ইতিহাস– নবম শ্রেণি – শিল্পবিপ্লব, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ (তৃতীয় পর্ব)
আমরা আগের পর্বে জেনেছি যে শিল্পবিপ্লবের ফলে সমাজে দুটি শ্রেণির উৎপত্তি হয়। প্রথমটি মালিকশ্রেণি বা পুঁজিপতি এবং দ্বিতীয়টি শ্রমিক শ্রেণি। স্বাভাবিক ভাবে এই শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যা, পুঁজিপতিদের তুলনায় অনেকটাই বেশি ছিল।
শ্রমিক ও মালিক শ্রেণিবৈষম্য
শিল্পবিপ্লবের ফলে দেশে দেশে শিল্পউৎপাদন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলে গ্রাম থেকে দলে দলে শ্রমিকরা শহরে এসে কারখানায় যোগদান করতে শুরু করেন। দুঃখের বিষয় শিল্পবিপ্লবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এই শ্রমিকদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা ছিল দুর্দশাপূর্ণ।
তাদের কাজের কোন নির্দিষ্ট সময় ছিল না, মালিক পক্ষ তাদের দিয়ে যতক্ষণ খুশি কাজ করাতেন, শুধু তাই নয় তাদের কাজের কোন নিরাপত্তা ছিল না। যেকোন সময় তাদের কাজ চলে যেত। এই অমানুষিক পরিশ্রমের পরে তারা সামান্য বেতন পেতেন। শুধু তাই নয়, পরিবারের আয় বৃদ্ধির জন্য মহিলা এবং শিশুরাও কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হয়।
শ্রমিকরা বাস করতেন ঘেটো নামক অস্বাস্থ্যকর বস্তির মতো অপরিসর স্থানে। তাদের জীবন ছিল দ্রারিদ্র এবং অশিক্ষায় পরিপূর্ণ। ফলে তাদের মধ্যে সহজেই নৈতিক স্খলন পরিলক্ষিত হত, মদ্যপান ছিল দৈনিক একটি ঘটনা। এই করুণ অবস্থার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে রোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, এমনকি তাদের গড় মৃত্যুহার ভয়ানক ভাবে বৃদ্ধি পায়।
এই অবস্থায় শ্রমিকপক্ষ এবং মালিকপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ – আন্দোলন অবিসম্ভাবী হয়ে ওঠে। জন্ম হয় সমাজতন্ত্র নামের নতুন একটি ধারণার।
সমাজতন্ত্রের উদ্ভবন
শ্রমিক এবং মালিকপক্ষের মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য সামাজিক স্তরে ভাবনা শুরু হয়। শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে সহানুভূতিশীল মানুষরা ভাবতে শুরু করেন যে কিভাবে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া যায়।
প্রথমযুগের সমাজতান্ত্রীক ভাবনা
অষ্টাদশ শতকের শেষদিক থেকে সমাজতান্ত্রিক ভাবনা শুরু হয়। প্রাথমিক চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবার্ট আওয়েন, হেনরি সেন্ট সাইমন, চার্লস ফুরিয়ার, লুই ব্ল্যাঙ্ক প্রমুখ। প্রথমযুগের সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন অতিরিক্ত আদর্শবাদী এবং কল্পনাপ্রবণ। তাদের ভাবনার বাস্তব প্রয়োগছিল একপ্রকার অসম্ভব কিন্তু তাদের কাজই পরবর্তী সময়ের সমাজতান্ত্রিক ভাবনার প্রেরণা যোগায়।
আমরা প্রাথমিক চিন্তাবিদদের মধ্যে কয়েকজনের সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নেব।
হেনরি সেন্ট সাইমন এই ফরাসী চিন্তাবিদকে ‘ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রের আদি গুরু’ বলা হয়। তিনি মনে করতেন অসম ধন বণ্টনের জন্যই সমাজে দুটি শ্রেণির উৎপত্তি হয়েছে, শিক্ষা এবং নীতিবোধের মাধ্যমে এই শ্রেণিবৈষম্য দূর করা সম্ভব। ‘প্রতিটি মানুষ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করবে এবং রাষ্ট্র তার সাধারণ প্রয়োজন মেটাবে’ সমাজতন্ত্রের এই মূল – মন্ত্র তিনিই প্রথম প্রচার করতে শুরু করেন।
রবার্ট আওয়েন – ইংল্যান্ডে তিনিই প্রথম সমাজতন্ত্রের ভাবনা প্রচার করেন। তিনি ছিলেন একজন পুঁজিপতি, কিন্তু তিনি তাঁর জীবনে কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে ধন অর্জন করেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে মালিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না করেও শ্রমিকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া যায়। তাঁর মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি ইংল্যান্ডে একটি ‘মডেল কারখানা’ স্থাপন করেন, এই কারখানায় শ্রমিকদের যথাযথ সম্মান ও সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হত।
চার্লস ফুরিয়ার – ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত সমাজতান্ত্রিক চার্লস ফুরিয়ার ‘কমিউন’ ধারণার প্রবর্তন করেন। তিনি ১৫০০ -২০০০ জন মহিলা এবং পুরুষ নিয়ে এক একটি দল গোষ্ঠী বা কমিউন তৈরি করেন। এই কমিউনগুলিতে সদস্যরা নিজ নিজ শ্রমের দ্বারা খাদ্য এবং বস্ত্র উৎপন্ন করতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের মধ্যে তা ভাগ করে নিতেন। তিনি মনে করেছিলেন যেহেতু এই কমিউনগুলিতে পুঁজিবাদের প্রধান ভিত্তি মুনাফা এবং প্রতিযোগিতা থাকবে না তাই কোনোরূপ শ্রেণি বৈষম্য থাকবে না এবং রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হবে না।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – বাংলা | English | ইতিহাস | ভূগোল
প্রথমযুগের সমাজতান্ত্রিক ভাবনার ত্রুটি
এই সময়ের সমাজতান্ত্রিকদের অধিকাংশই ছিলেন কল্পনাপ্রবণ। তাদের ভাবনার অধিকাংশেরই বাস্তব প্রয়োগছিল অবাস্তব।
এই আলোচনা খুব সহজে বুঝে নাও এই ভিডিও থেকে↓
কমিউনিজমের উদ্ভব
সমাজতন্ত্র তার পরিণতি পায় কার্ল হাইনরিখ মার্কস এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের হাত ধরে।
মানব ইতিহাসে যে সকল চিন্তাবিদ তাদের কাজের মধ্য দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন কার্ল হাইনরিখ মার্কস তাদের মধ্যে অন্যতম।
তিনি ছিলেন জার্মান আইনজীবী, তিনি প্যারিসে বাস করাকালীন ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সাথে পরিচিত হন। তাদের যৌথ ভাবনার মাধ্যমে জন্ম হয় আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বা কমিউনিজমের। ১৮৪৮ সালে তারা যৌথভাবে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো বা কমিউনিস্ট ইস্তাহার নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এটিই ছিল আধুনিক সমাজতন্ত্রের প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা।
‘মানব সমাজের ইতিহাস হল শ্রেণি সংগ্রামের নামান্তর মাত্র’
এটিই ছিল ঐ ইস্তাহারের মূল কথা। এই ইস্তাহারের মাধ্যমে তাঁরা ধনতন্ত্রে বিনাশের প্রয়োজনীয়তা এবং বিশ্বের সকল শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। তাদের তত্ত্ব পরিপূর্ণতা পায় ‘ডাস ক্যাপিটাল’ (Das Capital) নামক গ্রন্থে। প্রসঙ্গত, প্রাচীন সমাজতন্ত্রীদের সাথে নিজের ভাবনার বৈষম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজতন্ত্রের বদলে কমিউনিস্ট শব্দটি ব্যবহার করেন।
মার্কসবাদের সমালোচনা
মার্কসিয় সমাজতান্ত্রিক মতবাদ কিন্তু ত্রুটিমুক্ত ছিল না। এর কয়েকটি স্পষ্ট নিদর্শন আমরা ইতিহাস থেকে পাই।
প্রথমত, মার্কস মনে করতেন যে ধনতান্ত্রিক সমাজের পতন ঘটবে। বাস্তবে তা হয়নি, এমনকি যে সকল দেশে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানেও ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয়ত, মার্কস মনে করতেন যে ইতিহাসের গতি কেবলমাত্র অর্থনীতি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। এটিও ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কারণ ধর্ম, জলবায়ু, জাতীয়তাবাদি ভাবনা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ইত্যাদির দ্বারাও ইতিহাসের গতির পরিবর্তনের নিদর্শন লক্ষণীয়।
তৃতীয়ত, মার্কস মনে করতেন যে পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের সহাবস্থান অসম্ভব। এটিও ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কারণ বর্তমানে এমন বহু সমাজতন্ত্রিক রাষ্ট্র আছে যারা ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সাথে সহাবস্থান করছে।
কমিউনিজমের প্রভাব
এত সকল ত্রুটি থাকা স্বত্বেও এটি স্বীকার করতেই হবে যে তৎকালীন সময়ে বিশ্বে কমিউনিজমের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল।
নবম শ্রেণির অন্য বিভাগগুলি – গণিত | জীবন বিজ্ঞান | ভৌতবিজ্ঞান
সারা বিশ্ব জুড়ে শ্রমিকদের আন্দোলন শুরু হয় এবং পুঁজিপতিরা শ্রমিককল্যাণমূলক কর্মসূচী নিতে বাধ্য হন। কমিউনিজম তত্ত্বে ভর করে শ্রমিকরা, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ‘সর্বহারার একনায়কতন্ত্র’ স্থাপনে উদ্যোগী হয়। এর একটি আদর্শ নিদর্শন হয়ে ওঠে রাশিয়া। আমরা আগামী অধ্যায়ে রুশ বিপ্লব আলোচনা করার সময় এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানবো।
তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত। চতুর্থ পর্ব → ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবিস্তার
এই লেখাটির সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। বিনা অনুমতিতে এই লেখা, অডিও, ভিডিও বা অন্য ভাবে কোন মাধ্যমে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
JumpMagazine.in এর নিয়মিত আপডেট পাবার জন্য –
- সাবস্ক্রাইব করো – YouTube চ্যানেল
- লাইক করো – facebook পেজ
- সাবস্ক্রাইব করো – টেলিগ্রাম চ্যানেল
- Facebook Group – লেখা – পড়া – শোনা