বাংলা – নবম শ্রেনি – চিঠি (প্রবন্ধ)
লেখক পরিচিতিঃ
স্বামী বিবেকানন্দ এই নামটি সম্পর্কে আমরা সকলেই সুপরিচিত। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ ভারতবাসীর কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে তার বিখ্যাত শিকাগো বক্তৃতা, প্রাচ্যের মানুষের কাছে ভারতবাসী সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাগুলি ভেঙ্গে দিয়ে ভারত তথা প্রচীন বৈদিক সভ্যতা সম্পর্কে নতুন ধারণা সৃষ্টি করে। প্রাচ্যে বেন্দান্ত ভাবধারার প্রসার, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠা স্বামীজির প্রধান কাজগুলির অন্যতম।

প্রাক্কথন
স্বামীজি ১৮৯৩ সালে ‘শিকাগো ধর্মসম্মেলনে’ তাঁর বিখ্যাত শিকাগো বক্তৃতা দেন। এই বিখ্যাত বক্তৃতার ফলে, প্রাচ্যের বহু মানুষের মনে ভারতবর্ষ তথা সুপ্রাচীন বৈদিক সভ্যতা সম্পর্কে নতুন ধারণার সৃষ্টি হয়। বলা বাহুল্য, স্বামীজির অসাধারণ জ্ঞান ও বাগ্মিতার আকর্ষণে তিনি তৎকালীন প্রাচ্যে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন এবং পরবর্তী সময়ে আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বহু জায়গায় তিনি বক্তৃতা করেন।
স্বামীজির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ভাবধারায় ও আদর্শে একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই মঠের দ্বারা ‘শিব জ্ঞানে জীব সেবার’ মাধ্যমে ভারতবর্ষের উন্নতি সাধন করা। কিন্তু মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করার মতো আর্থিকবল ও লোকবল তাঁর ছিল না।
প্রাচ্যে নানান স্থানে থাকার সময় তার বহু মানুষের সাথে পরিচিতি হয় এবং তাদের মধ্যে বেশ কিছু মানুষ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মিস মার্গারেট নোব্ল্, যিনি পরবর্তী সময়ে আমাদের কাছে যিনি ভগিনী নিবেদিতা নামে পরিচিত হন। স্বামীজির এই শিষ্যা তাঁর ইউরোপিয় জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে ভারতবর্ষের উন্নতিকল্পে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
[আরো পড়ুন – আকাশে সাতটি তারা কবিতার আলোচনা]
বর্তমান পাঠ্য চিঠিটি, স্বামীজি ১৮৯৭ সালে আলমোড়া থেকে মিস মার্গারেট নোব্ল্-কে লিখছেন। মিস নোব্ল্ বেদান্ত ভাবধারায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে ভারতবর্ষে আসবেন বলে মনস্থির করেছেন। এই চিঠিতে স্বামীজি, মিস নোব্ল্-কে তৎকালীন ভারতবর্ষের পরিস্থিতি এবং তার কাজ সম্পর্কে সাম্যক ধারণা দেবার চেষ্টা করেছেন। মূল চিঠিটি ইংরাজী ভাষায় লেখা হয়েছিল, আমরা চিঠিটির বঙ্গানুবাদ আমদের পাঠ্যে পড়েছি।
আরো একটা কথা আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, যে সময়ে এই চিঠিটি লেখা হয়েছে, তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। দেশের মধ্যে এক স্থান থেকে এক স্থানে চিঠি যেতেই সময় লাগতো বহুদিন। আর এক দেশ থেকে অন্য আর এক স্থানে চিঠি যেত জাহাজের মাধ্যমে তাই মাসের পর মাস লাগতো একটা চিঠি প্রেরকের কাছ থেকে প্রাপকের কাছে পৌঁছাতে। আজকের ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের যুগে দাঁড়িয়ে আমাদের কাছে চিঠি একটা কল্পনা মাত্র। তাই মূল বিষয়ে যাবার আগে পাঠককে তৎকালীন শ্লথ যোগাযোগ ব্যবস্থার কথা মাথায় রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
বিষয়সংক্ষেপ
চিঠির একেবারে শুরুতেই স্বামীজি মিঃ স্টার্ডির একটি চিঠির কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে তিনি জেনেছেন যে মিস নোব্ল্ ভারতবর্ষে আসতে চান, সেই সুত্র ধরে তিনি মিস নোব্ল্-কে চিঠি লিখতে বসেছেন।
আমরা জানি কোন কঠিন কার্য শুরু করার আগে সেই কাজের গুরুত্ব এবং কাজের সমস্যাগুলি জানা থাকলে আমাদের কাজটি করতে সুবিধা হয়। স্বামীজি এই কাজটিই করেছেন মিস নোব্ল্-এর জন্য। স্বামীজি মিস নোব্ল্-কে জানিয়েছেন যে ভারতবর্ষে বিশেষ করে নারী সমাজের জন্য মিস নোব্ল্-এর মতো একজন দৃঢ়চেতা, শিক্ষিতা এবং উদারমনস্কা মহিলাকে বিশেষ প্রয়োজন। তাই মিস নোব্ল্-এর কাজের গুরুত্ব ভারতবর্ষের জন্য অপরিসীম।
জলবায়ুও একটি বিশাল বাধার সৃষ্টি করতে পারে। কারণ ইউরোপের জলবায়ুর সাথে ভারতবর্ষের জলবায়ুর পার্থক্য বিরাট। ইউরোপের গ্রীষ্মে যেমন জলবায়ু থাকে ঠিক তেমনই ভারতে শীতকালে জলবায়ু হয়। আর ভারতের গ্রীষ্মকালে মনে হয় যেন আগুনের ‘হলকা’ চলছে। ইউরোপের মত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এদেশে বিরল। তাই তাঁর মত আজন্ম ইউরোপে কাটানো নারীর পক্ষে ভারতবর্ষে যে প্রচুর সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে তা নিয়ে স্বামীজি বারবার মিস নোব্ল্-কে সাবধান করেছেন।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]
একটি ব্যাপার বিশেষ লক্ষণীয় যে, স্বামীজি কিন্তু মিস নোব্ল্-কে পরিস্থিতির ভয় দেখিয়ে তাঁকে কাজ থেকে বিরত হতে বলছেন না। তিনি শুধুমাত্র তাঁকে সমস্যার কথা বলে অগ্রিম সাবধান করছেন মাত্র। পাশাপাশি তিনি এটাও জানিয়েছেন যে, যেকোন অবস্থায় স্বামীজি তার পাশে আছেন এবং আমরণ থাকবেন। এমনকি মিস নোব্ল্ যদি ভারতের জন্য কাজ করা ছেড়ে দেন বা বেদান্ত ধর্ম ত্যাগ করেন তাহলেও তাঁর কথার নড়চড় হবে না। এই প্রসঙ্গে স্বামীজি বলেছেন –
“‘মরদ কা বাত হাতি কা দাঁত’- একবার বেরুলে আর ভিতরে যায় না; খাঁটি লোকের কথারও তেমনই নড়চড় নেই – এই আমার প্রতিজ্ঞা।”
ভারতবর্ষের পরিস্থিতির পাশাপাশি, স্বামীজি আরো কয়েকটা বিষয়ে মিস নোব্ল্-কে সাবধান করেছেন।
প্রথমত স্বামীজি বলেছেন মিস নোব্ল্ যেন সর্বদা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, কারুর ‘পক্ষপুটে’ তিনি যেন আশ্রয় না নেন। প্রসঙ্গত তিনি আর এক বিদেশি মিস মুলারের (বিদেশে স্বামীজি এনার অথিতি ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইনি বেলুড় মঠ স্থাপনের কাজে অর্থ সাহায্য করেছিলেন) প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]
স্বামীজির মতে মিস মুলার চমৎকার মহিলা হলেও তিনি নিজেকে নেত্রী হিসাবে ভাবতে ভালোবাসেন এবং অর্থের দম্ভে বিশ্বাস করেন; তাই তার সাথে ‘বনিয়ে চলা অসম্ভব’। কলকাতায় তিনি একটি ভাড়া বাড়ির পরিকল্পনা করেছেন, তাতে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে আগত সকল বন্ধুদের আশ্রয় দেবেন বলে ঠিক করেছেন; কিন্তু তাঁর রুক্ষ মেজাজ এবং অদ্ভুত অস্থিরচিত্ততার জন্য ঐ ‘মঠাধ্যক্ষাসুলভ’ সংকল্প বাস্তবায়িত হওয়া কঠিন। তাই তিনি বার-বার মিস নোব্ল্-কে সাবধান করেছেন তিনি যেন সর্বদা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেস্টা করেন।
[প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মিসেস সেভিয়ার ছিলেন স্বামীজির বিখ্যাত ইংরেজ শিষ্যা। তিনি ও তাঁর স্বামী মিঃ সেভিয়ার অর্থাৎ ক্যাপ্টেন জে এইচ সেভিয়ার, স্বামীজির ইচ্ছায় ‘মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এনাদের একত্রে সেভিয়ার দম্পতি বলা হত। এনারা উভয়েই বেদান্ত ধর্ম প্রচারের কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।]

এই সংক্ষিপ্ত অথচ ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই চিঠির মাধ্যমে স্বামী বিবেকানন্দ, মিস নোব্ল্-কে শুধুমাত্র যে তাঁর ইচ্ছা, কাজের গুরুত্ব, সমস্যা এবং কর্মপ্রণালী সম্পর্কে অবহিত করেছেন তা নয়, এই সংক্ষিপ্ত চিঠিতে উঠে এসেছে এক স্নেহময় গুরুর তাঁর শিষ্যার প্রতি স্নেহ, চিন্তা ও বিশ্বাসের কথা।
Darun Swamiji Amar gurudev onar somporke aro jante chai 🌹🌹
প্রিয় রুদ্রজিৎ, স্বামীজি আমাদের সকলের আদর্শ। আমরা ওনার সম্পর্কে আরো লেখা ভবিষ্যতে অবশ্যই প্রকাশ করবো।