ইতিহাস– নবম শ্রেণি – উনবিংশ শতকের ইউরোপ – রাজতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী সংঘাত(তৃতীয় পর্ব)
আগের পর্বে আমরা দেখেছি কিভাবে ফ্রান্স এবং অস্ট্রিয়ায় প্রাচীনপন্থী রাজতন্ত্রের সাথে প্রজাতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের সংঘাত ঘটে। এই পর্বে আমরা ইতালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করবো।
শুনে নাও ইতালির ঐক্য আন্দোলন পর্বের আলোচনা ↓
ইউরোপের উত্থানের পেছনে রোমান সভ্যতা তথা ইতালির অবদান অনস্বীকার্য।
নেপোলিয়নের ইতালি অধিগ্রহণের আগে রোম এবং ইতালি ছোট ছোট বেশ কয়েকটি দেশে বিভক্ত ছিল। নেপোলিয়ন নিজের স্বার্থে ইতালিকে একটি ঐক্যবন্ধ দেশের আকৃতি দেন। নেপোলিয়নের পতনের পরে ভিয়েনা সম্মেলনের গৃহীত নীতির ভিত্তিতে ইতালি আবার তার পুরানো অবস্থা অর্থাৎ ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে যায়। ‘ইতালি’ তার অস্তিত্ব হারায়।
কিন্তু নেপোলিয়নের শাসনকালে যে রাজতন্ত্রহীন এক প্রগতিশীল শাসনব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল তা দেশের নাগরিকদের মনে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে তাদের পক্ষে আবার প্রাচীন রাজতন্ত্রে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না, তাই বিভক্ত রাজ্যগুলিতে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে ওঠে। মূল বিষয়ে যাবার আগে, আমরা তৎকালীন বিভক্ত রাজ্যগুলি বুঝে নিই।
ইতালির স্বাধীনতা আন্দোলন সার্ডিনিয়া – পিডমন্ড রাজ্যকে (ম্যাপে রঙ আকাশী নীল) কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছিল।
এছাড়া উল্লেখযোগ্য রাজ্যগুলি হল পোপের রাজ্য (ম্যাপে Papal states), নেপল্স্ এবং সিসিলি (ম্যাপে Kingdom of the two Sicilies), লম্বার্ডি এবং ভিনেশিয়া (ম্যাপে Kingdom of Lombardy–Venetia)
রিসর্জিমেন্টো আন্দোলন
রিসর্জিমেন্টো কথার অর্থ পুনর্জাগরণ। সেই সময় ইতালিতে একদল বুদ্ধিজীবী এবং চিন্তাবিদ, তাদের কাজের মাধ্যমে দেশের জনগণের সামনে ইতালির গৌরবময় ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের কথা তুলে ধরে নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা সম্প্রসারণ করতে সচেষ্ট হন। এদের মধ্যে লিওপার্ডি এবং ক্যাপ্পোনি ছিলেন অগ্রগণ্য। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইতালির স্বাধীনতার জন্য বিদেশী সাহায্যের দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করা।
কার্বোনারি
মুক্তি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইতালিতে প্রচুর গুপ্ত সংগঠন গড়ে ওঠে।
এদের মধ্যে অন্যতম ছিল কার্বোনারি। কার্বন বা অঙ্গার শব্দ থেকে কার্বোনারি শব্দের উৎপত্তি হয়, এই সংগঠনের সভ্যরা প্রতীক হিসাবে অঙ্গার ব্যবহার করতেন। কার্বোনারি এবং অন্যন্য গুপ্ত বিপ্লবী দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল পুরাতন কাঠামো ভেঙে নতুন সংবিধান তৈরি করা। এর জন্য এই গুপ্ত সংগঠনদের মূল হাতিয়ার ছিল সন্ত্রাস এবং গুপ্ত হত্যা। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হলে এই গুপ্ত সংগঠনের ভুমিকায় মধ্য ইতালিতে ব্যাপক গন আন্দোলনের সূচনা হয়, তবে সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এই আন্দোলন ব্যার্থ হয়।
জোসেফ ম্যাৎসিনি (Giuseppe Mazzini)
এককথায় জোসেফ ম্যাৎসিনি ছিলেন ইতালির মুক্তি আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ।
প্রথমদিকে তিনি কর্বোনারির সদস্য ছিলেন এবং পিডমন্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্রধান ভুমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৮৩০ এর আন্দোলনের ব্যার্থতার পরে তিনি উপলব্ধি করেন যে শুধুমাত্র সন্ত্রাসের বা বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা আসবে না, স্বাধীনতার জন্য দেশবাসীকে দেশপ্রেম সম্পর্কে সজাগ করতে হবে। প্রধানত যুবসমাজকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইয়ং ইতালি বা নব্য ইতালি নামক দল প্রতিষ্ঠা করেন, এই দলের সদস্য হতে গেলে সভ্যের বয়স চল্লিশের নিচে হতে হত। ম্যাৎসিনির দল ইতালির গ্রামে – গঞ্জে দেশপ্রেম সম্পর্কে প্রচার করে।
বিভক্ত ইতালিতে অস্ট্রিয়ার যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
ম্যাৎসিনি উপলব্ধি করেন যে ইতালির ঐক্য সম্ভব হবে অস্ট্রিয়ার বিতাড়নের মাধ্যমে। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্সে ফ্রেব্রুয়ারি বিপ্লব শুরু হলে ইতালিতেও তার প্রভাব পড়ে। পিডমন্ডের রাজা অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন, কিন্তু এই যুদ্ধে তাঁর পরাজয় ঘটে। এদিকে মধ্য ইতালিতে পোপের রাজ্যে ম্যাৎসিনি একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন (Roman Republic)। কিন্তু ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের হস্তক্ষেপে এই প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটে। জোসেফ ম্যাৎসিনি ইতালি ত্যাগ করে ইংল্যন্ডে চলে যান।
জেনে রাখার জন্য
ইতালির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সেরা চরিত্র জোসেফ ম্যাৎসিনি আজীবন দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। ইতালির পরাধীনতায় শোকের চিহ্ন হিসাবে তিনি আজীবনকাল কালো পোশাক পরতেন। জোসেফ ম্যাৎসিনি পরবর্তী কালে বিশ্বের বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের (যেমন জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহেরু, গোলডা মেয়র ইত্যাদি) অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – বাংলা | নবম শ্রেণি – ইতিহাস | নবম শ্রেণি – ভূগোল]
কাউন্ট ক্যাভুর
জোসেফ ম্যাৎসিনির ব্যার্থতার পরে ইতালির ঐক্যআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি ক্যাভুর। ইউরোপের ইতিহাসে অন্যতম দক্ষ কূটনৈতিক ক্যাভুর কিন্তু বিপ্লবী মনস্ক ছিলেন না। বরং তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। ১৮৫২ সালে পিডমণ্ড – সার্ডিনিয়ার রাজা তাকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। তবে ম্যাৎসিনির মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে ইতালির মুক্তির জন্য অস্ট্রিয়ার অপসারণ প্রয়োজন এবং এই কাজে বিদেশী শক্তির সাহায্যের প্রয়োজন আছে।
ইতালির মুক্তির উদ্দেশ্যে তার দুটি পরিকল্পনা ছিল, দেশের অভ্যন্তরে প্রধান শক্তি হিসাবে পিডমণ্ড – সার্ডিনিয়াকে শক্তিশালী করা এবং দেশের বাইরে বিদেশী শক্তির মনযোগ আকর্ষণ করা। এই উদ্দেশ্যে তিনি কিছু পদক্ষেপ করেন –
প্রথমত, পিডমণ্ড – সার্ডিনিয়ার আইন – প্রশাসন এবং সামরিক দিকে নানান সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে রাজ্যকে শক্তিশালী করেন।
দ্বিতীয়ত, নানান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ইতালির দুর্দশার কথা তুলে ধরে বিদেশী শক্তির সহানুভুতি পাবার চেষ্টা করেন। ১৮৫৪ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে তিনি অযাচিত ভাবে ব্রিটিশ – ফ্রান্সের হয়ে যুদ্ধে যোগদান করেন। এর ফলে যুদ্ধ শেষ হবার পর শান্তি সম্মেলনে (প্যারিস – ১৮৫৬) ইতালি আমন্ত্রিত হয়, এবং এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইতালির সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
[আরো পড়ুন – নবম শ্রেণি – ভৌত বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – জীবন বিজ্ঞান | নবম শ্রেণি – গণিত ]
প্লমবিয়ার্সের চুক্তি
আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফ্রান্সের সাথে ঘনিষ্ঠাতার হবার সুবাদে, ক্যাভুরের উদ্যগে পিডমণ্ড – সার্ডিনিয়ার রাজার সাথে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের গোপন একটি সন্ধি হয়। এতে চুক্তি হয় যে, অস্ট্রিয়া কোন কারণে পিডমণ্ড – সার্ডিনিয়া আক্রমণ করলে ফ্রান্স তাদের সাহায্য করবে এবং এর পরিবর্তে ফ্রান্স স্যাভয় ও নিস নিজেদের দখলে নেবে।
উত্তর ইতালির সংযুক্তিকরণ
১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রিয়া পিডমণ্ড – সার্ডিনিয়া আক্রমণ করলে ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। পিডমণ্ড – সার্ডিনিয়া এই যুদ্ধে জয়লাভ করে শুধু তাই নয় অস্ট্রিয়ার দখলে থাকা লম্বার্ডি এবং মিলান অধিকার করে। পিডমন্ডের সাথে লম্বার্ডি যুক্ত হয়ে উত্তর ইতালি তৈরি হয়।
মধ্য ইতালি
লম্বার্ডি রাজ্য পিডমন্ড – সার্ডিনিয়ার সাথে সংযুক্ত হলে অন্যন্য ছোট রাজ্য মডেনা, টাস্কেনি, রোমানা প্রভৃতি রাজ্যগুলিও যুক্ত হবার জন্য দাবী জানায়। কিন্তু অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্স এতে তাদের আপত্তি জানায়। সমাধানের উদ্দেশ্যে ক্যাভুর তৃতীয় নেপোলিয়নের সাথে সমঝোতা করেন যে, ফ্রান্স তাদের আপত্তি প্রত্যাহার করবে এবং এর বিনিময়ে পিডমন্ড – সার্ডিনিয়া, ফ্রান্সকে স্যাভয় ও নিস প্রদান করবে। এর ফলে মধ্য ইতালির রাজ্যগুলির সংযুক্ত হবার বাধা কেটে যায়।
দক্ষিন ইতালি
দক্ষিন ইতালি অর্থাৎ নেপল্স্ এবং সিসিলি ছিল বুরবোঁ রাজবংশের অধীনে। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার দাবীতে এখানে গন আন্দোলন শুরু হলে, বিপ্লবীরা গ্যারিবল্ডির সাহায্য চায়। পিডমন্ড – সার্ডিনিয়ার সমর্থনে ম্যাৎসিনির শিষ্য, বীর গ্যারিবল্ডির নেতৃত্বে এক সহস্র সেনা (Red Shirts Army) এই বিদ্রোহে যোগদান করে এবং এক দুঃসাহসিক অভিযানের মধ্যমে নেপল্স্ এবং সিসিলি নিজেদের অধিকারে আনে।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে নেপল্স্ এবং সিসিলি গনভোটের মাধ্যমে পিডমন্ড – সার্ডিনিয়ার সাথে যুক্ত হয়, তৈরি হয় ইতালি দেশ; ভিক্টর ইমান্যুয়েল ইতালির রাজা ঘোষিত হন। এই সময়ে রোম এবং ভেনেশিয়া বাদে সমগ্র ইতালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
জেনে রাখার জন্য
জোসেফ ম্যাৎসিনি অন্যতম শিষ্য ছিলেন গ্যারিবল্ডি। ম্যাৎসিনি রোমান প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কালে গ্যারিবল্ডি ছিলেন তার সেনাপতি। ফ্রান্সের হস্তক্ষেপে প্রজাতন্ত্র উচ্ছেদ হলে গ্যারিবল্ডি ধরা পড়েন এবং তার মৃত্যুদণ্ড হয়। কিন্তু গ্যারিবল্ডি পালিয়ে যান, এবং বিশ্বের বিভিন্ন অংশে সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দেন। পরে ইতালিতে ফিরে মুক্তি আন্দোলনে যোগ দেন। নেপল্স্ এবং সিসিলির সেনা বাহিনী গ্যারিবল্ডির এক সহস্র সেনা অপেক্ষা বেশি শক্তিশালী হওয়া স্বত্বেও গ্যারিবল্ডির বাহিনীর জয়ী হয়। পরবর্তী সময়ে গ্যারিবল্ডি অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। গ্যারিবল্ডিকে সারা বিশ্বে সম্মানের চোখে দেখা হয়।
রোম এবং ভেনেশিয়া দখল
এই অংশটি অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সের সেনা দ্বারা রক্ষিত ছিল।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রাশিয়া, অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ইতালি প্রাশিয়ার পক্ষে যোগ দেয় এবং যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পরাজয় ঘটে। এর ফলে ভেনেশিয়া ইতালির দখলে আসে।
আবার, ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স এবং প্রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে, ইতালি প্রাশিয়ার পক্ষ নেয় সেডানের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় হলে তারা রোম থেকে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। এর ফলে রোম ইতালির দখলে আসে।
এই ভাবে দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং সংঘাতের ফলে জন্ম নেয় স্বাধীন ঐক্যবন্ধ ইতালি।
পরবর্তী পর্ব – জার্মানির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
-
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-His-3C