ইতিহাস– নবম শ্রেণি – শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ (পঞ্চম পর্ব)
আমরা আগের পর্বগুলিতে জেনেছি যে শিল্পবিপ্লব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের সঞ্চার করেছিল এবং এই সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের শিকার হয়েছিল এশিয়া এবং আফ্রিকার প্রায় সমস্ত দেশ।
এই পর্বে আমরা জানবো যে কিভাবে এই ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামক এক ভয়াবহ হত্যালীলার জন্ম দিয়েছিল।
খুব সহজে এই পর্বের আলোচনা বুঝে নাও এই ভিডিও ক্লাস থেকে↓
ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা
শিল্পবিপ্লব সমাজে ‘পুঁজিবাদী’ নামক একটি শ্রেণির জন্ম দেয়। শিল্পবিপ্লবের সুবিধা এবং পুঁজি ব্যবহার করে তারা তাদের অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। প্রাথমিকভাবে, তারা কারখানায় উদ্ভুত পণ্য নিজের দেশে এবং ইউরোপের বাজারে বিক্রয় করলেও, ইউরোপের সব দেশে শিল্পবিপ্লব ছড়িয়ে পড়লে সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তারা নিজেদের পণ্য বিক্রয়ের জন্য অনগ্রসর দেশগুলিতে বাজারে বিক্রয় করতে শুরু করে।
নিরবিচ্ছিন্ন শিল্প উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন ছিল কাঁচামাল এবং শ্রমিকের।
এই চাহিদা পূরণ করার জন্য ইউরোপের দেশগুলির শিকার হয় অনগ্রসর দেশগুলি, তারা বাজার দখলের পরিবর্তে সম্পূর্ণ দেশেই নিজের শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। এই ভাবে এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের সবকটি দেশেই ইউরোপের দেশগুলি আধিপত্য বিস্তার করে। এবং ইউরোপের দেশগুলি ঐ উপনিবেশগুলি নিয়ে নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করে।
উগ্র জাতীয়তাবাদ
বাজার দখলের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলিতে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবধারার সঞ্চার হয়, প্রত্যেকটি দেশ তাদের নিজ নিজ জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করতে থাকে। এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লক্ষ্যে অন্যান্য জাতিকে পরাজিত করে তারা উপনিবেশ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে সচেষ্ট হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট
তৎকালীন সময়ে দেশগুলির কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল জটিল। তারা নিজ নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার কারণে যেকোন রকম আপস করতে পিছপা হত না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কোন সুস্পষ্ট কারণ ছিল না, বরং অনেক বছর ধরে চলা কিছু ঘটনা এবং অনেকগুলি তাৎক্ষনিক পদক্ষেপের কারণে এই ভয়াবহ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সংঘাত
পুঁজিবাদী শক্তিশালী দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি করে। উন্নত দেশগুলি নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য নিজেদের মধ্যে জোট বাঁধে।
ত্রিশক্তি মৈত্রী এবং ত্রিশক্তি আঁতাত
ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ইউরোপের প্রধান দেশগুলি জোট বেঁধে ভাগ হয়ে যায়। একদিকে থাকে জার্মানি। অষ্ট্রিয়া এবং ইতালি, এদের বলা হত ত্রিশক্তি মৈত্রী। অপরদিকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং রাশিয়াকে নিয়ে গঠিত হয় ত্রিশক্তি আঁতাত।
এই দুই শক্তিধর দেশের পরস্পর – পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ ইউরোপে যুদ্ধের পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
সামরিক শক্তি বৃদ্ধি
নিরাপত্তার অভাব এবং পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস থেকে প্রধান শক্তিধর দেশগুলি নিজ নিজ সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে জোর দেয়। জার্মানি নৌ – বাহিনী গঠন করা শুরু করলে, দেশগুলির মধ্যে অবিশ্বাস বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। সারা ইউরোপ জুড়ে বহু অস্ত্রের কারখানা স্থাপিত হয়। সারা ইউরোপ জুড়ে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
বলকান উত্তেজনা
দীর্ঘ আন্দোলনের কারণে বলকান অঞ্চল তুরস্কের অধীনতা মুক্ত হলেও সমস্যার সম্পূর্ণ মীমাংসা হয়নি। ইতিমধ্যে অষ্ট্রিয়া চুক্তি ভঙ্গ করে বসনিয়া এবং হার্জিগোভিনাকে নিজ অঞ্চলভুক্ত করলে উত্তেজনা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। বসনিয়া এবং হার্জিগোভিনার মানুষ সার্বিয়ার নেতৃত্বে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
আবার সেই সময়ে রাশিয়ার সাথে অস্ট্রিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল, ফলে রাশিয়া এই সময়ে সার্বিয়াকে সাহায্য করে। অপরদিকে জার্মানি অস্ট্রিয়াকে আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করতে সাহায্য করে। সব মিলিয়ে বলকান অঞ্চলে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
কাইজারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মান সম্রাট বা কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম বিশেষভাবে দায়ী ছিলেন। তিনি মনে করতেন জার্মান জাতি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। তাঁর সৃষ্ট ‘বিশ্বরাজনীতি তত্ব’-এর মূল কথা ছিল বিশ্বশক্তি বা ধ্বংস। তিনি বিসমার্কের যুদ্ধবিরোধী নীতি পরিত্যাগ করেন।
তাঁর সাম্রাজ্যনীতির কারনেই ইংল্যান্ড, রাশিয়া এবং ফ্রান্স যুদ্ধের রাস্তা বেছে নেয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ
আমরা আগের কয়েকটি ঘটনা থেকেই বুঝতে পারছি যে সারা ইউরোপের পরিস্থিতি ছিল অগ্নিগর্ভ; দরকার ছিল সামান্য একটু স্ফুলিঙ্গের। এই ঘটনাটি ঘটে বসনিয়ায়। বসনিয়ার রাজধানী সেরাজেভোর রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রান্সিস ফার্দিনান্দ এবং তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করা হয়।
এই ঘটনার জন্য দায়ী করে অষ্ট্রিয়া, সার্বিয়াকে 48 ঘণ্টা সময় দিয়ে একটি চরমপত্র দেয়। সার্বিয়া কিছু দাবী মানতে অস্বীকার করলে, ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জুলাই অষ্ট্রিয়া সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেড আক্রমণ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
এর পর একে একে জার্মানি, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জাপান, চীন, স্পেন, পর্তুগাল, তুরস্ক, বুলগেরিয়া এবং আমেরিকা এই যুদ্ধে যোগ দেয়। বলাই বাহুল্য ইউরোপের দেশগুলির সাথে তাদের উপনিবেশ দেশগুলি যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য হয়। সমগ্র বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশ এই যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে।
এই ভয়াবহ যুদ্ধে ১০ কোটি সেনা নিহত হয়েছিলেন, প্রায় ২০ কোটি মানুষ আহত হয়েছিলেন। অসংখ্য প্রাণ নিয়ে, মানব – সম্পদ ধ্বংস করে ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই নভেম্বর এই ভয়াবহ যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
অধ্যায় সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → রুশ বিপ্লবের পটভূমি
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা