটের সম্মুখীন হবে। কিন্তু বেণী, রমেশের প্রস্তাবে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন –

“ধার-কর্য করে খাবে। নইলে আর ব্যাটাদের ছোটলোক বলেচে কেন?”

যেহেতু ঐ জলায় বেণী, রমেশ এবং রমার তিন জনের অধিকার আছে। তাই ক্ষুব্ধ রমেশ, রমার বাড়ি যায়। এখানে একটু বলে রাখা ভালো যে উপন্যাসটি পড়লে আমরা দেখতে পাবো যে রমা এবং রমেশ ছিল সহপাঠি। কিন্তু পারিবারিক বিবাদের জেরে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। রমেশের আশা ছিল যে রমার কাছ থেকে সে বাঁধ কাটার প্রয়োজনীয় সস্মতি পাবে। কিন্তু এখানেও তাকে বিফল হতে হয়। বরং, রমা তাকে জানায় যে “না অত টাকা লোকসান আমি করতে পারব না”।

রমেশ তাকে পুনরায় অনুনয় করলে রমা ক্ষতিপূরণ দাবী করে। এতে রমেশ ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয় এবং বলে –

“মানুষ খাঁটি কিনা, চেনা যায় শুধু টাকার সম্পর্কে”

অর্থাৎ রমেশ বোঝাতে চায় যে মানুষের প্রকৃত রূপ তখনই বোঝা যায় যখন তার নিজ স্বার্থে আঘাত লাগে। আরো খানিক কথাবার্তার পরে রমেশ, রমাকে জানায় যে সে নিশ্চয় ক্ষতিপূরন দিতে পারে কিন্তু এই কাজের জন্য সে ক্ষতিপূরন দেবে না। কারণ সে মনে করে-

“সংসারে যত পাপ আছে মানুষের দয়ার উপর  জুলুম করাটা সবচেয়ে বেশি”।

রমেশ জানায় যে সে জোর করে বাঁধ কাটবে। যদি রমার সামর্থ্য থাকে তো সে রমেশকে বাধা দিতে পারে।

ক্ষুব্ধ রমা তাদের বিশ্বস্ত লাঠিয়াল আকবর এবং তার দুই পুত্রকে বাঁধ পাহারার জন্য পাঠায়। সে ভেবেছিল যে অভিজ্ঞ লাঠিয়াল আকবরের লাঠির জোরের সামনে রমেশের ‘হিন্দুস্থানি চাকর’ কোনরকম প্রতিরোধ করতে পারবে না। কিন্তু সে ভুল ভেবেছিল, কারণ রমেশের ‘হিন্দুস্থানি চাকর’ খুব সহজেই হার মেনে নিলেও, রমেশ রুখে দাঁড়ায় এবং রমেশের লাঠির ঘায়ে জখম হয় আকবর। পরাজয় স্বীকার করে ফিরে আসে আকবর ও তার দুই পুত্র।

আকবরদের আহত অবস্থায় ফিরে আসতে দেখে বেণী ও রমা অবাক হয়।

আকবরের কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে, বেণী তাকে পুলিসের কাছে মিথ্যা সাক্ষী দিতে বলে। কিন্তু আকবর সেই অন্যায় কাজে রাজী হয় না। লাঠিয়াল আকবরকে পাঁচটা গাঁয়ের লোক সর্দার বলে, সে তার কর্তাদের জন্য মিথ্যা কারণে আসামী হয়ে নিজে জেল খাটতে রাজী আছে কিন্তু মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে ফৈরিদি হতে রাজী নয়। ‘সর্বপ্রকার অনুনয়, বিনয়, ভর্ৎসনা, ক্রোধ উপেক্ষা’ করে আকবররা ফিরে যায়।

এই ঘটনায় বেণী ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়। প্রথমত, জলা কাটার জন্য আর্থিক ক্ষতি স্বীকার এবং দ্বিতীয়ত মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে রমেশকে ‘জেলের ঘানী’ টানাতে না পারার দুঃখ তাকে রাগে অন্ধ করে দেয়। অপরদিকে রমা একপ্রকার নিশ্চিন্ত হয়, যদিও এই ঘটনার ফলে তার পরাজয় ঘটেছে এবং তাকে অপমানিত হতে হয়েছে,  কিন্তু এই নিশ্চিন্ততা কারণ সে নিজে বুঝতে পারে না। সে রমেশের চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মমতায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।


অষ্টম শ্রেণির অন্য বিভাগবাংলা | ইংরেজি | গণিত | বিজ্ঞান

পল্লীসমাজ সারসংক্ষেপ

কথা সাহিত্যিক তার ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে তৎকালীন পল্লী সমাজের কিছু সাধারণ ঘটনার মধ্যে, মানসিক টানাপোড়েন  অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

এই গল্পের নায়ক রমেশ; যে প্রকৃতপক্ষে জন-দরদী। গ্রামের মানুষের সুখ সাচ্ছন্দ রমেশের নিজের শ্রী বৃদ্ধির থেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই সে নিজ অর্থে গ্রাম-বাসীদের জন্য রাস্তা বাঁধিয়ে দেয়। গ্রামবাসীদের জন্য অভিজ্ঞ লাঠিয়ালের সামনে নিজের জীবন বাজি রাখতে পিছপা হয় না। অপরদিকে বেণী ঘোষাল যিনি নিজ স্বার্থ ছাড়া অপর কিছুই দেখতে পান না, বেণীর কাছে আপামর গ্রামবাসীর আর্থিক ক্ষতির কাছে নিজের সামান্য ক্ষতি বড় হয়ে ওঠে। বরং, গ্রামবাসী বিপদে পড়লে তার কাছ থেকেই চড়া সুদে ধার নেবে এই কথা ভেবে সে আনন্দিত হয়।

রমা চরিত্রটি কিন্তু অপেক্ষাকৃত জটিল। রমেশের কাজকে সে সমর্থন করে কিন্তু পারিবারিক টানাপোড়েনের জালে প্রকৃত রমা চাপা পড়ে যায়। তাই জমিদার রমার যখন হার হয়, তখন রমেশের সহপাঠী রমা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে।

সমাপ্ত। আরো পড়ো → গাছের কথা প্রবন্ধের সম্পূর্ণ আলোচনা


এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।



Join JUMP Magazine Telegram


JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –

VIII-Ben-Pollisomaj