ইতিহাস– নবম শ্রেণি – শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ (চতুর্থ পর্ব)
আমরা শিল্পবিপ্লব অধ্যায়ের চতুর্থ পর্বের আলোচনায় এসে পৌঁছেছি। আমরা আগেই জেনেছি যে, শিল্পবিপ্লবের ফলে ইউরোপের দেশগুলি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রাথমিক ভাবে ইংল্যান্ডের হাত ধরে শুরু হলেও, তা ধীরে ধীরে ইউরোপের প্রধান শক্তিশালী দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে।
এই পর্বের আলোচনা খুব সহজে বুঝে নাও এই ভিডিও থেকে↓
উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা
শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্প উৎপাদনের পরিমাণ বাড়লেও, বাজার ছিল সীমিত। সেই সময় তাদের দুটি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় –
শিল্পের জন্য কাঁচামালের অপ্রতুলতা
শিল্পসামগ্রী বিক্রির বাজার
উন্নত দেশগুলির এই দুটি সমস্যার একটি সমাধান তৈরি করে – উপনিবেশ স্থাপন।
ভেবে দেখো, কোনো দেশ উপনিবেশ স্থাপন করলে তারা সেই দেশের কাঁচামাল নিজের দেশের জন্য অতি অল্প ব্যয়ে ব্যবহার করতে পারবে আবার অপরদিকে ঐ দেশগুলির বাজারের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে; বা বলা যায় জোর করে নিজের দেশের শিল্পজাত দ্রব্য উপনিবেশগুলিতে বিক্রি করতে পারবে।
ইউরোপের বাইরে উপনিবেশ স্থাপন
১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী সময় থেকে ইউরোপের উন্নত দেশগুলি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ স্থাপনে জোর দেয়।
এই দৌড়ে এগিয়ে ছিল ইংল্যান্ড।
এর প্রধান কারণ, শিল্পবিপ্লবে তাদের এগিয়ে থাকা এবং নৌশক্তিতে তাদের পারদর্শিতা। শিল্পবিপ্লব ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়লে তারা উপনিবেশ স্থাপনে ব্রতী হয়। মূলত আফ্রিকা এবং এশিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
এশিয়া
এশিয়া মহাদেশে প্রধান দখল ছিল ইংল্যান্ডের। ভারত ছিল ইংল্যান্ডের দখল করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজার। আমরা আগে ইতিহাসে পড়েছি সামান্য বণিক হয়ে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করার মধ্যে দিয়ে কি চতুরতার সাথে ইংল্যান্ড ভারত দখল করেছিল।
ইংল্যান্ডের পাশাপাশি, ভারতে পর্তুগীজ এবং ফ্রান্সের আধিপত্য ছিল। ভারতের গোয়া , দশম, দিউ ইত্যাদি স্থান পর্তুগীজদের দখলে ছিল। ভারতের সীমিত কিছু অঞ্চল যেমন পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগর, পন্ডিচারি, মালাবার উপকূলের কিছু অংশ ফ্রেঞ্চদের দখলে ছিল।
ভারতের অধিকাংশ ছাড়া ভারতের পূর্বে ব্রহ্মদেশ (বর্তমানে মায়ানমার) এবং পশ্চিমে আফগানিস্থান অবধি ইংরেজদের দখলে ছিল। যদিও সেই সময়ে আফগানিস্থান নিয়ে ইংরেজ এবং রাশিয়ার মধ্যে বিবাদ ছিল।
দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়ায় হল্যান্ডের (বর্তমানে নেদারল্যান্ড) দখলে ছিল। এছাড়া মালয় অঞ্চলে (বর্তমানে মালদ্বীপ) প্রথমে পর্তুগীজদের আধিপত্য থাকলেও পরে ব্রিটিশরা তা অধিকার করে নেয়। ইন্দোচিন অঞ্চলে ফরাসীদের আধিপত্য ছিল। তবে শ্যামদেশ (বর্তমানে থাইল্যান্ড) অঞ্চল কিন্তু ইংল্যান্ড এবং ফরাসীদের প্রচেষ্টা স্বত্বেও স্বাধীন ছিল।
ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ প্রথমে স্পেনীয় শাসন থাকলেও পরে তা মার্কিনরা দখল করে নেয়।
এদিকে চীনদেশে প্রায় সকল ইউরোপিয় দেশগুলিই উপনিবেশ বিস্তারে অগ্রসর হয়। কিন্তু চীনে সম্পূর্ণরূপে কারুর অধিপত্য ছিল না।
সেই সময়ে এশিয়ার একটি বিশাল অংশ ছিল পারস্যদেশ। রাশিয়া এবং ইংল্যান্ড, পারস্য দেশে তাদের আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। কিন্তু মূলত পারস্যের জনগণের বিক্ষোভের ফলে তা সম্ভব হয়নি। তবে পারস্য দেশে রাশিয়া এবং ইংল্যান্ডের প্রাধান্য ছিল।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবনবিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
আফ্রিকা
সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে অধিক শিকার হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশ। ইউরোপের নিকটবর্তী এই দেশ সম্পর্কে ইউরোপের দেশগুলির কোন ধারণা ছিল না, সেই কারণে আফ্রিকা মহাদেশকে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ’ বলা হয়।
আফ্রিকার উপকূলবর্তী অংশবিশেষে ইউরোপের পা পড়লেও, অভ্যন্তর সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। অনগ্রসর জনজতি এবং বন্দুকের জোরে ইউরোপের দেশগুলি আফ্রিকাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন
ঔপনিবেসিকতার একটি সদর্থক প্রভাব পড়েছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিতে। উপনিবেশগুলি থেকে অতি কম মূল্যে কাঁচামাল আমদানি করা হত এবং নিজেদের শিল্পসামগ্রী রপ্তানি করা হত। এই কাজের জন্য গড়ে ওঠে প্রচুর বন্দর এবং রাস্তাঘাট।
রেলপথ
শিল্পবিপ্লবে রেলপথের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দেশের মধ্যে রেলপথের মাধ্যমেই কাঁচামাল এবং শিল্পসামগ্রী স্থানান্তরিত করা হত। এর ফলে ইউরোপের দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। যেমন ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডে ৬ হাজার মাইল রেলপথ ছিল কিন্তু ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে তা বেড়ে ১৭ হাজার মাইল হয়।
ইউরোপিয়রা নিজ স্বার্থে উপনিবেশগুলিতে রেলপথ স্থাপন করেছিল। এর ফলে উপনিবেশগুলিতেও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
সুয়েজ খাল
১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সুয়েজ খাল খনন করে ভুমধ্যসাগর এবং লোহিতসাগরকে সংযুক্ত করা হয়। এর ফলে এশিয়ার সাথে ইউরোপের দূরত্ব কমে আসে। এটি ছিল একটি যুগান্তকারী ব্যবস্থা।
টেলিগ্রাম
১৮৭০ সালে টেলিগ্রাম ব্যবস্থা শুরু হয়। এর ফলে বাণিজ্যের পাশাপাশি প্রশাসনিক দিকেও পরিবর্তন আসে। যেমন আগে ভারতের ইংরেজ আধিকারিকরা নিজেরাই সব প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতেন কিন্তু টেলিগ্রাম আসার পরে মূল সিদ্ধান্তগুলি ইংল্যান্ড থেকে নেওয়া হত ।
ভারতে শিল্পবিপ্লবের প্রভাব
ভারতে শিল্পবিপ্লবের ঋণাত্মক প্রভাব পড়েছিল। সেই সময়ে ভারত থেকে বহু দ্রব্য যেমন সুতির কাপড়, রেশম, চিনি, পাট, সোরা ইত্যাদি বিদেশে রপ্তানি হত। এছাড়া কিছু দ্রব্য যেমন মসলিন, বারানসি, পশম, ভারতীয় মশলা ইত্যাদির সুনাম ছিল জগত জোড়া। এছাড়া জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও ভারতের খ্যাতি ছিল।
ভারতে ব্রিটিশ আইন প্রণয়ন হলে তারা নিজেদের দ্রব্য ভারতে বিক্রি করার জন্য বিভিন্ন আইন আনে, শুধু তাই নয় ইউরোপের বাজারে যাতে ভারতীয় দ্রব্য না বিক্রয় করা যায় সেই জন্য তারা ভারতীয় দ্রব্যের উপর শুল্ক আরোপ করে। এইভাবে ভারতের শিল্প ব্যবস্থা ধিরে ধিরে ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। ভারতের বাজার ব্রিটিশ পণ্যে ভরে যায়। ভারত একটি আমদানিকারী রাষ্ট্র রূপান্তরিত হয়।
চতুর্থ পর্ব সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব → ঔপনিবেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ
পর্ব সমাপ্ত।
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্যভাবে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এই লেখাটি থেকে উপকৃত হলে সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাওয়ার জন্য –
- ফলো করো – WhatsApp চ্যানেল
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা
IX-His-4-d